শীতে বাগানপ্রেমীরা ব্যস্ত তাঁদের কিচেন গার্ডেন সাজাতে। পছন্দের পালংশাক, ধনেপাতা, টম্যাটোর সঙ্গে এই মরসুমে জুড়ে নিতে পারেন মাশরুম বা ছত্রাক। মাশরুম চাষের জন্য না লাগে মাটি, না লাগে রোদ। বরং অন্ধকার ও কিছুটা স্যাঁতসেতে জায়গা হলেই ভাল। চাষের খরচ নামমাত্র। দেখভালেও বিস্তর সময় দিতে হয় না। অথচ মাশরুমের উপকার অনেক। তাই সামান্য যত্নেই যদি নিজের বাগানে ফলানো যায় মাশরুম, মন্দ কী?
করোনাকালে চিকিৎসকেরা পরামর্শ দিচ্ছেন হাই প্রোটিনযুক্ত ডায়েটের। মাশরুম হাই প্রোটিনযুক্ত। হজম হয় তাড়াতাড়ি। প্রোটিন ছাড়াও এতে আছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ও খনিজপদার্থ। বিশেষ করে মধুমেহ, রক্তাল্পতা, ওবেসিটিতে যাঁরা ভুগছেন, তাঁদের জন্য উপকারী। স্মৃতিশক্তি বাড়াতে, ত্বক সজীব রাখতে, হাড় শক্ত রাখতেও মাশরুমের জুড়ি মেলা ভার। সুস্বাদু ও খাদ্যগুণ বেশি হওয়ায় গোটা বিশ্বে মাশরুমের জনপ্রিয়তা এখন তুঙ্গে। আর এখন তা অনেক বেশি সহজলভ্যও বটে। হালে মাশরুম নিয়ে হইচই হলেও এর কিন্তু বহু পুরনো ইতিহাস রয়েছে। জাপানে এবং চিনে দীর্ঘ সময় ধরেই ওষুধ তৈরির জন্য মাশরুম ব্যবহার করা হয়। প্রায় সাড়ে তিনশো বছরেরও বেশি সময় আগে প্যারিসে এক তরমুজ চাষী প্রথম মাশরুম চাষ শুরু করেন। তার থেকে গোটা ইউরোপে এবং পরে আমেরিকায় মাশরুম উৎপাদন ছড়িয়ে পড়ে। গত শতকের চল্লিশের দশকে ভারতে চেন্নাইতে প্রথম মাশরুম চাষ করার চিন্তাভাবনা শুরু হয়। কিন্তু আজও এ দেশে মাশরুম খাওয়ার উপকারিতা নিয়ে সচেতনতা ও প্রচার বেশ কম!
পৃথিবী জুড়ে চাষ করা হয় নানা জাতের মাশরুম। তবে আমাদের রাজ্যের আবহাওয়ায় এবং তুলনামূলক সহজ পদ্ধতিতে ঘরে ফলানোর জন্য উপযুক্ত অয়েস্টার, মিল্কি, প্যাডি স্ট্র জাতীয় মাশরুম। অয়েস্টার মাশরুম ফলানোর পক্ষে আবার শীতকাল উপযুক্ত। বাকি দুটোর উপযুক্ত সময় মার্চের পর থেকে, যখন ঠান্ডা কমে যায়। আর এই মাশরুম চাষ কিন্তু বিশেষ কঠিন নয়।
• অয়েস্টার মাশরুম চাষের উপকরণ: প্রধানত তিনটি উপকরণ দরকার এই ধরনের মাশরুম চাষ করার জন্য —
১) স্পন (spawn) বা মাশরুমের বীজ
২) খড়
৩) পলিথিনের ব্যাগ
চাষের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী পাওয়া যায় এমন দোকানে, মাশরুম প্রশিক্ষণকেন্দ্রে এবং অনলাইন শপিং সাইট থেকে মাশরুমের বীজ কিনতে পাওয়া যাবে। বাকি উপকরণগুলিও সহজে জোগাড় করা কিন্তু মোটেই কঠিন নয়।
• পদ্ধতি: চাষের জন্য প্রথমে আধ থেকে এক ইঞ্চি মাপের খড় কেটে জীবাণুমুক্ত করার জন্য ফুটন্ত গরম জলে প্রায় ২০ মিনিট ফুটিয়ে নিন অথবা ব্লিচিং পাউডার ও চুন মেশানো পরিষ্কার জলে ২৪ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখুন। ফোটানো বা ভেজানোর পরে জল এমন ভাবে ঝরিয়ে নেবেন, যাতে হাত দিয়ে খড় চাপলে জল না পড়ে অথচ হাতে একটা ভেজা ভাব থাকবে। এর পর একটি পলিব্যাগের মধ্যে দু’ইঞ্চি পুরু করে খড় বিছিয়ে তার উপর ব্যাগের ধার ঘেঁষে বীজ ছড়িয়ে দিতে হবে। বীজের উপরে আবার খড় ও খড়ের উপর আবার বীজ, এই ভাবে প্রায় সাত-আটটা স্তর তৈরি করে পলিব্যাগের মুখ কয়েকটা প্যাঁচ দিয়ে কষে বন্ধ করে দিন। খড় বিছানোর সময় প্রতি বার হাত দিয়ে ভাল করে চেপে দিন, যাতে খড়ের ভিতর হাওয়া জমে না থাকে। এর পরে প্যাকেটে দশ থেকে বারোটা ছোট ছোট ছিদ্র করে তুলো দিয়ে ছিদ্রের মুখ বন্ধ করে দিলে স্বাভাবিক হাওয়া চলাচল বজায় থাকবে, আবার তুলো থাকায় ধুলোও ঢুকতে পারবে না। প্যাকেটটি সাত থেকে দশ দিনের জন্য কোনও অন্ধকার জায়গায় রেখে দিন। খেয়াল রাখবেন, অন্ধকার হলেও জায়গাটিতে যেন হাওয়া চলাচল করে। জায়গাটি যাতে পরিষ্কার ও পোকামাকড়মুক্ত থাকে, সে খেয়ালও রাখতে হবে। মাছি কিন্তু মাশরুম চাষে ভয়ানক ক্ষতি করে।
কয়েক দিনের মধ্যেই সেই প্যাকেটে বীজের জায়গায় সাদা আস্তরণ দেখা দেবে, যাকে মাইসেলিয়াম বলে। অল্প ক’দিনের মধ্যে পুরো ব্যাগটাই মাইসেলিয়ামে ভরে গেলে তুলো সরিয়ে ফেলে আরও কয়েকটি ছিদ্র করে ব্যাগটিকে কিছুটা আলোর মধ্যে রাখতে হবে। তবে সরাসরি রোদে নয়, ঘরের ভিতর যেটুকু আলোয় বই পড়া যায়, তেমন আলোয়। বাতাসে আর্দ্রতা বুঝে প্রয়োজন মাফিক প্যাকেটের উপরে মাঝে মাঝে জল স্প্রে করবেন। এর কয়েক দিনের মধ্যেই ছিদ্র দিয়ে মাশরুমের পিনহেড উঁকি দেবে। সাধারণত পঁচিশ থেকে তিরিশ দিনের মধ্যে মাশরুম খাওয়ার মতো পরিণত হয়ে যায়। একটি ব্যাগ থেকে তিনবার ফলন পাওয়া যায়। তাজা মাশরুম খাওয়ার পাশাপাশি অতিরিক্ত মাশরুম রোদে শুকিয়েও স্টোর করে রেখে দিতে পারেন। শুকনো মাশরুম রান্নার আগে গরম জলে নুন দিয়ে ফুটিয়ে নিলেই হল।
সতর্কীকরণ
পুকুর পাড়ে, জঙ্গল বা অজানা জায়গায় জন্মানো মাশরুম কখনও খাওয়া উচিত নয়। অজান্তে বিষাক্ত মাশরুম খেয়ে ফেললে তা বিপজ্জনক হতে পারে। তাই বাজারের পরিচিত দোকান থেকে কিনে বা নিজের চাষ করা মাশরুম খাওয়া নিরাপদ।
রান্নায় মাশরুম দিয়ে খেলে স্বাদ আর পুষ্টি দুই-ই বাড়বে। আর মাশরুম রান্না করারও খুব একটা ঝামেলা নেই। সামান্য তেলে সতে করে উপরে গোলমরিচ ও নুন ছড়িয়ে, স্যালাডে বা পছন্দসই সস দিয়ে টস করেও খেতে পারেন। এর স্বাদ এমন যে, ভারতীয়, চাইনিজ় থেকে শুরু করে কন্টিনেন্টাল পদেও মাশরুম ব্যবহার করা যায়।
তবে যে-কোনও ধরনের মাশরুম চাষ শুরু করার আগে পদ্ধতি ও উপকরণ সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা দরকার। না হলে মাশরুমের ফলন ঠিকমতো হবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy