ডাঁটায় ভরেছে সজনে গাছ। ছবি: উদিত সিংহ
বাঙালির চিরকালীন খাদ্যতালিকার একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদ হল ডাঁটা। বাঙালির রসনায় এই আনাজটি আবহমানকাল ধরে কদর পেয়েছে। বাঙালি সমাজে মূলত মরসুমি ফসল হিসেবেই এর গুরুত্ব। প্রধানত শীত শেষের কয়েক মাস ধরে নানা ধরনের তরকারিতে সজনে ডাঁটা ব্যবহার করা হয়।
তবে ইদানীং সজনে ডাঁটার পুষ্টিগুণ, উপকারিতা নিয়ে চর্চা অনেকটাই বেড়েছে। খানিকটা সেই জন্যই এই আনাজটিকে স্কুলের মিড-ডে মিল ও অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে শিশুদের খাদ্যতালিকার অন্তর্ভুক্ত করার দাবিও উঠছে।
কিন্তু এ ক্ষেত্রে প্রথমেই প্রশ্ন জাগে এত আনাজ থাকতে সজনে ডাঁটার উপরেই আজকের পুষ্টিবিজ্ঞানীরা এত গুরুত্ব দিচ্ছেন কেন? কেনই বা একে ‘আধুনিক সময়ের বিষমুক্ত ও পুষ্টিকর আনাজ’ বলে অভিহিত করা হচ্ছে? এর প্রধান কারণ হল সজনে ডাঁটা চাষের সময় অধিকাংশ জায়গায় কোনও প্রকারের ‘কীটনাশক’ ব্যবহার করা হয় না। ফলে অন্য ফসলগুলির ক্ষেত্রে যেখানে কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ ফসলে থেকে যায় এবং খাবারের মাধ্যমে মানব দেহে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে সেখানে এই ফসলটি সম্পূর্ণ বিপদমুক্ত। তারই সঙ্গে পুষ্টিবিজ্ঞানীরা বলে থাকেন, শ্বেতসার বা কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাট, ভিটামিন ও খনিজ লবণের মতো সুষম খাদ্য উপাদানগুলি সজনে ডাঁটায় পুরোমাত্রায় উপস্থিত থাকে। ডাঁটা ছাড়াও সজনে গাছের ফুল, বীজ, ছাল, আঠা, তেল প্রভৃতি অংশগুলিও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, প্রতি ১০০ গ্রাম সজনে ডাঁটায় ৩০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ১১০ মিলিগ্রাম ফসফরাস, ৫.৩ মিলিগ্রাম আয়রন, ১.৮ মিলিগ্রাম কপার থাকে। সজনে গাছের পাতার ক্ষেত্রে ১০০ গ্রাম পাতায় ৪৪০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ৭০ মিলিগ্রাম ফসফরাস, ৭০ মিলিগ্রাম আয়রন এবং সাত মিলিগ্রাম কপার থাকে।
পুষ্টিবিজ্ঞানীরা বলেন, সজনে গাছের পাতা ও বীজ আটটি প্রয়োজনীয় অ্যামাইনো অ্যাসিড-সহ প্রচুর পরিমাণ প্রোটিনের ধারক। সজনে ডাঁটার দ্রাব্য ও অদ্রাব্য ফাইবার ইরিটেবল বাওয়েল রোগে যথেষ্ট কার্যকরী ভূমিকা নেয় বলে মনে করেন পুষ্টিবিজ্ঞানীরা। পুষ্টি বিজ্ঞানীরা বলেন, গোটা বিশ্বে যে সব গাছে সর্বোচ্চ মাত্রায় প্রোটিন রয়েছে তাদের তালিকার এক দম উপরের দিকেই সজনেকে রাখা হয়ে থাকে। সজনে পাতায় থাকা ক্যালসিয়াম বহু ক্ষেত্রে জীবনদায়ী ওষুধ হিসেবে কাজ করে।
পাতা এবং ডাঁটার পাশাপাশি সজনে গাছের শিকড়, কাণ্ড, গাছের ছাল, আঠা, পাতা পরিণত ফুল, পরিণত বীজ, বীজ থেকে প্রাপ্ত তেল প্রভৃতিতে ডিম্যানোজ, ডি-গ্লুকোজ, অ্যাসকরবিক অ্যাসিড, বিটা সিস্টোটেরল, বিটা ক্যারোটিন, ভ্যালনিনের মতো নানা ফাইটো কেমিক্যাল থাকে। রোগ নিয়ন্ত্রণে এদের ভূমিকা অপরিসীম। সজনের পাতায় থাকা খাদ্য উপাদানগুলি মাথা ব্যথা, টিউমার, কৃমি, চোখ ও কানের যন্ত্রণা, ব্রঙ্কাইটিস, স্কার্ভি ইত্যাদি রোগ সারাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে থাকে। সজনে ফুলের উপাদানগুলি টিউমার ও প্লীহার বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করে। আবার উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণেও সজনে গাছের মূল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।
শুধু পুষ্টিগুণই নয়, সজনে গাছের বিভিন্ন উপাদানের অর্থকরী গুরুত্বও যথেষ্ট। এই উপাদানগুলির মধ্যে সজনের তেল সুগন্ধী তৈরিতে কাজে লাগানোর বিষয়ে গবেষণা চলছে। সজনের পাতা থেঁতো করে ঘরদোর পরিষ্কারের কাজে এবং বায়োগ্যাসের মতো সামগ্রী উৎপাদনের কাজে লাগানো হচ্ছে। সজনে কাঠের চূর্ণীকৃত মণ্ড থেকে বিভিন্ন ধরনের কাগজ প্রস্তুত করা হয়। উন্নমানের পিউরিফায়ার ব্যবহারের যুগেও আফ্রিকা মহাদেশের বেশ কয়েকটি দেশে সজনের বীজ জল পরিশোধনের কাজে লাগানো হয়ে থাকে।
‘গ্লোবাল নিউট্রিশন রিপোর্ট’-এর একটি সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে আফ্রিকা ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে অপুষ্টিই হল সব থেকে বড় সমস্যা। অপুষ্টির কারণেই জন্মের সময় শিশুর ওজন কম হওয়া, মা ও শিশুর রক্তাল্পতা, শৈশবেই চর্মরোগের প্রকোপে দূর্বল দৃষ্টিশক্তি, মানসিক বৃদ্ধি না হওয়ার মতো ঘটনা ঘটে চলেছে। ভারতের ক্ষেত্রে পরিস্থিতিটা আরও ভয়াবহ। ২০১৫-১৬ সালে ‘চতুর্থ জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা’-র রিপোর্টে দেখা গিয়েছে দেশের ৫৩ শতাংশ মহিলাই রক্তাল্পতায় ভুগছেন। ‘বিশ্ব পুষ্টি প্রতিবেদন’ অনুসারে গোটা বিশ্বের ৫১ শতাংশ মহিলা রক্তাল্পতায় ভুগছেন। এই পরিবেশ থেকে বেরিয়ে আসতে হলে পুষ্টিকর খাদ্য খাওয়াই একমাত্র সমাধান।
সেই কারণেই সহজে উৎপন্ন হওয়া এবং সুলভে পাওয়া যায় এমন আনাজ হিসেবে সজনে ডাঁটার গুরুত্ব দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সজনে ডাঁটার পুষ্টিগুণ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা চালাচ্ছে ‘ট্রিজ ফর লাইফ’, ‘চার্চ ওয়ার্ল্ড সার্ভিস’ এবং ‘এডুকেশনাল কনসার্নস, ফর হাঙ্গার’-এর মতো তিনটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। সাধারণত সজনের চাষের জন্য ২৫ থেকে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা আদর্শ। সজনের চাষের জন্য বার্ষিক ২৫০- ১৫০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের দরকার। বেলেমাটিতেও সজনের চাষ ভাল হয়। সজনে চাষের জমিতে যথার্থ জল নিকাশি ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন।
বর্তমান সমীক্ষা বলছে, দক্ষিণাঞ্চল-সহ ভারতের বিভিন্ন এলাকায় সজনে চাষের পরিধি দিনে দিনে বাড়ছে। অন্ধ্রপ্রদেশে সজনের চাষ ও উৎপাদন সবথেকে বেশি। ফি-বছর ভারতে ১.১ থেকে ১.৩ মিলিয়ন টন সজনে উৎপন্ন হচ্ছে।
ভারতের পাশাপাশি পাকিস্তান, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ-সহ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন এলাকায় চাষের পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। অপুষ্টির সমস্যা দূর করতে এই সব দেশেও সজনের চাষ ধীরে ধীরে গুরুত্ব পেতে শুরু করেছে। এরই পাশাপাশি, আমেরিকা, শ্রীলঙ্কা, মেক্সিকো, মালয়েশিয়া ও ফিলিপিন্স দ্বীপপুঞ্জে বাণিজ্যিকভিত্তিতে সজনে চাষের চেষ্টাও চলছে। আশা করাই যায় মিড-ডে মিল, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের রান্নার পদে এই পুষ্টিকর খাদ্যটির অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে আমাদের চেনা পরিচিত অপুষ্টিতে ভোগা হাড়জিড়জিড়ে শিশুদের ছবিতে বদল আসবে।
বর্ধমানের চিকিৎসক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy