১০ মে ২০২৪
The Tree Lover

পিঠের লোভে আঁটি পোঁতা, সেই গাছের বয়স হল ৭২, বাস্তবের বাঞ্ছারামের কোনও সাজানো বাগান নেই

গল্পের বাঞ্ছারামের ‘বারো বিঘে তেরো ছটাক’ জমির উপর বাগান। ভিতরে মাটির বাড়ি। শ্যামাপ্রসাদের জমি তিন বিঘে। চাষবাষ করে দিন কাটানোর কথা ছিল সেই জমিতে। কিন্তু গাছই সব ‘নষ্ট’ করে দিল।

photo of Shyama Prasad Banerjee, the tree lover of Bankura

‘ফলের আশায় কেউ কি বাগান সাজায়? মাটি, মাটি। মাটি বলে, আমারে সাজাও। নিষ্কাম সাজাও।’ গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

শিখা মুখোপাধ্যায়
সারেঙ্গা (বাঁকুড়া) শেষ আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৯:১৪
Share: Save:

বয়স তাঁর আশি পেরিয়েছে। আর তাঁর হাতে পোঁতা প্রথম গাছের বয়স হল বাহাত্তর। ‘বাহাত্তুরে’ বলে অবজ্ঞার কথাটি মুড়িয়ে দু’জনেই সুঠাম। ঋজু। সেই তালগাছ এখনও ফলদায়ী। আর মানুষটি গাছ পুঁতে চলেন। দিনের পর দিন। বছরের পর বছর। নাটক বা সিনেমার বাঞ্ছারামের মতো তাঁর বাগানের কিন্তু কোনও পাঁচিল নেই। বাস্তবের বাঞ্ছারাম সাজানো বাগান গড়ার চেষ্টাই করেননি কখনও। ব্যক্তিগত স্বার্থের সীমানা ছাড়িয়ে অনেক দূর পর্যন্ত প্রসারিত তাঁর বৃক্ষ-অভিযানের গল্প এবং সঙ্কল্প।

নাম শ্যামাপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়। নিবাস বাঁকুড়ার সারেঙ্গায়, দক্ষিণ কাশীবনে। অশীতিপর বৃদ্ধ আজও গাছ পুঁততে মাটিতে কোদাল চালান। জল দেন। আগাছা পরিষ্কার করেন। সব নিজের হাতে। গোটা ব্লকে তাঁর হাতে পোঁতা ‘সাবালক’ গাছের সংখ্যা হাজার পাঁচেক তো হবেই! শ্যামাপ্রসাদ শোনাচ্ছিলেন তাঁর রোজনামচা। বাঞ্ছারামের সঙ্গে তাঁর অমিল যেমন আছে, মিলও কম নয়। তাঁর কথায় শোনা যাচ্ছিল বাঞ্ছারামের সংলাপের প্রতিধ্বনি— ‘‘কোদাল চালাই। জল বই। গাছ পুঁতি।’’ ফল? ‘‘আজ্ঞে, ফলের আশায় কেউ কি বাগান সাজায়? মাটি, মাটি। মাটি বলে, আমারে সাজাও। নিষ্কাম সাজাও।’’

গল্পের বাঞ্ছারামের ‘বারো বিঘে তেরো ছটাক’ জমির উপর বাগান। তার মধ্যেই মাটির বাড়ি। শ্যামাপ্রসাদের জমি তিন বিঘে। চাষবাষ করে দিন কাটানোর কথা ছিল সেই জমিতে। কিন্তু গাছই সব ‘নষ্ট’ করে দিল। প্রেমে পড়ে গেলেন গাছের। সারা দিন ওই নেশাতেই মত্ত। ফলে সংসারে অনটন। চার ছেলেমেয়ের পড়াশোনা বেশি দূর করাতে পারেননি। কিন্তু গোটা ব্লকে গাছ লাগাতে পেরেছেন প্রচুর। পুকুরপাড় থেকে রাস্তার ধার, নিজের জমি থেকে অন্যের উঠোন— সর্বত্র গাছ পুঁতে গিয়েছেন জীবনভর। পুঁতে চলেছেন। এবং একটা নামও পেয়েছেন। শ্যামাপ্রসাদ যদিও সেটাকে উপাধি হিসাবেই দেখেন— গাছদাদু!

গাছদাদু শুধু গাছ পোঁতেন না, কাছাকাছি কোথাও গাছ কাটার খবর পেলেও তিনি হাজির। মাস কয়েক আগের কথা। এলাকার রাস্তা চওড়া হবে বলে গাছ কাটার নিদান দিয়েছিল বিডিও অফিস। শ্যামাপ্রসাদ সরাসরি পৌঁছে গেলেন বিডিও অফিসে। গাছ কাটা যাবে না বলে পাল্টা নিদান দিয়ে এলেন। শেষমেশ পুলিশ এসে হাজির। কিন্তু শ্যামাপ্রসাদকে বুঝিয়েসুঝিয়েও কাজ হল না। প্রশাসনিক নির্দেশে কাঠুরেরা এলেন। শুরু হবে গাছ কাটার কাজ। বৃদ্ধ গাছ জড়িয়ে ধরে বসে থাকলেন। কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেন করাত-কুড়ুল। তখন তাঁর দাবি একটাই, আগে একটা গাছ পিছু দুটো গাছ লাগাও। তার পরে গাছ কাটা যাবে। শেষে প্রশাসন সেই প্রতিশ্রুতিই দেয়। অন্যত্র লাগানো হবে এর দ্বিগুণ সংখ্যক গাছ। তার পর গাছ কাটার ‘অনুমতি’ দেন শ্যামাপ্রসাদ। সারেঙ্গার বিডিও ফাহিম আলম বলছিলেন, ‘‘রাস্তা বড় করার মতো উন্নয়নমূলক কাজের জন্য কখনও কখনও বরাত পাওয়া সংস্থাকে বাধ্য হয়ে রাস্তার ধারের গাছ কাটতে হয়। বহু বার এমন হয়েছে যে গাছ কাটতে দেখে তা বন্ধের আবদার নিয়ে আমাদের কাছে ছুটে এসেছেন শ্যামাপদবাবু। কিছু ক্ষেত্রে আমরা তাঁর আবদার রক্ষা করতেও পেরেছি। গাছের প্রতি ওঁর এই ভালবাসা নিখাদ ও সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ।’’

photo of Shyama Prasad Banerjee, the tree lover of Bankura

রোজ সকালবেলায় কোদাল আর জলের বালতি হাতে বেরিয়ে পড়েন নিয়ম করে।

কাশীবনে শ্যামাপ্রসাদের মাটির বাড়ি। দোতলা। উপরে টিনের চাল। সেখানেই চার ঘর ভাগ করে থাকেন সপরিবার শ্যামাপ্রসাদ। স্ত্রী, দুই ছেলে, তাঁদের স্ত্রী-পুত্র-কন্যা। শ্যামাপ্রসাদের দুই কন্যা বিবাহসূত্রে অন্যত্র থাকেন। শুধু পরিবারের লোকজন নন, শুধু কাশীবন নয়, গোটা সারেঙ্গাই বৃদ্ধের বৃক্ষপ্রেমের কথা জানে। মানেও। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট যশোর রোডের ধারের গাছকাটার ব্যাপারে যে নির্দেশ দিয়েছে, সে কথাও জানেন শ্যামাপ্রসাদ। বলছিলেন, ‘‘একটা গাছ কাটলে ওরা পাঁচটা গাছ পোঁতার কথা বলেছে। ঠিকই তো বলেছে। গাছ না থাকলে আমরা কী ভাবে বাঁচব বলো দিকি। তবে কাটার কথা বললে আমার বড্ড কষ্ট হয়। গাছ তো মা। আর আমরা ছা। এখন ছা-কে মানুষ করার পর সে যদি মা-কে কেটে ফেলে, তা হলে আঘাত পাব না? এখানেও আমাকে বিডিও আর ওসি সাহেব বললেন, গাছ কাটতে হবে, আপনি মেনে নিন। নিলাম। কিন্তু বললাম, বদলে দুটো করে গাছ লাগাতে হবে। ওঁরা মেনে নিয়েছেন।’’

গাছের প্রতি এই প্রেম এল কোথা থেকে? আট বছর বয়সে প্রথম যে গাছ পুঁতেছিলেন, সেই তালগাছের দিকে তাকিয়ে বৃদ্ধ শ্যামাপ্রসাদ ছোটবেলায় ফিরে গেলেন। বললেন, ‘‘এই গাছটার আঁটি বাবা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, এখানে পোঁতো। পুঁতে দিয়েছিলাম। তালগাছ পুঁতলে জল দিতে হয় না জানেন তো? কেবল পরিষ্কার করতে হয়। সেটাই করেছিলাম। এখন দেখুন, কত্ত বড় হয়েছে। এরও একটা গল্প আছে।’’ দাওয়ার চৌকিতে বসে বৃদ্ধ একেবারে শৈশবে ফিরে গেলেন। শোনালেন, তাঁর মা খুব ভাল তালের পিঠে তৈরি করতেন। প্রতিবেশীদের বাড়ি থেকে তাল কুড়িয়ে এনে মাকে দিতেন খুদে শ্যামা। তার পর মা সেই তালের শাঁস চালের গুঁড়োর সঙ্গে মিশিয়ে, ক্ষীরের পুর দিয়ে পিঠে বানিয়ে চিনির রসে ছাড়তেন। সুস্বাদু সেই পিঠের প্রতি শিশু শ্যামার ভীষণ লোভ ছিল। বাবা তাই তাকে নিজেদের বাড়ির উঠোনেই একটি তালগাছ পোঁতার পরামর্শ দেন। সেই গাছ পোঁতার শুরু। শ্যামাপ্রসাদের কথায়, ‘‘ছোটবেলায় পিঠে খাওয়ার লোভে একের পর এক তালগাছ পুঁতেছি যেখানে-সেখানে। তার পর জ্ঞান হওয়ার থেকে বুঝলাম, গাছ লাগানো সত্যিই ভাল। অক্সিজেনের ব্যাপারটা যখন জানলাম, সে দিন বুঝলাম, গাছ আসলে প্রাণ। গাছ লাগালে মানুষের উপকার হবে। অক্সিজেন দেবে। জীবে প্রেম করা যাবে। তাই আমি সারা জীবন গাছই লাগিয়ে যাচ্ছি।’’

সারা জীবন যত গাছ লাগিয়েছেন, তার বেশির ভাগই তাল। এ ছাড়া আম, জাম, বট, অশ্বত্থ, খেজুর, শাল, মহুয়া, নারকেল— কী নেই শ্যামাপ্রসাদের বৃক্ষভান্ডারে। গোটা ব্লক এ সব গাছেই ভরিয়ে তুলেছেন। কোনও বিশেষ প্রজাতির গাছের প্রতি তাঁর প্রেম নেই। শুধু গাছ লাগিয়েই দায় সারেন তা-ও নয়। সে গাছ বড় না হওয়া পর্যন্ত চলে পরিচর্যা। দৈনিক সকালবেলায় কোদাল ও জলের বালতি হাতে বেরিয়ে পড়েন নিয়ম করে। গাছ লাগানো, বেড়া দেওয়া, জল দেওয়া, পরিচর্যা করতে করতে বেলা গড়িয়ে যায়। বাড়ি থেকে দুপুরের খাবারের ডাক না পড়লে বিরতি দেন না। একটি পরিবেশপ্রেমী সংগঠনের কর্ণধার আশিস পাল যেমন বলছিলেন, ‘‘শ্যামাপদবাবু এক কথায় অসাধ্যসাধন করেছেন। তিনি একক প্রচেষ্টায় পাঁচ হাজারেরও বেশি গাছ লাগিয়েছেন শুধু নয়, সেগুলিকে বড় করে তুলেছেন। তাঁর কাজ দেখেই সারেঙ্গার মতো প্রত্যন্ত এলাকায় আমাদের মতো অনেকের পরিবেশের প্রতি ভালবাসা তৈরি হয়েছে।’’

photo of Shyama Prasad Banerjee, the tree lover of Bankura

পুকুরপাড় থেকে রাস্তার ধার, নিজের জমি থেকে অন্যের উঠোন— সর্বত্র গাছ পুঁতে চলেন ‘গাছদাদু’।

গাছ পোঁতার সঙ্গে সঙ্গে অন্যদেরও যাতে অর্থনৈতিক সুবিধা হয়, সে ভাবনাও রয়েছে শ্যামাপ্রসাদের। তাঁর বড় ছেলে মনোজ জানালেন, এই গাছের জন্য শ্যামাপ্রসাদ সংসারে তেমন মন না দিলেও তাঁদের আফসোস নেই। তাঁর কথায়, ‘‘বাবা এই প্রেম নিয়ে আছে বলে আজও শক্ত-সবল। এই তো মোটরসাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরল বাজার থেকে। কে বলবে, বয়স হয়েছে। মনে মনে এখনও তরুণ।’’ তিনি আরও জানান, আম, জামের চারা বাড়িতেই তৈরি করে তা অন্যের জমিতে পুঁতে দিয়ে আসেন শ্যামাপ্রসাদ। সরকারি জমির পাশাপাশি প্রতিবেশীদের জমিতেও নারকেল, বাঁশ, কলাগাছ লাগিয়েছেন। তবে বেশির ভাগই তাল গাছ। মনোজের কথায়, ‘‘অন্যের জমিতে বাবা আম, জাম, কলা, তাল আর বাঁশগাছ লাগিয়ে দিয়ে আসে কেন জানেন? যাতে তা বিক্রি করে ওদের দুটো পয়সা হয়। নিজে কিন্তু এই গাছের জন্য একটা পয়সা নেয় না।’’

প্রতিবেশীরাও শ্যামাপ্রসাদের ভূমিকায় পঞ্চমুখ। সারেঙ্গার প্রবীণ চিকিৎসক অরুণ ভট্টাচার্য যেমন বলছেন, ‘‘সারা বিশ্বের মানুষ যখন পরিবেশ ধ্বংসের খেলায় মশগুল, তখন এই বৃদ্ধ এক অন্য ভাবনায় মেতে রয়েছেন।’’ স্থানীয় ক্ষেপারপডাঙা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক পার্থ সুরাল বলেন, ‘‘গাছের প্রতি ওঁর ভালবাসার কথা জানে না তেমন লোক এই তল্লাটে নেই। ওঁর আসল নামটা অনেকেই জানেন না। তিনি এলাকায় পরিচিত গাছদাদু নামেই। সারেঙ্গা এলাকায় এমন কোনও রাস্তা বা পুকুরের পাড় নেই, যেখানে তাঁর লাগানো একটিও গাছ নেই।’’

মনোজ এবং তাঁর ভাই জগন্নাথের পরিবার প্রতিপালিত হয় চাষবাষের ভরসায়। নিজেদের মাটির বাড়ি, কিন্তু আবাস যোজনার বাড়ির জন্য আবেদনও করতে দেননি শ্যামাপ্রসাদ। তাঁর থেকে গরিব যাঁরা, তাঁদের জন্য স্বার্থত্যাগ করার পরামর্শ দিয়েছেন দুই ছেলেকে। নিজে বার্ধক্যভাতা পান বলে স্ত্রী মায়ারানির জন্য কখনও ভাতার আবেদন করতে দেননি। তাঁর কথায়, ‘‘লোকে কী বলবে বলুন তো! ভালই তো আছি। খেয়ে-পরে বেঁচে আছি। আর কী চাই!’’ মনোজরাও মেনে নিয়েছেন বাবার পরামর্শ।

নাটকের বাঞ্ছারামের এক নাতি আছে। গুপি। যে তার ‘দা-মশাই’কে নানা ভাবে বিব্রত করে, আবার তার বাগানেও থাকে বিভোর। শ্যামাপ্রসাদের ছোট নাতনি লক্ষ্মীও তার দাদুর এই বাগানের সঙ্গী। এখন তিনি নার্সিং পড়তে বেঙ্গালুরু গিয়েছেন বটে, কিন্তু সেখানে যাওয়ার আগে এবং এখন ছুটিছাটায় বাড়ি এলে দাদুর সঙ্গে গাছ পোঁতাতেই ব্যস্ত থাকেন। দাদুকে নিয়ে গর্ব তাঁর। বলছিলেন, ‘‘এলাকায় এত গাছ পুঁতেছে দাদু, আমার তো গর্ব হয় গাছদাদুর নাতনি হতে পেরে। এ বার ছুটিতে এসে আমিও অনেক গাছ পুঁতেছি। দাদুই সব ক’টার চারা দিয়েছে। বেঙ্গালুরুতে বন্ধুদের বললে, ওরা খুব অবাক হয়।’’

এ ভাবেই গাছে প্রেম করে যেই জনেরা প্রবাহিত হন এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে। সাধারণের মধ্যে বাস করে, সাধারণের এক জন হয়েও যাঁরা অ-সাধারণ হয়ে ওঠেন। অ-সাধারণ তৈরি করেন।

ছবি সৌজন্যে: লক্ষ্মী বন্দ্যোপাধ্যায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:

Share this article

CLOSE