Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

এক দিন মা খান, অন্য দিন মেয়ে, তীব্র খাদ্য সঙ্কটে আধপেটা ভেনেজুয়েলা

এটিএম-এ টাকা ভরার জন্য ব্যাঙ্কের যে সব অদ্ভুতদর্শন গাড়ি সশস্ত্র রক্ষী নিয়ে ঘোরে, এখন প্রায় সেই রকম গাড়িতে করেই খাবার পাঠানো হচ্ছে শহরগুলোতে। বন্দুকধারী রক্ষী ছাড়া খাবারের ট্রাক রাস্তায় নামানো যাচ্ছে না। বিভিন্ন শহরের সুপার মার্কেট ঘিরে মোতায়েন করা হয়েছে সেনা। সশস্ত্র বাহিনী ঘিরে রেখেছে বেকারিগুলো।

দোকান-বাজার থেকে খাবার লুঠ করে পালাচ্ছেন সাধারণ মানুষ।

দোকান-বাজার থেকে খাবার লুঠ করে পালাচ্ছেন সাধারণ মানুষ।

সংবাদ সংস্থা
শেষ আপডেট: ২২ জুন ২০১৬ ০২:১৫
Share: Save:

এটিএম-এ টাকা ভরার জন্য ব্যাঙ্কের যে সব অদ্ভুতদর্শন গাড়ি সশস্ত্র রক্ষী নিয়ে ঘোরে, এখন প্রায় সেই রকম গাড়িতে করেই খাবার পাঠানো হচ্ছে শহরগুলোতে। বন্দুকধারী রক্ষী ছাড়া খাবারের ট্রাক রাস্তায় নামানো যাচ্ছে না। বিভিন্ন শহরের সুপার মার্কেট ঘিরে মোতায়েন করা হয়েছে সেনা। সশস্ত্র বাহিনী ঘিরে রেখেছে বেকারিগুলো। তা সত্ত্বেও উন্মত্ত জনতা মাঝেমধ্যেই হামলে পড়ছে দোকানে, বাজারে, বেকারিতে। জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে রাবার বুলেট ছুড়তে হচ্ছে পুলিশকে। কেউ জখম হচ্ছেন, খাবার ছিনিয়ে নেওয়ার দাঙ্গায় কারও মৃত্যু হচ্ছে। তবু খাবার মিলছে না।

সোমালিয়া নয়, সম্পদের অভাবে ধুঁকতে থাকা কোনও দরিদ্রতম দেশও নয়। সবচেয়ে বেশি খনিজ তেলের মালিক যে দেশ, খাবার নিয়ে এখন সে দেশের বিভিন্ন শহরে রোজ এমন দাঙ্গা হচ্ছে।

দেশটার নাম ভেনেজুয়েলা। লাতিন আমেরিকান দেশটার মাটির নীচে যে পরিমাণ খনিজ তেল জমে রয়েছে, আরব দেশগুলিতেও তত তেল নেই। গোটা বিশ্বে তেল বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে যে রাষ্ট্রগোষ্ঠী, সেই ওপেক-এর গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ভেনেজুয়েলা। কিন্তু চূড়ান্ত আর্থিক অব্যবস্থায় তীব্র খাদ্যসঙ্কট গোটা দেশে। সাধারণ মানুষের হাতে খাবার কেনার পয়সা নেই। অধিকাংশ পরিবার এক বেলা খেয়ে কাটাচ্ছে। কোনও পরিবারে আবার খাবার পাওয়ার রুটিন তৈরি হয়েছে— এক এক জন সদস্যের জন্য এক এক দিন খাবার বরাদ্দ। অন্যদের জন্য উপোস।

গত দু’সপ্তাহে ভেনেজুয়েলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অন্তত ৫০টি দাঙ্গার খবর এসেছে। শ’য়ে শ’য়ে খাবারের দোকানে হামলা হয়েছে, সুপার মার্কেট লুঠ হয়েছে, গণ-লুঠতরাজ হয়েছে। তার সাক্ষী হয়ে রয়েছে দোকানপাটের ভাঙা দরজা, বন্ধ হয়ে যাওয়া বেকারি, সুপার মার্কেটের ফ্লোরে উল্টে পড়ে থাকা ফাঁকা শেল্ফ। দাঙ্গায়, সশস্ত্র বাহিনীর গুলিতে মৃত্যু হয়েছে অন্তত পাঁচ জনের।

বেনজির খাদ্যসঙ্কটে কাঁপছে ভেনেজুয়েলা। অভূতপূর্ব, অবিশ্বাস্য অবস্থা হুগো চাভেসের দেশে। খাবারের জন্য হাহাকার। দেশে খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত। বিদেশ থেকে আমদানি করতে হচ্ছে খাবার। তার জোগান এত কম এবং দাম এত বেশি যে সাধারণ মানুষ খাবার কিনতে পারছেন না। তাই শহরে শহরে একই ছবি। কয়েক দিন অন্তর বাজার লুঠ করার চেষ্টা। সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ। খাবার না পেয়ে মার খেয়ে বাড়ি ফেরা। আর লুঠতরাজের চেষ্টা সফল হলে বাজার থেকে আটা, ভুট্টা, নুন, চিনি, জল, আলু, আর যা কিছু হাতের কাছে পাওয়া যায়— সব কিছু লুঠ করে নিয়ে যাওয়া।

লুঠ হয়ে যাওয়া খাবারের দোকান।

যেখানে যেখানে এমন ঘটনা ঘটছে, সেই সব এলাকাতেই এখন একই ছবি। ভাঙা ফ্রিজার আর ফাঁকা শেল্ফ নিয়ে খাঁ খাঁ করছে বাজারগুলো। সরকারি ক্ষতিপূরণ না পাওয়া পর্যন্ত দোকান খুলতে রাজি নন ব্যবসায়ীরা। অনেকে দোকান খোলার মতো পরিস্থিতিতেও নেই।

কেন এই দশা ভেনেজুয়েলার? ওয়াকিবহাল মহল বলছে, চাভেসের উত্তরসূরি নিকোলাস মাদুরোর সরকার অর্থব্যবস্থাকে সামলাতেই পারেনি। ভেঙে পড়েছে অর্থনীতি। সস্তা জনপ্রিয়তা পেতে গিয়েই নাকি এই অবস্থা। ভেনেজুয়েলার রাজস্বের সিংহভাগ আসত খনিজ তেল বিক্রি করে। তেলের দাম কমিয়ে দিয়ে বিপুল রাজস্বহানি ডেকে এনেছে সরকার নিজেই। দেশে মুদ্রাস্ফীতি ক্রমশ বেড়েছে, জিনিসপত্রের দাম বাড়তেই থেকেছে। বেশ কয়েক বছর ধরে অর্থব্যবস্থা নিয়ে এমন ছিনিমিনি খেলার ফলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছে সরকারের। সারের অভাবে চাষ বন্ধ। মাইলের পর মাইল ফাঁকা পড়ে রয়েছে চাষের জমি। চিনি মিলগুলি বন্ধ। ভুট্টা, চাল-সহ যে সব শস্য এক সময় রফতানি করত ভেনেজুয়েলা, সে সব এখন আমদানি করতে হচ্ছে। কিন্তু পর্যাপ্ত পরিমাণে আমদানি করার মতো সামর্থ্যও ক্রমশ হারাচ্ছে মাদুরো সরকার। ফলে খাদ্যশস্যের অভাব দিন দিন বাড়ছে। দাম পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। যেটুকু খাবার-দাবার বাজারে এখনও মিলছে, তা সাধারণের নাগালের অনেকটা বাইরে। অঘোষিত ধর্মঘটের চেহারা যেন গোটা দেশে। অরাজকতাই যেন নিয়ম। সরকারি কলকারখানায় উৎপাদন বন্ধ। মরচে ধরছে কলকব্জায়। রোজ কয়েক যোজন করে পিছন দিকে হাঁটছে ভেনেজুয়েলার অর্থনীতি।

মাদুরো সরকারের এই ব্যর্থতার ফল কী হয়েছে? ফলটা দেখা যাচ্ছে যে কোনও পরিবারে উঁকি দিলেই।

পাঁচ শিশুর মা খাবার কেনার জন্য গোটা বাজার চষে হতোদ্যম। তাঁর সঙ্গে কথা বললে জানা যাচ্ছে, আগের দিন দুপুরে শেষ বার খেয়েছেন তিনি। এক থেকে ১১ বছর বয়সী তাঁর পাঁচ সন্তানও সেই তখনই খেয়েছে। কী খেয়েছেন তাঁরা? ওই মহিলা মাংসের দোকান থেকে মুরগির চামড়া আর ছাঁট কিনে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই চামড়া দিয়ে স্যুপ বানিয়ে খেয়েছিলেন ছ’জনে মিলে। পর দিন সেটুকুও জোগাড় হচ্ছে না।

এক পাউন্ড পাউরুটির জন্য লম্বা লাইন বেকারির দরজায়।

আর এক পরিবারে রয়েছেন শুধু মা আর মেয়ে। মা ক্যানসারের রোগী। মেয়ের ব্রেন টিউমার। অসুস্থ পরিবারটার নিত্য উপার্জন বলতে কিছুই নেই। দেশের সুসময়ে পারিবারিক পুঁজি যা কিছু জমেছিল, সেটুকুতেই মা-মেয়ের শেষ ক’টা দিন কেটে যাওয়া নিশ্চিত ছিল। এখন পরিবারটি আরও ধুঁকছে। রোজ দু’জনের খাবার জোগাড় করা সম্ভব হচ্ছে না। দু’বেলা খাওয়া তো দূরের কথা। এক জনের জন্য একবেলার মতো খাবার কোনওক্রমে জুটছে। এক দিন দুপুরে মা খাচ্ছে না। সে দিন মেয়ের উপোস। পরের দিন মেয়ে খাচ্ছেন। মায়ের উপোস করার পালা। মায়ের বয়স আর কঠিন রোগটার কথা খেয়াল রেখে অবশ্য মেয়ে একটু কৌশলী হয়েছেন। যে দিন দুপুরে খাবারের থালাটা তাঁর টেবিলে আসে, সে দিন খানিকটা খাওয়ার পর মেয়ে আজকাল বলেন, আর খেতে পারছেন না। উঠে যান থালা ছেড়ে। উচ্ছিষ্টটুকু খেয়ে নেন মা।

আরও পড়ুন: বছরের পর বছর ‘খাঁচায় আটক’ ১২ মেয়ে উদ্ধার

ভেনেজুয়েলার শিক্ষক সংগঠনের গবেষণা সংস্থা জানিয়েছে, পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি খনিজ তেল সমৃদ্ধ দেশটার ৮৭ শতাংশ মানুষ এখন বলছেন, পর্যাপ্ত খাবার কেনার পয়সা নেই। যাঁরা কোনওক্রমে খাবার জুটিয়ে দিন গুজরান করতে পারছেন, তাঁদের মাসিক উপার্জনের ৭২ শতাংশ খরচ হয়ে যাচ্ছে খিদে মেটাতে।

১৯৮৯ সালে এক বার খাদ্যসঙ্কটের মুখে পড়তে হয়েছিল ভেনেজুয়েলাকে। রাজধানী কারাকাসে দাঙ্গাও হয়েছিল। সে সময় বিরোধী তথা বামপন্থী নেতা চাভেস বলেছিলেন, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব চাই দেশে। না হলে সাধারণ মানুষের দুর্দশা ঘুচবে না। সে সময় চাভেসের উপর ভেনেজুয়েলা ভরসা করেনি ঠিকই। পরিস্থিতি সামলেও নিয়েছিল তৎকালীন সরকার। তবে বেশ কয়েক দশক পরে হলেও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির প্রয়োজনীয়তা বুঝিয়ে ভেনেজুয়েলার কর্তৃত্ব নিজের হাতে নিতে পেরেছিলেন চাভেস। কিন্তু মৃত্যুর আগে নিজের উত্তরসূরি হিসেবে যাঁকে বেছে দিয়ে গেলেন, সেই নিকোলাস মাদুরোর সরকার জরুরি অবস্থা জারি করে, পথে পথে সেনা নামিয়েও রুখতে পারছে না খাবারের জন্য শুরু হওয়া দাঙ্গা। খাদ্যসঙ্কট চিরতরে মুছে দিতে রাষ্ট্রব্যবস্থা বদলে দেওয়া ডাক দিয়েছিলেন ভেনেজুয়েলার যে বামপন্থীরা, তাঁদের রাজত্বেই এখন দেশের ইতিহাসে ভয়ঙ্করতম খাদ্যসঙ্কটের মুখে কারাকাস।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

venezuela Food Crisis Food Riot Starvation
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE