বরফের চাঙড়ের উপর খেলছে এস্কিমো শিশুরা। আলাস্কার ‘ইউপিক’ গ্রামে। এএফপি
সুমেরুর অধিকাংশ এলাকার মতো আলাস্কাতেও গত কুড়ি বছর ধরে ধীরে ধীরে জলবায়ু পরিবর্তনের নানা প্রভাব স্পষ্ট হচ্ছে। বাতাস, জমি, নদী ও হ্রদের মিষ্টি জল, সমুদ্রের নোনা জল, সব কিছুরই তাপমাত্রা বেড়ে চলেছে। এবং প্রকৃতির এই পরিবর্তনের স্পষ্ট সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব পড়ছে আমাদের সমাজে। কী ভাবে, সেটা বোঝানোর জন্য কয়েকটা উদাহরণ দিই।
বাতাস ও সমুদ্রের তাপমাত্রা বৃদ্ধি মানেই হ্রদ এবং সমুদ্রের উপরে বরফের আস্তরণ গলতে শুরু করা। নদীর জল যদি জমে বরফ হয়ে না-যায়, এখানকার জনজাতির মানুষের শীতকালীন শিকারে বাধা পড়ে। ঠিক মতো শিকার না-হওয়া মানে পর্যাপ্ত পরিমাণ খাবার না-থাকা। এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হলে একটি গ্রামীণ জনজাতি পরিবারকে প্রয়োজনের থেকে কম খাবার খেয়ে শীতের মরসুমটা চালাতে হতে পারে।
বেশি তাপমাত্রার ফলে সমুদ্রের উপরে বরফের স্তর যথেষ্ট পুরু হচ্ছে না। যার ফলে হেমন্ত ও শীতকালে ঝড়ের প্রকোপ অনেক বেড়ে যাচ্ছে। ভাঙন ধরছে নদী ও সমুদ্রের পাড়ে। ঘরছাড়া হচ্ছেন অসংখ্য মানুষ।
গবেষণায় জানা গিয়েছে, সমুদ্রের জলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি সামুদ্রিক মাছের প্রজনন ক্ষমতার উপরে সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। পাল্টে যায় মাছেদের গতিবিধিও। এর ফলে আঞ্চলিক মাছ ব্যবসা মার খেতে শুরু করে। এ ক্ষেত্রেও করেছে।
জমির তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় জমাটবাঁধা মাটির প্রকৃতি বদলাতে শুরু করেছে। যার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে রাস্তা, বাড়িঘর এবং আরও বিভিন্ন ধরনের নির্মাণ।
উপকূলের বৃষ্টি-বনানী অঞ্চলে (হ্যাঁ, শুধু দক্ষিণ আমেরিকা নয়, আলাস্কাতেও বৃষ্টি-বনানী রয়েছে) এখানকার অনেক জনজাতির মানুষ বসবাস করেন। তাঁদের অভিজ্ঞতা বলছে, গত কয়েক বছরে সেই সব এলাকাতেও বৃষ্টিপাত অনেক কমে গিয়েছে। যার ফলে ঘাটতি দেখা দিয়েছে মিষ্টি জলের সরবরাহে। সঙ্কটে পড়ছে এলাকার বেশ কয়েকটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পও।
এ ছাড়া রয়েছে দাবানলের প্রকোপ। বিধ্বংসী আগুনে বন্যপ্রাণী মারা পড়ছে, সম্পত্তির প্রচুর ক্ষতি হচ্ছে এবং দাবানল আয়ত্তে আনতে প্রচুর অর্থব্যয় হচ্ছে সরকারের।
আলাস্কার এক ঋতু থেকে আর এক ঋতুতে আবহাওয়ায় আকাশপাতাল তফাত। শীতকালে হাড় কাঁপানো ঠান্ডা, তাপমাত্রা মাইনাস ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নীচে নেমে যায়। আবার গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশপাশে ঘোরাফেরা করে। এই ধরনের আবহাওয়াতেই যদি জলবায়ু পরিবর্তনের এতটা প্রভাব পড়ে, তা হলে আগামী দিনে সারা পৃথিবী এই পরিবর্তন আরও বেশি মাত্রায় টের পাবে বলেই আশঙ্কা পরিবেশবিজ্ঞানীদের।
আলাস্কা তো ‘পৃথিবীর শেষ সীমান্ত’। তাই জলবায়ুর পরিবর্তনের মোকাবিলা করতে আমরা সব দিক থেকে কোমর বেঁধে নেমেছি। জাতীয়, প্রাদেশিক এবং সামাজিক স্তরে বিভিন্ন কর্মসূচি নেওয়া হচ্ছে। কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক সংস্থা কড়া নজর রাখছে, যাতে মৎস্যজীবীরা মাছচাষের নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন না-করেন এবং সামুদ্রিক মাছের ভাণ্ডার নিঃশেষিত হয়ে না-যায়! এ ক্ষেত্রে আলাস্কার নিজস্ব নজরদারি ব্যবস্থাও যথেষ্ট সক্রিয়। এখানে বন্যা, ভাঙনের মোকাবিলায় এবং যথোচিত পুনর্বাসনের ব্যাপারে সব সময়ে সজাগ থাকে মার্কিন সেনাবাহিনী। কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয় হলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে সরকারের আপৎকালীন বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বন্যা, দাবানল বা তুষারঝড় অনেক বেড়ে গিয়েছে। এ ধরনের বিপর্যয় কী ভাবে রোখা যায়, তার জন্য সমানে ভাবনাচিন্তা চলছে। গবেষণা ও বিভিন্ন প্রকল্প খাতে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকার যথেষ্ট অর্থ ব্যয় করছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবিলায় অগ্রণী ভূমিকা নিচ্ছেন এখানকার বিভিন্ন জনজাতির মানুষও। তাঁদের মতো ভাল করে তো কেউ প্রকৃতিকে চেনে না!
লেখক পরিবেশবিজ্ঞানী
অনুলিখন: সীমন্তিনী গুপ্ত
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy