অ্যান্টিবডি ভিত্তিক র্যাপিড ডায়াগনস্টিক হোম কিটের পরীক্ষা চলছে চিনের বেজিংয়ে। ছবি: এএফপি।
জনস্বাস্থ্য বিষয়ক চিকিৎসক সুবর্ণ গোস্বামীর মতে, “এই কিট ব্যবহার না হওয়া পর্যন্ত কিছুই তেমন জোর দিয়ে বলা যাবে না। তবে আশার কথা, ভারতের বেলায় এমনটা হওয়ার সুযোগ কম, কারণ ভারত হোম টেস্টিং পদ্ধতিতে এগোচ্ছে না। অ্যান্টিবডি ভিত্তিক র্যাপিড ডায়াগনিস্টিক কিট যা ভারত কিনেছে, তা পরীক্ষার দায়িত্বে থাকবেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। হটস্পট ও ক্লাস্টারগুলিতেই তার পরীক্ষা হবে।”
তা হলে কি শুধুমাত্র ঘরে ঘরে নিজেরা পরীক্ষা করিয়েছে বলেই এই কিটকাজে আসেনি আমেরিকার, বরং স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে পরীক্ষা করালেই সমাধান পাওয়া যেত?
সুবর্ণবাবুর অভিমত, বিষয়টা এত সরল নয়। যে কোনও ভাইরাস শরীরে বাসা বাঁধলে তার সঙ্গে লড়াই করার প্রাথমিক অ্যান্টিবডি তৈরি করতে শরীরের ৭-১০ দিন সময় লাগে। আবার যাঁদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল, তাদের বেলায় তা বেড়ে ১০-১২ দিনও হতে পারে। তার পর আসে মূল অ্যান্টিবডি।
যেমন, কোনও দেশে হঠাৎ বিদেশিরা আক্রমণ করলে দেশের সেনাদের কাছে যেটুকু অস্ত্রের ভাঁড়ার আছে, তা দিয়েই যুদ্ধ চালাতে হয়. তার পর আরও সংগঠিত বাহিনী আসে। প্রয়োজনীয় ছক ও পরিকল্পনা হাতে আসে। দরকারি অস্ত্রও মেলে। কিন্তু প্রাথমিক পর্যায়ে যুদ্ধটা চালাতে হয় ওই সবেধন নীলমণি হাতে থাকা বন্দুক-কামান দিয়েই। শরীরের বেলাতেও তাই। প্রাথমিক ভাবে রোগ ঠেকায় যে সব অ্যান্টিবডি তাদের বলে ইমিউনোগ্লোবিউলিন(এম)। এটা তৈরি হতেই সময় লাগে ৭-১০ দিন। তারও পরে ইমিউনোগ্লোবিউলিন জি বা ভি-রা আসে।
আরও পড়ুন: আগামী সপ্তাহেই মানবদেহে করোনার টিকার পরীক্ষা
যদি আমজনতা বাড়িতে বসে এই র্যাপিড ডায়াগনিস্টিক কিট ব্যবহার করে, তা হলে তার ধরন ও রিপোর্ট নিয়ে ধন্দে পড়ে যাওয়া স্বাভাবিক বলেই মত সুবর্ণবাবুর। সাধারণত এই র্যাপিড ডায়াগনিস্টিক কিটপজিটিভ রিপোর্ট সব ক্ষেত্রে নির্ভুল ভাবে না দিলেও নেগেটিভ রিপোর্ট বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নির্ভুল দেয়।তবে তারও কিছু ব্যতিক্রমী জায়গা আছে। যেমন:
• এই অ্যান্টিবডি ভিত্তিক র্যাপিড ডায়াগনিস্টিক কিট হয়তো কেউ রোগাক্রান্ত হওয়ার ৬ দিনের মাথায় ব্যবহার করে বসলেন। বা দুর্বল প্রতিরোধ ক্ষমতাবিশিষ্ট কেউ ৭-৮ দিনের মাথায় ব্যবহার করলেন। সে ক্ষেত্রে তো তার শরীরে কোনও ভাবেই অ্যান্টিবডিখুঁজে পাবে না। যার অর্থ, শরীরে অ্যান্টিজেনও না থাকা। কারণ ভাইরাস বা অ্যান্টিজেন থাকলে তবেই অ্যান্টিবডি মিলবে। ফলে যাঁকে নেগেটিভ বলে দেগে দেওয়া হচ্ছে, সে আর দু’দিন পরে টেস্ট করলে হয়তো পজিটিভ হতেও পারে। এমন অনেক ফ্যাক্টর এতে থাকে।
• নেগেটিভ রিপোর্ট আসামাত্র রোগী নিজেকে সুরক্ষিত ভেবে অবাধে মেলামেশা শুরু করলে তিনি ফের রোগাক্রান্ত হতে পারেন। ফলে এক বার নেগেটিভ মানেই এই নয় যে সংক্রামক ব্যক্তির সংস্পর্শে এলেও তিনি নেগেটিভই থাকবেন।
• এই টেস্টঅনেক সময়েই পজিটিভ কেস চিনতে ভুল করে। ধরা যাক, কারও ছ’মাস আগে সাধারণ জ্বর-সর্দি-কাশি হয়েছে। তার শরীরে কিন্তু অ্যান্টিবডি ইমিউনোগ্লোবিউলিন ভি রয়েই গিয়েছে। এটি তৈরি হওয়ার এক বছর অবধি উপস্থিত থাকতে পারে শরীরে। এ বার এই কিট কিন্তু পরীক্ষা করার সময় বুঝবে না, এই অ্যান্টিবডি কত দিনের পুরনো। সে শুধু অ্যান্টিবডির উপস্থিতি দেখেই জানিয়ে দেবে এঁর শরীরেও অ্যান্টিজেন নিশ্চয় এসেছে, তাই অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে। অথচ এই অ্যান্টিবডি রোগীর করোনা ঠেকাতে তৈরিই হয়নি। ফলে এমন অনেক কেসকেই এ ‘পজিটিভ’ বলে দেগে দেয়, যা আদতে ‘ফলস পজিটিভ’।তখন পিসিআর পরীক্ষা করে দেখতে হবে আদৌ রোগী পজিটিভ কি না।
• এই টেস্ট করার পর তাই নেগেটিভ এলেও যেমন চূড়ান্ত নিশ্চয়তা নেই, তেমন পজিটিভ এলেও তা চূড়ান্ত রিপোর্টনয়। নেগেটিভ এলে তাকেও কিছু দিন বাদে আর এক বার র্যাপিড ডায়াগনিস্টিক কিট দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া ভাল। এবং তিনি যাতে হোম কোয়রান্টাইনেই থাকেন, লকডাউন ভেঙে অবাধ মেলামেশা না শুরু করেন সে দিকেও নজর রাখতে হবে। নইলে কিন্তু রোগী বা বাহকের সংস্পর্শে এলে তিনি আবার আক্রান্ত হতে পারেন। পজিটিভ এলেও তাঁকে পলিমারেস চেন রিঅ্যাকশন (পিসিআর) করে দেখতে হবে, তিনি সত্যিই পজিটিভ কি না।
• সম্প্রতি এমন অনেক কেস দেখা যাচ্ছে, যেখানে এই রোগের লক্ষণ কারও শরীরে সে ভাবে প্রকাশ পাচ্ছেই না। নিজেও অসুস্থ হচ্ছেন না তিনি। কিন্তু বাহক হয়ে অজান্তেই রোগ ছড়িয়ে বেড়াচ্ছেন। এঁদের বেলাতেও অ্যান্টিবডি ভিত্তিক র্যাপিড ডায়াগনিস্টিক কিট শরীরে অ্যান্টিবডি আছে জানিয়ে দেবে। ফলে এত দিন যিনি সুস্থ ছিলেন তাঁকেও ফের পিসিআর পরীক্ষা করে, পজিটিভ এলে আলাদা করে সরিয়ে কোয়রান্টাইনে রাখতে হবে। সাধারণত দেখা যাচ্ছে, যাঁরা বাহক, তাঁদের আলাদা করে চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না। এক মাস পর তাঁদের শরীর থেকে এই বাহক হওয়ার প্রবণতা সেরে যেতে থাকে আপনিই।
আরও পড়ুন: করোনার হানা, প্যাঙ্গোলিনের প্রতিশোধ নয় তো?