উৎকন্ঠা: কোচবিহার এমজেএন হাসপাতালে রোগীর পরিজনরা। নিজস্ব চিত্র
ক্লাসে গিয়ে সবে রোল কল শুরু করেছেন শিক্ষক। কয়েকটা নাম ডাকার পরেই তাঁকে মাঝেমধ্যে থেমে যেতে হচ্ছিল। ‘উপস্থিত’ বলার আগে কেউ খুকখুক করে কাশতে থাকে, কেউ আবার ‘ইয়েস স্যার’ বলেই লম্বা একটা হাঁচি দেয়। মাঝেমধ্যে আবার কয়েকজনের সর্দির অস্বস্তিও বেশ স্পষ্ট হয়ে যায়। আবার সেদিন ক্লাসে গরহাজির দু’জনের খোঁজ নিতে গিয়ে শিক্ষক জানতে পারেন তাদের জ্বর হয়েছে। কিন্তু আচমকা গোটা ক্লাসে সর্দি, কাশি, হাঁচির এমন প্রবণতা কেন? অভিজ্ঞ স্যারের বুঝতে অসুবিধে হয় না এ সবই আসলে ঋতু বদলের রোগ-ভোগ। প্রায় প্রতি বছরই তো বিশেষ মরসুমে প্রায় একই রকম ছবি দেখছেন তিনি। এমনটা বার্ষিক রুটিনের মতো। প্রিয় পড়ুয়াদের চিকিৎসকের কাছে পরামর্শ নিতে বলেন শিক্ষকরা। স্বাস্থ্যবিধি নিয়েও ক্লাসে আলোচনা হয়।
প্রত্যন্ত জেলার ম্যাজিক গাড়ির সিট থেকে মহানগরের মেট্রোর আসনে বসা যাত্রী— সকলের মধ্যেই এই মরসুমে খুকখুক করে কাশির ছবি দেখা যায়। নাক টানতে, নাকে ঘনঘন রুমাল চাপতে দেখা যায় অনেককেই। কারও কারও পকেটে থাকে নাক বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রতিরোধক ড্রপ কিংবা কপাল ব্যথা, মাথা ব্যথা সারানোর নানারকমের ওষুধপত্রও। তাতেও যে সব সময় চটজলদি ম্যাজিক হচ্ছে, সেই অভিজ্ঞতা অনেকেরই নেই। তবু একটা ভরসাই হোক বা সাময়িক অস্বস্তি কাটাতে ওই সব ওষুধপত্র, ড্রপ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াও মুড়ি-মুড়কির মতো ব্যবহার করেন অনেকে। ওষুধের দোকানের এক কর্মীর কথায়, প্রতি বারই তাই হয়। চিকিৎসকদের অনেকে অবশ্য বলেন, ‘‘পরামর্শ ছাড়া ওষুধ না খাওয়াই ভাল।’’ সেটা অনেকেই মানেন। ‘কুছ পরোয়া নেহি’ ভাবও আছে অনেকের। তাঁরা নিজের মতো করে চেনা ওষুধের দোকানে গিয়ে নিজের পছন্দ মতো ‘অ্যান্টিবায়োটিক’ কিনেও নিচ্ছেন।
ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পেরোতে না পেরোতেই ঋতু বদলের আমেজটা অল্প অল্প করে বোঝা যায়। চিকিৎসকদের কয়েকজন জানাচ্ছেন সর্দি, জ্বর, কাশি, গলাব্যাথার পাশাপাশি শিশুদের ‘কোল্ড ডায়ারিয়া’র প্রবণতাও শুরু হয়েছে। কোচবিহার জেলার একাধিক হাসপাতাল, নার্সিংহোম, ক্লিনিকের কথাই ধরা যাক। প্রায় দু’ সপ্তাহ ধরেই ওই সব রোগের উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসার জন্য আসা রোগীদের ভিড় হচ্ছে। এই অবস্থায় ‘ভাইরাস’ সংক্রমণের আশঙ্কা নিয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকদের অনেকে। কোচবিহার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সুপার রাজীব প্রসাদ বলেন, “তাপমাত্রার তারতম্যে ভাইরাল সংক্রমণ বাড়তে পারে। সর্দি, জ্বর, কাশির উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসার জন্য আসা রোগীর সংখ্যা গত কয়েকদিন ধরে কিছুটা বেড়েছে। কোল্ড ডায়ারিয়ার লক্ষণ নিয়ে কিছু রোগী আসছেন। নজর রাখা হচ্ছে।” একাধিক বেসরকারি ক্লিনিক থেকে চিকিৎসকদের চেম্বারের কর্তারা জানাচ্ছেন, প্রায় রোজই নতুন রোগী আসছে। তবে উদ্বেগের কিছু নেই। বেশিরভাগই তিন-চারদিনের চিকিৎসায় ওষুধ খেয়ে সুস্থও হচ্ছেন। শ্বাসকষ্ট জনিত সমস্যা ছাড়া ভর্তি করাতে হচ্ছে না। প্রেসক্রিপশন মেনে নিয়ম অনুযায়ী ওষুধ খেলেই বেশিরভাগ সুস্থ হয়ে উঠছেন। তিন, চারদিনের মধ্যে।
ছোটদের পাশাপাশি বড়রাও জ্বর, সর্দি, গলাব্যথা, জ্বরের মতো নানা সংক্রমণে আক্রান্ত হচ্ছেন। তবে কোল্ড ডায়ারিয়ার প্রকোপ মূলত দু’ বছরের কম বয়সীদের মধ্যেই বেশি। কোচবিহারের শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ গৌরপদ নায়েক বলেন, “ছোটদের জ্বর, সর্দি, শ্বাসকষ্ট জনিত সমস্যা নিয়ে চেম্বারে অনেকেই আসছেন। দিনে গড়ে ১০ জন শিশু কোল্ড ডায়ারিয়ার লক্ষণ নিয়েও আসছে। বেশিরভাগের বয়সই কিন্তু দুই বছরের নীচে। ভাইরাসের সংক্রমণের জেরেই ওই রোগ হচ্ছে।” দিনহাটা মহকুমা হাসপাতালের চিকিৎসক উজ্জ্বল আচার্য বলেন, “ভাইরাল জ্বরের লক্ষণ নিয়ে কিছু রোগী আসছেন। শীতের মরসুমে কয়েকদিন আগে আচমকা বৃষ্টিতে ভেজার জেরে বড়দের অনেকের সর্দি, কাশি, জ্বর হচ্ছে।” এই পরিস্থিতিতে কিছু সাবধানতা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা বলছেন চিকিৎসকদের অনেকে। সে সব মেনে চললে রোগ সংক্রমণের আশঙ্কা অনেকটাই এড়ানোও যেতে পারে।
কিন্তু ঋতু বদলের মরসুমে কেন এমন রোগ ভোগের প্রবণতা বেড়ে যায়? চিকিৎসকদের একাংশ বলছেন, ঋতু বদলের সময় এমনিতেই নানা রোগের ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া সক্রিয় হয়ে ওঠে। দিনের বেলায় রোদের তাপে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া, রাতে এক ধাপে পারদ অনেকটা নেমে যাওয়ায় ফারাক হচ্ছিল, ওই আবহাওয়া ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়ার প্রকোপ ছড়িয়ে পড়ার অনুকূল। তার ওপর আচমকা শীতের অকাল বৃষ্টিতে ভিজেও অনেকের সমস্যা বেড়ে গিয়েছে। কয়েকজন বাসিন্দার কথায়, দিনের বেলা চড়া রোদে বেশ গরম অনুভূত হচ্ছে। নানা কাজে বাইরে গিয়ে বা বাড়ি ফিরে তাই অনেকেই ঠান্ডা জলও খাচ্ছেন। কিছু দোকানে তো হালকা কোল্ড ডিংক্সও বিক্রি শুরু হয়েছে। সেটাও সমস্যা। কারণ সকাল, সন্ধ্যেয় কিন্তু ঠান্ডা ভাবটা বেশ ভালই বোঝা যায়। গভীর রাতে কিংবা ভোরের দিকে তাপমাত্রার পারদ আরও খানিকটা নেমে যাচ্ছে। এই তাপমাত্রার ফারাকটাই সমস্যা তো বাড়াচ্ছে।
কোচবিহারের বাসিন্দা শ্রীহরি দত্ত বলেন, “আমার ছেলেও টানা কয়েকদিন জ্বর, সর্দি, কাশিতে ভুগল। জ্বর কমলেও কাশির ভাবটা কিন্তু রয়েইছে।” শিক্ষক ইন্দ্রনীল সরকার বলেন, “ছোটদের তো বটেই অপেক্ষাকৃত বড়দের ক্লাসেও অনেকের হাঁচি, কাশি লেগে রয়েছে। ঋতু বদলের সময় আগেও হয়েছে।”
এমন ছবি অবশ্য প্রায় সবার ঘরে ঘরে। অন্য বারের থেকে এ বার উত্তরবঙ্গের কিছু এলাকায় প্রকোপটা বেশি বলেই চিকিৎসকদের একাংশের ধারণা। তাদের বক্তব্য, এতেও দায়ী আবহাওয়াই। এক চিকিৎসকের কথায়, ঋতু বদলের সময় হাঁপানির মতো রোগাক্রান্তদেরও সতর্ক থাকা দরকার। কারণ এই সময়টায় হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট জনিত রোগীদেরও নানা সমস্যা বাড়ার আশঙ্কা থাকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy