সেই শাহী স্বাদ। ছবি: শৌভিক দে।
ঘিঞ্জি রাস্তা, ধুলো আর ট্র্যাফিক জ্যামের বাইরে এ যেন অন্য মেটিয়াবুরুজ। উমদা খানার ঘি জ্যাবজেবে সুরভিতে যার পরিচয়।
আজকের আরসালান, সিরাজ, আমিনিয়া, রহমানিয়া-ময় কলকাতা সচরাচর এ তল্লাটকে মনে রাখে না। আইটি সেক্টর, শপিংমল, উড়ালপুল মুখরিত শহরে সেকেলে এই মহল্লা খানিক ব্রাত্য।
আমবাঙালির খেয়াল থাকে না, ‘মেটেবুরুজে’ই কলকাতার বিরিয়ানির আঁতুড়ঘর। এ দেশের নানা কিসিমের রসনা-বিলাসের মানচিত্রে সেই ‘বিরিয়ানিস্তান’-এর গুরুত্ব নেহাতই ফেলনা নয়। দেড় শতক আগে লখনউয়ের নির্বাসিত নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের দৌলতে যে মেটিয়াবুরুজের নাম প্রথম জেনেছিল তামাম হিন্দোস্তাঁ। একুশ শতকের কলকাতা এ বার সেই ঐতিহাসিক মহল্লার সংস্কৃতি উদ্যাপনে নেমেছে।
এ শহরে আইটিসি-গোষ্ঠীর হোটেলের এক মুখপাত্র বলছিলেন, ‘‘দেশের বিচিত্র রসনা-ঘরানা নিয়ে উৎসব ইন্ডিয়া কিচেন-এর অন্তর্গত এই মেটিয়াবুরুজ-সন্ধান।’’ হোটেলটি-র কফিশপে তাই জমে উঠেছে ‘মাটিয়াবুরুজ দাওয়াত’। হোটেল কর্তৃপক্ষের দাবি, এখানেই হদিস মিলবে খাঁটি কলকাত্তাইয়া বিরিয়ানির। লখনউয়ের নির্বাসিত নবাবের হেঁসেল থেকে যা ক্রমশ গোটা কলকাতায় ছড়িয়ে পড়েছিল।
এর আগেও বিক্ষিপ্ত ভাবে মেটিয়াবুরুজ-মহিমায় মেতেছে এ শহর। ওয়াজিদ আলি শাহের পরিবারের আওয়াধি ঘরানার রান্নার উৎকর্ষ অবশ্য ঘুরে-ফিরে দেখা দেয় এ শহরে। বাবুর্চি ইমতিয়াজ কুরেশির হাত ধরে এ ঘরানা গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে, আইটিসি-র দমপোক্ত-এর মাধ্যমে। আওয়াধি-খানা নিয়ে একটি থিম-রেস্তোরাঁও হয়েছে কলকাতায়। সেখানে খোঁজ মেলে খাঁটি ঘিয়ে জারিত আলুবিহীন লখনউয়ি তথা আওয়াধি বিরিয়ানির। তবে ওয়াজিদ আলি শাহের পরিবারের ভিতরেই বিরিয়ানির চরিত্রেরা ক্রমশ পাল্টেছে। বছরখানেক আগে ওয়াজিদ আলি শাহের পাটরানি হজরত মহলের সন্তানদের বর্তমান প্রজন্ম, মার্কুইস স্ট্রিটবাসী মনজিলাত খান তার কিছু নমুনা পেশ করেছিলেন। মনজিলাতের কথায়, ‘‘কলকাতায় থাকতে থাকতে এখন ঘিয়ের বদলে সর্ষের তেলেও দিব্যি বিরিয়ানি করি আমরা। এবং আলু ছাড়া তা মুখে রোচে না।’’ সে-বিরিয়ানি দারুণ সুস্বাদু, নির্ভার ও ঝরঝরে।
এ যাত্রায় মেটিয়াবুরুজ দাওয়াতের বিরিয়ানির কিন্তু আলাদা চরিত্র। খানিকটা স্বেদাক্ত চালে লেগে আছে মাংসের নির্যাস। মেটিয়াবুরুজের রেস্তোরাঁ শাহি মহল-এর থেকেই প্রেরণা নিয়েছে পাঁচতারা হোটেল। রূপকারও মেটেবুরুজের ভূমিপুত্র মহম্মদ মনজুর আলম। তিনি বলছিলেন, ‘‘আমার বাপ-দাদারা এই বিরিয়ানিই তৈরি করে এসেছে। কলকাতার উর্দুভাষী মুসলিম পরিবারের যে কোনও অনুষ্ঠানের সঙ্গে এ বিরিয়ানি সমার্থক।’’ শহরের মেজ-সেজ রেস্তোরাঁয় এ বিরিয়ানি ডালডার হলেও আদতে তা ঘিয়ের সৃষ্টি। এবং আলু ও ডিম এই বিরিয়ানির নিত্যসঙ্গী।
ওয়াজিদ আলি শাহের পরিবারের আর এক উত্তরপুরুষ পার্কসার্কাসবাসী শাহানশাহ মির্জা সম্প্রতি এই বিরিয়ানি চেখেছেন। তাঁদের নবাবি ঘরে ঘিয়ের বিরিয়ানিও তুলনায় ঝরঝরে। কিন্তু মেটিয়াবুরুজের স্বাদেও এক আলাদা চরিত্র তাঁর মতে। মির্জাসাহেবের স্ত্রী ফতিমা লখনউয়ের মেয়ে। তাঁর অবশ্য বিরিয়ানিতে আলু তত পছন্দ নয়। মির্জাসাহেবের আবার আলু ছাড়া বিরিয়ানি ঠিক পছন্দ হয় না।
মেটেবুরুজের অন্য বিখ্যাত, খানিক সুখা-সুখা চিকেন চাঁপ, ভেটকির টকটকে টোম্যাটো-জারিত মশলাদার টিক্কা, চিকেন রেশমি কাবাব এবং অবশ্যই মাটনের গোস্ত টিকিয়া। বিরিয়ানির সঙ্গে জমে পুদিনার ঘোল। টিকিয়ার সঙ্গতে পরোটা। পরিচিত বিরিয়ানি চেনগুলোতেও এ সব খানার দেখা মেলে। কিন্তু মেটেবুরুজ-ঘরানার রান্না অন্য রকম। জাফরানি ঘ্রাণের বাহুল্য কম। মাপা মশলার ছোঁয়াতে এক ধরনের আটপৌরে ভাব। এক ধরনের আটপৌরে স্বাদ। আজকের মেটিয়াবুরুজেও অবশ্য তা দুর্লভ। ওয়াজিদ আলি শাহের স্মৃতি-বিজড়িত অভিজাত মহল্লার সঙ্গে সংযোগের এই স্বাদসেতু।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy