Advertisement
২১ মে ২০২৪
সরকারি চিকিৎসার ভগ্ন স্বাস্থ্য: দুই চিত্র

শিশুদের জরুরি অস্ত্রোপচার বন্ধ শহরের পাঁচ হাসপাতালে

শিশুদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে বড় সঙ্কটের মুখে শহর। বিধানচন্দ্র রায় শিশু হাসপাতাল-সহ কলকাতার পাঁচটি বড় সরকারি হাসপাতালে শিশুদের জরুরি অস্ত্রোপচার বন্ধ। এই অবস্থায় ভরসা একমাত্র নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল (এন আর এস)। কিন্তু রোগীর চাপে তাদের এখন নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়। এমন গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবায় এই অচলাবস্থা কবে মিটবে, তার কোনও নিশ্চয়তাও নেই।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০১৪ ০২:২৫
Share: Save:

শিশুদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে বড় সঙ্কটের মুখে শহর। বিধানচন্দ্র রায় শিশু হাসপাতাল-সহ কলকাতার পাঁচটি বড় সরকারি হাসপাতালে শিশুদের জরুরি অস্ত্রোপচার বন্ধ। এই অবস্থায় ভরসা একমাত্র নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল (এন আর এস)। কিন্তু রোগীর চাপে তাদের এখন নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়। এমন গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবায় এই অচলাবস্থা কবে মিটবে, তার কোনও নিশ্চয়তাও নেই।

কুড়ি দিনের বেশি হতে চলল রাজ্যে শিশুদের চিকিৎসার একমাত্র ‘রেফারাল ইনস্টিটিউট’, বেলেঘাটার বিধানচন্দ্র রায় শিশু হাসপাতালে জরুরি অস্ত্রোপচার বন্ধ। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এবং আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেও শিশুদের প্রায় কোনও জরুরি অস্ত্রোপচারই হচ্ছে না। এমনকী, সুপার স্পেশ্যালিটি এসএসকেএম হাসপাতালের মেন অপারেশন থিয়েটারও গত ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে ৭ অক্টোবর পর্যন্ত জীবাণু-নিরোধক কর্মসূচির জন্য বন্ধ থাকায় সেখানে জরুরি অস্ত্রোপচার প্রায় হয়ইনি। এই সব হাসপাতাল থেকে একের পর এক শিশুকে জরুরি অস্ত্রোপচারের জন্য এন আর এসে ‘রেফার’ করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

এই ভাবে রেফারের ঢল নামায় এন আর এসের পেডিয়াট্রিক সার্জারি বিভাগের নাভিশ্বাস ওঠার অবস্থা। দিন কয়েক আগেই বিভাগের চিকিৎসকেরা স্বাস্থ্য ভবনে স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে গিয়ে তাঁদের অবস্থার কথা জানিয়ে এসেছেন। তাঁদের কথায়, এক-এক দিনে ছ’-সাতটি করে জরুরি অস্ত্রোপচার এবং অন্তত পাঁচ-ছ’টি সাধারণ অস্ত্রোপচার করা তাঁদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওই বিভাগের এক চিকিৎসক বলেন, “জরুরি অস্ত্রোপচারের চাপে আমরা আউটডোর করতে পারছি না, ছাত্রদের পড়াতে পারছি না। পাহাড়প্রমাণ ইমার্জেন্সি কেস রেফার হওয়ায় অস্ত্রোপচারের মান এবং অস্ত্রোপচার-পরবর্তী রোগী পরিচর্যার মানও তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। এতে ক্ষতি হচ্ছে অসুস্থ শিশুদেরই।” এর মধ্যে এন আর এসে শিশুদের তিনটি ভেন্টিলেটরের মধ্যে দু’টি অকেজো হয়ে পড়ায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে।

এখানেই শেষ নয়। চিকিৎসকদের আক্ষেপ, এমন অনেক ইমার্জেন্সি কেস রেফার হয়ে আসছে, যেগুলি তৎক্ষণাৎ অস্ত্রোপচার না করলে শিশুটির প্রাণসংশয় হতে পারে। তা সত্ত্বেও ভিড়ের জন্য তাদেরও অপেক্ষায় রাখতে হচ্ছে। এন আর এসের চিকিৎসকেরা জানান, ধরা যাক কোনও শিশু খেলতে গিয়ে মারাত্মক জখম হয়েছে বা পথ দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়েছে। অথবা কোনও শিশুর হার্নিয়া ভয়াবহ আকার নিয়েছে বা অ্যাপেন্ডিসাইটিস শেষ পর্যায়ে পৌঁছেছে। সেই সমস্ত শিশুকে নিয়ে বাড়ির লোক হন্যে হয়ে বি সি রায়, ন্যাশনাল, আর জি কর ঘুরেও ভর্তি করতে পারেননি। তার পরে এন আর এসে এসেও অস্ত্রোপচারের জন্য তাঁদের অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে। স্বভাবত রোগীর অবস্থা খারাপ হচ্ছে। বাড়ির লোকও ধৈর্য হারাচ্ছেন আর সেই বিরূপ পরিস্থিতি চিকিৎসকদের সামলাতে হচ্ছে।

কলকাতার অধিকাংশ নামী সরকারি হাসপাতালে শিশুদের জরুরি অস্ত্রোপচার বন্ধ কেন? বি সি রায় শিশু হাসপাতালের অধ্যক্ষ মালা ভট্টাচার্য জানান, তাঁদের ওখানে পেডিয়াট্রিক সার্জারিতে তিন জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছিলেন। এক জন ইস্তফা দিয়েছেন। আর এক জনকে ‘মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া’র পরিদর্শন উপলক্ষে বহরমপুর হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন রয়েছেন মাত্র এক জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং দু’জন রেসিডেন্সিয়াল মেডিক্যাল অফিসার। ছ’দিন আউটডোর চালিয়ে তাঁরা আর কোনও জরুরি অস্ত্রোপচার করতে পারছেন না। মালাদেবীর কথায়, “আমরা অসহায়। স্বাস্থ্য ভবনকেও বারংবার জানিয়েছি। কোনও ইমার্জেন্সি কেস করতে পারছি না। পেডিয়াট্রিক সার্জারির ৬০টি শয্যায় মাত্র তিন-চার জন ভর্তি রয়েছে।”

ন্যাশনাল মেডিক্যালের সুপার পীতবরণ চক্রবর্তী জানান, তাঁদের মাত্র দু’জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন পেডিয়াট্রিক সার্জারিতে। কোনও আর এম ও নেই। এত কম সংখ্যক চিকিৎসক দিয়ে জরুরি পরিষেবা চালানো যাচ্ছে না। তাই শিশুদের ইমার্জেন্সি অপারেশনের কেস এলে তাঁরা বাধ্য হয়ে এন আর এসে রেফার করছেন। আর জি কর হাসপাতালের অধ্যক্ষ শুদ্ধোদন বটব্যালের বক্তব্য, পরিকাঠামো ও যন্ত্রপাতি নেই বলে হাসপাতালে শিশুদের কোনও বড় ধরনের জরুরি অস্ত্রোপচার তাঁরা করতে পারছেন না। মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষও জানান, তিন জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দিয়ে ছ’দিন আউটডোর চালিয়ে তার পরে শিশুদের জরুরি অস্ত্রোপচার করা অসম্ভব।

রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়কে এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “রোজই এক কথা বলেন কেন? জানেনই তো, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কম আছে। রাতারাতি তা পাওয়াও যাবে না। কোনও ম্যাজিক হবে না। যেমন চলছে, তেমনই চলবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE