Advertisement
E-Paper

অনর্গল গ্রিন টি খেলে হিতে কিন্তু বিপরীত

পঞ্চাশোর্ধ্ব মহিলার কিডনির কিছু সমস্যা রয়েছে। নির্দিষ্ট সময় অন্তর ডাক্তারের কাছে যেতে হয়। ওষুধপত্র খেয়ে ঠিকঠাকই ছিলেন। হঠাৎই এক দিন পরীক্ষা করে দেখা গেল, তাঁর ক্রিয়েটিনিন এক ধাক্কায় অনেকটা বেড়ে গিয়েছে। কী ভাবে এমন হল?

সোমা মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৫ জুন ২০১৬ ০৩:৪৪

পঞ্চাশোর্ধ্ব মহিলার কিডনির কিছু সমস্যা রয়েছে। নির্দিষ্ট সময় অন্তর ডাক্তারের কাছে যেতে হয়। ওষুধপত্র খেয়ে ঠিকঠাকই ছিলেন। হঠাৎই এক দিন পরীক্ষা করে দেখা গেল, তাঁর ক্রিয়েটিনিন এক ধাক্কায় অনেকটা বেড়ে গিয়েছে। কী ভাবে এমন হল? শহরের নামী নেফ্রোলজিস্ট কোনও ব্যাখ্যাই খুঁজে পাচ্ছিলেন না। মহিলার দৈনন্দিন রুটিন নিয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেল, গত এক মাস ধরে দিনে একাধিক বার গ্রিন টি খাচ্ছেন তিনি! তৎক্ষণাৎ তা বন্ধ করার নির্দেশ দিলেন ডাক্তারবাবু। কিছু দিন পর পরীক্ষা করে দেখা গেল, ক্রিয়েটিনিন আবার আগের জায়গায় ফিরেছে।

তা হলে কি গ্রিন টি উপকারের বদলে অপকার করছে বহু ক্ষেত্রে? চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, তা নয়। গ্রিন টি-র প্রচুর উপকারের দিক রয়েছে। কিন্তু সেটাকে ঘিরে কিছু মানুষের অত্যুৎসাহই বিপদ ডেকে আনছে। কোলেস্টরল কমানো থেকে শুরু করে ত্বকের তারুণ্য ধরে রাখা— এমন হরেক সুফলের কথা শুনে অনেকেই দিনে অজস্র বার গ্রিন টি খাচ্ছেন। তাতেই হিতে বিপরীত।

চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, সাধারণ ভাবে গ্রিন টি মেদ কমাতে সাহায্য করে। কোষের মৃত্যু ঠেকায়। শরীরে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। কোলেস্টেরল কমায়। দাঁতের স্বাস্থ্য ভাল রাখে। মস্তিষ্কের কোষের মৃত্যু ঠেকানোর কাজ করে। নষ্ট হওয়া কোষের পুনরুজ্জীবনের চেষ্টা করে। অ্যালঝাইমার্স ও পারকিনসন্স রোগের ঝুঁকি কমায়। ত্বক ভাল রাখে। মানসিক চাপ কমায়। তালিকাটা এখানেই শেষ নয়। কোষের অনিয়ন্ত্রিত সংখ্যাবৃদ্ধি ক্যানসারের কারণ। এ ক্ষেত্রে কোষকে সুরক্ষা দেয় অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট। গ্রিন টি সেই অ্যান্টি-অক্সিড্যান্টের কাজটা করে।

তা বলে কি যখন-তখন গ্রিন টি খাওয়া যায়? বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, কোনও কিছুই অতিরিক্ত খাওয়া ভাল নয়। তাই কোনটি কার ক্ষেত্রে উপকারী, আর কোনটি নয় জেনে নিয়ে খাওয়াই ভাল। যেমন, কলকাতার ইনস্টিটিউট অব হাইজিন অ্যান্ড পাবলিক হেলথ-এর এক বিজ্ঞানী জানালেন, অনেকেই সকালে উঠে গ্রিন টি-র কাপ নিয়ে বসেন। ভাবেন তাতে স্বাস্থ্যরক্ষা হবে। কিন্তু আদতে কখনওই খালি পেটে গ্রিন টি খাওয়া উচিত নয়। সব সময় খাওয়ার পরে খাওয়া উচিত। খালি পেটে গ্রিন টি খেলে পাকস্থলীতে অ্যাসিড ক্ষরণ হয়ে আলসারের ভয় থাকে। অন্তঃসত্ত্বা থাকাকালীনও এই চা খেতে বারণ করা হয়। কারণ এতে গর্ভস্থ শিশুর মস্তিষ্কে এবং মেরুদণ্ডে কিছু ত্রুটি দেখা দেওয়ার ঝুঁকি থাকে।

গত কয়েক বছরে গ্রিন টি খাওয়াটা এক ধরনের ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। বাড়িতে, অফিসে, রেস্তোঁরায় সাধারণ চায়ের বদলে গ্রিন টি-ই পছন্দ করেন অনেকে। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, কিডনির কোনও সমস্যা না থাকলে দিনে ভরাপেটে বড়জোর দু’কাপ গ্রিন টি খাওয়া যেতে পারে। তার বেশি কোনও ভাবেই নয়।

কিডনির সমস্যা থাকলে খাওয়া যাবে না কেন? নেফ্রোলজিস্ট অভিজিৎ তরফদারের বক্তব্য, ‘‘অতিরিক্ত গ্রিন টি খেয়ে ক্রিয়েটিনিন বেড়ে যায় অনেকের। কিডনির স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা কমে যায়। কারও কারও রেনাল ফেলিওর-ও হয়। আমার কাছে কিডনির রোগী এলে আমি প্রথমেই এখন জেনে নিই গ্রিন টি খান কি না।’’

সরকারি হাসপাতালের আউটডোরেও এমন রোগী আকছার পাওয়া যাচ্ছে, না বুঝে-শুনে অতিরিক্ত গ্রিন টি সেবন যাঁদের ক্ষতি ডেকে আনছে। যেহেতু সমস্যার উৎসটা চেনা নয়, তাই ধরা পড়তে সময় লাগছে। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদার যেমন জানালেন, গ্রিন টি বহু সময়েই ‘ওয়ারফেরিন মেটাবলিজম’-এ বাধা হয়ে দাঁড়ায়। অর্থাৎ বেশি গ্রিন টি খেলে রক্ত পাতলা হওয়ার ওষুধ শরীরে কম কাজ করে।

কী ভাবে? বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, ওয়ারফেরিন হল এমন ধরনের ওষুধ যা রক্তকে পাতলা করে। গ্রিন টি-তে থাকা একটি উপাদান শরীরে ওয়ারফেরিনের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়। ফলে রক্ত পাতলা থাকে না। এর জেরে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোকের ঝুঁকি কিছুটা বেড়ে যায়। অরুণাংশুবাবু এও বলেন, ‘‘অতিরিক্ত গ্রিন টি খেলে শরীরে আয়রন গ্রহণ ও আয়রনের মিশে যাওয়ার ক্ষমতা কমে। এ দেশে বেশিরভাগ মানুষের শরীরেই আয়রনের ঘাটতি। অ্যানিমিয়া রুখতে সরকারি তরফে আয়রন ট্যাবলেটও বিলি হয়। কিন্তু অনেকেই জানেন না অতিরিক্ত গ্রিন টি খেলে শরীরে রক্তাল্পতার ভয় থাকে। হাজার আয়রন ক্যাপসুলও তা দূর করতে পারবে না।’’

একাধিক আন্তর্জাতিক গবেষণাপত্রে ইতিমধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে যে ভিটামিন বি-১২ শরীরে মিশে যাওয়ার ক্ষেত্রেও সমস্যা তৈরি করতে পারে গ্রিন টি। পলিফেনল-এর মতো অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট শরীরে ভিটামিন ও মিনারেল গ্রহণের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। গ্রিন টি-তে ট্যানিন নামে একটি উপাদান থাকে যা খাবার থেকে আয়রন গ্রহণে বাধা দেয়।

আয়ুর্বেদ চিকিৎসকরাও জানাচ্ছেন, তাঁদের কাছে আসা অনেক রোগীই এমন কিছু উপসর্গের শিকার, যার উৎস আদতে গ্রিন টি। আয়ুর্বেদ চিকিৎসক অমলকান্তি ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘ফ্যাট কমানোর জন্য অনেকেই এখন খাচ্ছেন। কিন্তু প্রতি দিন ছ’সাত কাপ গ্রিন টি খেলে কোনও লোকের শরীরেই তা সহ্য হওয়ার কথা নয়। গ্রিন টি প্রস্রাবের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। বারবার অতিরিক্ত পরিমাণে প্রস্রাব হলে কিডনির ক্ষতি হতে বাধ্য।’’

অতএব, সাধু সাবধান। উৎসাহে লাগাম না পরালে অমৃত ভেবে খাওয়া তরল গরল হয়ে উঠতে পারে।

green tea
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy