হাজিরা খাতা পরীক্ষা করছেন মহকুমাশাসক।
জেলায় বন্যার কবলে বেশ কয়েকটি ব্লক। বিভিন্ন দফতরের সরকারি আধিকারিকদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বিষ্ণুপুর জেলা হাসপাতালে মঙ্গলবার রাতে হঠাৎ পরিদর্শনে গিয়ে একের পর এক অফিসে তালা ঝুলতে দেখে তাজ্জব হয়ে গেলে মহকুমাশাসক পলাশ সেনগুপ্ত। গোটা হাসপাতাল ঢুঁ মেরে দেখা পেলেন একজন মাত্র চিকিৎসকের। তাঁর ভরসাতেই রয়েছে হাসপাতালের সমস্ত রোগী! অফিস থেকে আবাসন খুঁজেও সে রাতে দেখা মেলেনি হাসপাতাল সুপারের।
বিষ্ণুপুর যখন মহকুমা হাসপাতাল ছিল, তখনও এখানকার অব্যবস্থা নিয়ে ভূরি ভূরি অভিযোগ উঠেছে। তৃণমূল সরকার রাজ্যের ক্ষমতায় আসার পরে বিষ্ণুপুরকে জেলা হাসপাতালের স্বীকৃতি দেওয়ার পরে বাসিন্দারা ভেবেছিলেন এ বার বোধহয় হাল বদলাবে। কিন্তু তা যে নয়, তা গত কয়েকবছরে তাঁরা হাড়ে হা়ড়ে বুঝেছেন। তাঁদের অভিযোগ, রুগ্ন মানুষকে নতুন পোশাক পরালে যেমন তাঁকে সুস্থ বলা যায় না, তেমনই অবস্থা এই হাসপাতালের। রোগ আসলে এখানকার রন্ধ্রে রন্ধ্রে। কর্মসংস্কৃতি বদলাতে গেলে হাসপাতালের প্রশাসক থেকে চিকিৎসক, নার্স থেকে স্বাস্থ্যকর্মী সবার মনোভাবের বদল দরকার। এ নিয়ে সম্প্রতি রোগীদের তরফে বেশ কিছু অভিযোগ জমা পড়ে সুপার ও মহকুমাশাসকের কাছে। সম্প্রতি এক অসুস্থ সদ্যোজাতকে ‘সুস্থ’ বলে ছেড়ে দেওয়ার পরে বাড়িতে তার মৃত্যু হয়। সেই ঘটনার জেরে হাসপাতালে বিক্ষোভ হয়। কলকাতা থেকে স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তা পরিদর্শনে এলে তাঁর কাছেও ক্ষোভ জানান ওই শিশুর পরিবার।
এরপরেই মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টায় মহকুমাশাসকের হঠাৎ-পরিদর্শন। তিনি ওই হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যানও বটে। তিনি এসেছেন খবর পেয়ে হাসপাতালে আসেন রোগী কল্যাণ সমিতির সদস্য তথা বিষ্ণুপুরের কাউন্সিলর দিব্যেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁরা গিয়ে দেখেন, সুপার তাঁর অফিসে নেই। দরজায় তালা ঝুলছে। নেই ওয়ার্ড মাস্টার। তার অফিসেও তালা। খবর পেয়ে দৌড়ে এসে ওয়ার্ড মাস্টার সুপারের অফিসের তালা খুলে দেন। সুপারের খোঁজে তাঁর কোয়ার্টারে যান মহকুমাশাসক। দরজার বাইরে থেকে তিনি ডাকাডাকি করেন। ঘুম ঘুম চোখে সুপারের কোয়ার্টারের দরজা খোলেন অন্য এক চিকিৎসক। জানতে চাওয়া হয়, তিনি সেখানে কেন? ওই মেডিক্যাল অফিসার শেখ আব্বাসুদ্দিন মহকুমা শাসককে জানান, সুপার সেখানে নেই। সুপার তাঁকে সেখানে থাকার অর্ডার দিয়েছেন। তিনি অনুমতিপত্রও দেখান। হতভম্ব মহকুমাশাসক প্রশ্ন করেন, “এমন অর্ডার তিনি দিতে পারেন না কি? তাহলে তিনি থাকছেন কোথায়?” উত্তর না পেয়ে তাঁরা খোঁজ নিয়ে দেখেন হাসপাতালের কোথাও সুপার নেই।
জরুরি বিভাগেও একই ছবি। ঘর ফাঁকা। জরুরি বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসক (ইএমও) কোথায়? খোঁজ নিয়ে তাঁরা জানতে পারেন তিনি নাকি রাউন্ডে গিয়েছেন। খবর পেয়ে দৌড়ে আসেন ওই ইএমও সৈকত চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “আমি একা। সব দিক সামলাতে হচ্ছে।” মহকুমা শাসকের প্রশ্ন— “তাহলে জরুরি বিভাগে রোগী এসে দাঁড়িয়ে থাকবেন? আর কেউ ডিউটিতে নেই? অবাক ব্যাপার!” তাঁরা জরুরি বিভাগে কবে কোন চিকিৎসকের থাকার কথা সেই তালিকা খুঁটিয়ে দেখেন।
মহকুমাশাসক সুপারের চেম্বারে বসে একের পর এক কর্মীদের ডেকে পাঠান। খাতাপত্রও নিয়ে আসতে বলেন। তিনি খাতাপত্র দেখেন। তাঁকে দেখে এগিয়ে আসেন এক রোগীর আত্মীয়। তিনি বলেন, “স্যার, এত বড় হাসপাতাল। কিন্তু গ্যাসের একটাও ট্যাবলেট নেই। সেটাও বাইরে থেকে কিনে আনার জন্য লিখে দিয়েছে।” কিন্তু ওষুধের তালিকা দেখতে গিয়ে আরও অবাক হওয়া অপেক্ষা করছিল ওই পরিদর্শকদের। তাঁদের অনেকে জানান, কর্মীরা দেড় ঘণ্টার চেষ্টাতেও বোঝাতে পারলেন না কী আছে, কী নেই। খাতায় অনিয়মের চূড়ান্ত। বিরক্ত মহকুমাশাসকের কাছে তখনই প্রসূতি বিভাগের এক মহিলার আত্মীয় অভিযোগ করেন, “স্যার, স্যালাইনে রক্ত যাচ্ছে। আয়ারা বলছেন, পাল্টে দিলে ১০০ টাকা লাগবে। এ দিকে নার্সদের পাওয়া যাচ্ছে না। কী করব?” দিব্যেন্দুবাবু মহকুমাশাসকের কাছে দাবি করেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী ঠিকমতো ওষুধের জোগান দিচ্ছেন। ডাক্তারও পাঠাচ্ছেন। কিন্তু ওষুধ নিয়ে দুর্নীতি হচ্ছে। ডাক্তাররা হাসপাতালে না বসে চেম্বারে প্রাক্টিস করছেন, ওষুধ কোম্পনির গাড়িতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সুপার থাকছেন না। মেদিনীপুর থেকে তিনি আসা-যাওয়া করেন। ফলে এই অব্যবস্থা।’’ মহকুমাশাসকের সামনেই দেখা যায়, হাসপাতালে আসা রোগীদের স্ট্রেচারে শুইয়ে নিয়ে যাচ্ছেন রোগীর বাড়িরই লোকজন। যাঁদের সে কাজ করার কথা, তাঁদের পাত্তা নেই। পরে হাসপাতালের কিছু খাতা সঙ্গে নিয়ে হাসপাতাল ছাড়েন মহকুমাশাসক।
কেমন দেখলেন হাসপাতালের অবস্থা? বুধবার মহকুমাশাসক বলেন, “আমি রাতে প্রায় ঘণ্টা তিনেক ছিলাম। প্রচুর অভিযোগ পেয়েছি। বিশেষ করে সুপারের বিরুদ্ধে। তিনি না কি নিয়মিত আসেন না। রাতে থাকেন না। এখন যখন বন্যাজনিত কারণে আধিকারিকদের ছুটি বাতিল হয়েছে, তখনও তাঁকে হাসপাতালে বা তাঁর কোয়ার্টারে পাওয়া গেল না!’’ তিনি জানান, এই হাসপাতালে প্রায় ৩৮ জন ডাক্তার রয়েছেন। অথচ মঙ্গলবার রাতে গিয়ে দেখা গেল মোটে একজনকে। প্রায় ৭৫ জন নার্স থাকার কথা, কিন্তু রাতে ডিউটিতে দেখা গেল ১০/১১ জনকে! মহকুমাশাসক বলেন, ‘‘আমি কিছু খাতাপত্র নিয়ে এসেছি। জেলাশাসকের কাছে এই অনিয়মের বিস্তারিত রিপোর্ট পাঠাব।”
তবে বিষয়টি হজম করতে পারছেন না হাসপাতালের সুপার সুভাষচন্দ্র সাহা। তিনি বলেন, “উনি আমাকে না জানিয়েই ভিজিটে এসেছিলেন। কিছু জরুরি খাতাপত্রও নিয়ে গিয়েছেন। এটা উনি ঠিক করেননি। আমি তাঁর বিরুদ্ধে সিএম ওএইচকে জানিয়েছি। প্রয়োজনে থানায় অভিযোগ করব।” যদিও বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত বিষ্ণুপুর থানায় এই মর্মে কোনও অভিযাগ দায়ের হয়নি। মঙ্গলবার রাতে তিনি কোথায় ছিলেন? তাঁর দাবি, ‘‘আমি বিষ্ণুপুর শহর থেকে খুব একটা দূরে ছিলাম না।’’
কিন্তু নিজের কোয়ার্টারে থাকেন না কেন? সুপারের যুক্তি, ‘‘মহকুমা হাসপাতাল থাকার সময় যে কোয়ার্টারে ছিলাম, জেলা হাসপাতালের পরে সেখানেই কেন থাকব? আমার জন্য ভাল কোয়ার্টার বরাদ্দ হচ্ছে। তা না হওয়া পর্যন্ত বাইরেই থাকছি।’’ তবে বিষ্ণুপুর স্বাস্থ্য জেলার সিএমওএইচ অরবিন্দ সরকার বলেছেন, “মহকুমাশাসক এই মহকুমা প্রশাসনের কর্তা। তিনি তদন্তে যেতেই পারেন। সুপার আমাকে মৌখিক ভাবে ঘটনাটি জানিয়েছেন। খোঁজ নিচ্ছি ঠিক কী হয়েছে।”
মঙ্গলবার রাতে ছবি দু’টি তুলেছেন শুভ্র মিত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy