Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
Pakistan

ঋণের ফাঁদে ইসলামাবাদ, বন্ধুত্বের মুখোশে পাকিস্তানে লুঠ চালাচ্ছে চিন?

বিশেষজ্ঞদের মতে, পাকিস্তানকে ফাঁদে ফেলতে চিন ব্যবহার করেছে তার স্বপ্নের প্রকল্প ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’। তিনটি মহাদেশের ভেতর দিয়ে যাওয়া এই রাস্তা বানাতে পারলে নিশ্চিত ভাবেই সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভাবে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে বেজিং। সেই রাস্তার অংশই হল চিন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর।

গ্রাফিক- শৌভিক দেবনাথ।

গ্রাফিক- শৌভিক দেবনাথ।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২৭ অক্টোবর ২০১৮ ১৩:৩২
Share: Save:

পাক অর্থনীতির বুকে এখন চিনচিনে ব্যথা। ভোটে জেতার পর নিজের দেশকে যে চিনা মডেলে উন্নত করবেন বলেছিলেন ইমরান খান, সেই চিনা আগ্রাসন নিয়েই এখন উল্টো সুর গাইতে শুরু করে দিয়েছেন তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যরা। এই পরিস্থিতির জন্য সরাসরি কোনও দায় নেই ইমরানের। কিন্তু পাকিস্তানের দায়িত্ব তো এখন তাঁরই কাঁধে!

‘‘পাকিস্তানের সঙ্গে চিনের বন্ধুত্ব হিমালয়ের থেকেও উঁচু এবং আরব সাগরের থেকেও গভীর।’’ ২০১৩ সালে চিন সফরে গিয়ে নিজেদের সম্পর্ককে এভাবেই ব্যাখ্যা করে এসেছিলেন তৎকালীন পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ। কূটনৈতিক সেই সম্পর্ক আরও গভীর করতে কয়েকশো কোটি ডলারের বিনিয়োগের প্রস্তাব নিয়ে ২০১৫ সালে পাকিস্তানে গিয়েছিলেন চিনা প্রেসিডেন্ট শি চিনফিং। ইউরোপ, এশিয়া আর আফ্রিকা জুড়ে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ নামের যে রাস্তা ও রেলপথ বানানোর প্রকল্প শুরু করেছে চিন, ইসলামাবাদকে তার অংশীদার করে নিতেই ছিল এই সফর। চিন থেকে এই রাস্তা ইসলামাবাদ ও পেশোয়ার হয়ে সরাসরি পৌঁছবে গ্বাদর সমুদ্রবন্দর। নিজেদের বন্ধুত্বকে আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে জায়গা করে দিতে এই রাস্তার নাম রাখা হয়েছিল চায়না-পাকিস্তান ইকনমিক করিডর। বিশেষজ্ঞদের মতে সেই বন্ধুত্বের রাস্তাই এখন আরও ফাটল ধরিয়েছে পাক অর্থনীতিতে। বিপুল পরিমাণ ঋণের জালে জড়িয়ে পড়েছে পাকিস্তান।

কিন্তু কী ভাবে ঋণের জালে জড়িয়ে গেল পাকিস্তান?

বিশেষজ্ঞদের মতে, পাকিস্তানকে ফাঁদে ফেলতে চিন ব্যবহার করেছে তার স্বপ্নের প্রকল্প ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’। তিনটি মহাদেশের ভেতর দিয়ে যাওয়া এই রাস্তা বানাতে পারলে নিশ্চিত ভাবেই সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভাবে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে বেজিং। সেই রাস্তার অংশই হল চিন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর। এই রাস্তা তৈরি হলে পশ্চিম চিনের সঙ্গে আরব সাগর যুক্ত হয়ে যাবে। অর্থাৎ জলপথ ব্যবহারের সুযোগ পাবে চিন। তাই প্রকল্পের সিংহভাগ সুবিধেই পাবে চিন। অথচ এই প্রকল্পের টাকা চিনের কাছ থেকে ঋণ হিসেবেই নিচ্ছে পাকিস্তান। চিনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে রাস্তা বানানোর জন্য সেই টাকা পাকিস্তান আবার দিচ্ছে বিভিন্ন চিনা সংস্থাকেই। কাজে লাগানো হচ্ছে চিনা প্রযুক্তিবিদ ও শ্রমিকদেরই। অর্থাৎ টাকা ফিরে যাচ্ছে বেজিং-এ, আর ঋণের জালে জড়াচ্ছে পাকিস্তান। শুধু তাই নয়, প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিও পাকিস্তানকে সরবরাহ করছে না চিনা নির্মাণকারী সংস্থাগুলি। অর্থাৎ প্রকল্প শেষ হলে পাকিস্তানের হাতে কিছুই থাকছে না, যাতে আগামী দিনে তারা সেই প্রযুক্তি ব্যবহার করে অর্থের সংস্থান করতে পারে।

সেই আশঙ্কার কথাই এখন বলতে শুরু করেছেন পাক মন্ত্রিসভার বিভিন্ন সদস্যেরা। ফিনান্সিয়াল টাইমস-এর একটি রিপোর্টে পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী আবদুল রজ্জাক দাউদ বলেন, ‘‘আগের সরকার কিছু না বুঝেই চিনের সঙ্গে চুক্তি করে ফেলেছিল। এই চুক্তির ফলে অনেক কিছু হারাতে হচ্ছে আমাদের।’’ অর্থাৎ এই চুক্তি ঘিরে ক্ষোভ ধূমায়িত হতে শুরু করেছে পাক রাজনীতির অন্দরমহলে।

এশিয়া টাইমস-এর একটি রিপোর্টে প্রকাশ, চিন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর তৈরির প্রথম দুই বছরে বিভিন্ন চিনা যন্ত্রাংশ কিনতে যে বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ করেছে পাকিস্তান, তা তাদের কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ঘাটতি প্রায় ৫০ শতাংশ বাড়িয়ে দিয়েছে। এখন পাকিস্তানের বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার প্রায় খালি। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কে পড়ে আছে মাত্র ৮,৪০০ কোটি মার্কিন ডলার। এই টাকা দিয়ে মাত্র দু’মাসের জন্য প্রয়োজনীয় আমদানি করতে পারবে ইসলামাবাদ। তার পরই অনিশ্চিত হয়ে পড়বে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ। শুধু বিদেশি মুদ্রায় নয়, এই মুহূর্তে আকাশছোঁয়া বাণিজ্যিক ঘাটতির মুখেও পড়েছে পাকিস্তান। জুনে শেষ হওয়া অর্থবর্ষের হিসেবে— আমদানির জন্য পাকিস্তান খরচ করছে প্রায় ৬,০০০ কোটি মার্কিন ডলার। সেখানে রফতানি করে পাকিস্তানের রোজগার দাঁড়াচ্ছে মাত্র ২,৩২২ কোটি মার্কিন ডলার। এ ছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির ঋণের বোঝাও দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭,৫৩০ কোটি মার্কিন ডলারে, যা ও দেশের গড় জাতীয় উৎপাদনের প্রায় ২৭ শতাংশ।

প্রায় দেউলিয়া হয়ে যাওয়া দেশকে বাঁচাতে এখন কার্যত ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে রাস্তায় নেমেছেন পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। অথচ নির্বাচনে আসার আগে ইমরানের স্লোগান ছিল, তিনি ক্ষমতায় এলে পাকিস্তানকে টাকার জন্য ভিক্ষার ঝুলি হাতে দৌড়তে হবে না। আর ক্ষমতায় আসার পর বছর পেরোতে না পেরোতেই আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার (আইএমএফ)-এর কাছে টাকা চাওয়ার কথা জানাল পাকিস্তান। ১৯৮০ সালের পর থেকে এই নিয়ে ১৩ বার।

কিন্তু সেই রাস্তাও খুব সহজ নয়, কারণ টাকা দিলে পাকিস্তানের ওপর কড়া শর্ত চাপাবে আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলিতে বেসরকারীকরণের পথে হাঁটতে বাধ্য হবে পাক সরকার। তা করা হলে নিশ্চিত ভাবেই ছাঁটাই হবেন বিভিন্ন সংস্থার হাজার হাজার কর্মী। অসন্তোষের ঝড় উঠবে সারা দেশে। আইএমএফের কাছ থেকে টাকা চাওয়া হবে, এই খবর সামনে আসার পরই পাকিস্তানের শেয়ার বাজারে ধস নেমেছে। ডলার প্রতি পাকিস্তানি মুদ্রার বিনিময় মূল্য আরও সস্তা হয়ে ১২৫ থেকে হয়ে গিয়েছে ১৩৫। এরই মধ্যে আইএমএফের সতর্কবানী, ২০১৯-এর জুনে পাকিস্তানে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে দাঁড়াবে ১৪ শতাংশে। অর্থাৎ আরও বিপদে পড়বে পাক অর্থনীতি। যার কবলে পড়বেন দেশের অসংখ্য মানুষ। আইএমএফ টাকা দিলে তারা পাকিস্তানের কাছে সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা দাবি করবে। সেক্ষেত্রে তাদের হাতে চলে যেতে পারে চিন পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। যা কোনও ভাবেই মেনে নেবে না বেজিং।

আরও পড়ুন: সন্ত্রাসের প্রশ্নে সিরিয়ার থেকেও তিন গুণ বেশি ‘বিপজ্জনক’ পাকিস্তান

চাপে পড়ে এখন চিন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরের বরাদ্দ কমাতে শুরু করেছে পাক সরকার। সম্প্রতি ‘দ্য নিউজ’ পত্রিকাকে পাক রেলমন্ত্রী শেখ রশিদ আহমেদ জানান, ‘‘ পেশোয়ার থেকে করাচি পর্যন্ত রেলপথের খরচ ৮২০ কোটি ডলার থেকে কমিয়ে ৬২০ কোটি ডলার করা হয়েছে। আমরা গরিব দেশ, চিনের থেকে বেশি টাকা নিলে তা শোধ করতে পারব না। তাই এই সিদ্ধান্ত।’’

শুধু আইএমএফ নয়, ঋণের টাকা জোগাড় করতে সৌদি আরবের দ্বারস্থও হয়েছেন ইমরান । টাকা বিনিয়োগ করতে রাজি সৌদি, কিন্তু তার বিনিময়ে গদর বন্দরে তৈল শোধনাগার বানাতে চেয়েছে তারা। এতেও গোঁসা বেজিং-এর। কারণ, মার্কিন সহযোগী সৌদিকে কোনও ভাবেই চিন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরে চাইছে না তারা। সে ক্ষেত্রে এই রাস্তার সমস্ত খবরাখবর সরাসরি ওয়াশিংটনে চলে যাওয়ার বিপদ দেখছে চিন। এ ক্ষেত্রে চিন সামনে আনছে চুক্তির প্রাথমিক শর্তটি। যেখানে পারস্পরিক বিশ্বাসের কথাটিকেই সব থেকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু শুধুই কি পাকিস্তান? নাকি এ ভাবে ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে প্রভাব বিস্তার করা আসলে চিনা নীতিরই অংশ। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের মতে এভাবেই চিনের দেওয়া ঋণের জালে জড়িয়ে পড়েছে শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, টোঙ্গা, ভানুয়াটু-র মতো দেশ। বিশেষজ্ঞরা শি চিনফিং-এর এই কৌশলের নাম দিয়েছেন ‘ঋণ কূটনীতি’। আর সেই ফাঁদে পা দিয়েই এখন ঋণের জালে জর্জরিত চিনের সেরা ‘বন্ধু’ পাকিস্তান।

আরও পড়ুন: জোটের নাটক শ্রীলঙ্কায়, প্রধানমন্ত্রী পদে রাজাপক্ষে

অবশ্য এর জন্য ইমরানকে দায়ী করা বোধহয় ঠিক হবে না। গত কয়েক দশকের পরিস্থিতিই পাকিস্তানকে বাধ্য করেছে এই জায়গায় নিয়ে যেতে। ঐতিহাসিক ভাবেই পাকিস্তানের বরাবরের বন্ধুরাষ্ট্র ছিল আমেরিকা। কিন্তু আল কায়দা পরবর্তী মার্কিন প্রশাসন সন্ত্রাসের প্রশ্নে কড়া অবস্থান নেওয়ার পর থেকেই সেই সম্পর্কে ভাটার টান। পাকিস্তানকে দিতে থাকা বিপুল পরিমাণ মার্কিন অর্থসাহায্য বন্ধ করে দেওয়া থেকেই সঙ্কটের শুরু। একই সঙ্গে উপমহাদেশে ভারতের মধ্যে নতুন বন্ধু খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছে আমেরিকা। দীর্ঘ দিনের খারাপ সম্পর্কের পর আমেরিকার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কে অবস্থান বদলাচ্ছে ভারতও। উপমহাদেশে পাকিস্তান আর আমেরিকার একমাত্র বন্ধুদেশ নয়। শুধু আমেরিকা নয়, নয়াদিল্লির সঙ্গে ইসলামাবাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক সম্পর্কও খারাপ থেকে খারাপতর হওয়ার দিকে। এই সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছে চিন। বন্ধুর বেশে বারবার সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে তারা। সেই বন্ধুত্বের আড়ালে লুকিয়ে আছে ঋণের ফাঁদ, তা বুঝেও আসলে কিছু করার ছিল না পাকিস্তানের। কারণ, সন্ত্রাস, ভারত-বিরোধিতা ও কাশ্মীর নিয়ে যতটা উদ্যোগ দেখিয়েছে ইসলামাবাদ, তার ছিটেফোঁটাও দেশের অর্থনীতিকে মজবুত করার প্রশ্নে দেখায়নি তারা। শুধুই ঋণ নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিয়ে গিয়েছে। আর এখানেই, নতুন করে চিনা বেল্টের ফাঁসে পড়ে এখন হাঁসফাঁস করছে পাক অর্থনীতি।

গ্রাফিক- শৌভিক দেবনাথ

(আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, আন্তর্জাতিক চুক্তি, আন্তর্জাতিক বিরোধ, আন্তর্জাতিক সংঘর্ষ- সব গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক খবর জানতে চোখ রাখুন আমাদের আন্তর্জাতিক বিভাগে।)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE