এত দিন সে এগিয়েছে ধীরে ধীরে। কিন্তু এ বার গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছে। রীতিমতো দাঁত-নখ বার করে প্রবল পরাক্রমে ভারতে ঝাঁপিয়ে পড়তে চলেছে প্রস্টেট ক্যানসার।
এবং এতটাই দাপট নিয়ে যে, আগামী পাঁচ বছরে এ দেশের পুরুষদের মধ্যে ওই রোগে আক্রান্তের হার অন্তত ৪৮% বেড়ে যাবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে নয়াদিল্লি। কলকাতাও বিলক্ষণ বিপদের সামনে। কারণ, দেশের যে সব শহরে প্রস্টেট ক্যানসার বেলাগাম হওয়ার আশঙ্কা, সেই তালিকায় গোড়ার দিকে রয়েছে এ শহরের নাম!
গত ২২ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত স্বাস্থ্য মন্ত্রকের ‘ন্যাশনাল হেল্থ প্রোফাইল ২০১৫’ শীর্ষক রিপোর্টের এই তথ্য স্বাস্থ্য-নীতি নির্ধারকদের নাড়িয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি এত কম সময়ে প্রস্টেট ক্যানসারের এ হেন অভূতপূর্ব বাড়বাড়ন্তের ইঙ্গিত পেয়ে ডাক্তারেরা প্রমাদ গুনছেন। কলকাতার চিকিৎসক মহলও উদ্বিগ্ন। কেন?
কারণ, জাতীয় ক্যানসার রেজিস্ট্রি অনুযায়ী, দেশের কয়েকটি বড় শহরে প্রস্টেট ক্যানসারের হার এমনিতেই গড়ের তুলনায় বেশি। শহরগুলো হল: দিল্লি, কলকাতা, পুণে ও তিরুঅনন্তপুরম। এদের মধ্যে আবার আক্রান্তের হার-বিচারে কলকাতা শীর্ষে। সরকারি তথ্য বলছে, ২০০৯-১০ সালে কলকাতায় পুরুষদের মধ্যে প্রস্টেট ক্যানসারে আক্রান্তের হার ছিল ৭.৫%। আগামী পাঁচ বছরে এটা প্রায় ৫০% বাড়তে পারে জেনে স্বভাবতই অশনি সঙ্কেত দেখছেন শহরের চিকিৎসকেরা। সঙ্কটের পিছনে জীবনযাত্রার ধরণ ও অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভাসের ভূমিকাকে যেমন তাঁরা দায়ী করছেন, তেমন আঙুল উঠছে সচেতনতার অভাব ও প্রচারের ঘাটতির দিকে।
বস্তুত কিছু বছর আগে পর্যন্ত ধারণা ছিল, অষ্ট্রেলিয়া- নিউজিল্যান্ড, ইউরোপ ও মার্কিন মুলুকেই প্রস্টেট ক্যানসার হয় বেশি। ওই তল্লাটে আক্রান্তের হার প্রতি এক লাখ পুরুষে প্রায় ১০৪ জন। ভারতে যা ছিল সাকুল্যে ৯ জন।
এই অবস্থা থেকেই আচমকা এ দেশে আগ্রাসী হয়ে উঠেছে প্রস্টেট ক্যানসার। সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতীয় পুরুষদের সবচেয়ে বেশি হয় লিভারের ক্যানসার। আগামী পাঁচ বছরে এটি ৩১% বাড়তে পারে। পুরুষদের মধ্যে ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্তের হার ২২% বৃদ্ধির সম্ভাবনা। তবে আগ্রাসনের তীব্রতার নিরিখে সবাইকে টেক্কা দেবে প্রস্টেট ক্যানসার।
অথচ বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য প্রশাসনের অপ্রস্তুত চেহারাটাই প্রকট। ‘‘আমরা জানতাম, পুরুষদের মুখ, ফুসফুস বা লিভারের ক্যানসার বেশি হয়। তাই সরকারি প্রচার-নীতির কেন্দ্রে এগুলোকেই রাখা হয়েছিল। প্রস্টেট ক্যানসারের ব্যাপারটা সরকারের কাছে পুরোপুরি ধাক্কা।’’— স্বীকার করছেন মন্ত্রকের ক্যানসার বিভাগের এক সচিব। তাঁর আক্ষেপ, ‘‘প্রস্টেট ক্যানসার সম্পর্কে সরকারের না-আছে কোনও নীতি, না আছে সরকারি স্তরে স্ক্রিনিংয়ের কোনও ব্যবস্থা।’’
সর্বস্তরে সচেতনতা প্রসারের উদ্যোগে ঘাটতি দেখে খেদ করছেন ডাক্তারেরাও। প্রস্টেট ক্যানসার নিয়ে দীর্ঘ দিন কাজ করা ইউরোলজিস্ট অমিত ঘোষের কথায়, ‘‘আমি বহু দিন ধরে বলে আসছি, রোগটা বাড়ছে। তাই বয়স পঁয়তাল্লিশ পেরোলেই ছেলেদের রুটিন পিএসএ (প্রস্টেট স্পেসিফিক অ্যান্টিজেন) টেস্ট করাতে হবে। কেউ কান দিচ্ছিলেন না। এখন টনক নড়েছে!’’ অমিতবাবুর মতে, পঞ্চাশের পরে প্রস্টেট ক্যানসারের আশঙ্কা বিস্তর বেড়ে যায়। এখন মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে, তাই আক্রান্তের সংখ্যাও বাড়ছে। রোগের নেপথ্যে আধুনিক জীবনযাত্রা ও পরিবর্তিত খাদ্যাভাসের বড় ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
অন্য দিকে ইউরোলজিস্ট সত্যদীপ মুখোপাধ্যায় জানান, ইদানীং তাঁরা তুলনায় অল্পবয়সী (৪৫-৫০) অনেক প্রস্টেট ক্যানসার রোগী পাচ্ছেন। চিকিৎসাশাস্ত্র উন্নত হয়েছে। উপরন্তু একটি শ্রেণির মধ্যে সচেতনতা এসেছে, তাঁরা রুটিন হেল্থ চেকআপ করাচ্ছেন। এতে অনেকের প্রাথমিক অবস্থায় রোগ ধরা পড়ছে। ইউরোলজিস্ট অনুপ কুণ্ডু বলেন, ‘‘ফি সপ্তাহে দু’-এক জন প্রস্টেট ক্যানসারের পেশেন্ট পাচ্ছি। রোগটা প্রায়শই কিছু জানান দেয় না। ধরা পড়ে একেবারে শেষ পর্যায়ে। তখন কিছু করার থাকে না।’’
তাই রক্ষাকবচ হিসেবে নিয়মিত রেক্টাল এক্সামিনেশন এবং তার পরে পিএসএ পরীক্ষায় জোর দিচ্ছেন চিকিৎসকেরা। এ-ও জানাচ্ছেন, প্রথম অবস্থায় ধরা পড়লে প্রস্টেট ক্যানসার পুরোপুরি সারিয়ে তোলা সম্ভব।
দিল্লির হুঁশিয়ারি শুনে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের কী প্রতিক্রিয়া?
রাজ্যের স্বাস্থ্য-অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী বলেন, ‘‘কেন্দ্রের ওই রিপোর্ট আমাদের হাতে এসে পৌঁছয়নি। প্রস্টেট ক্যানসারের স্ক্রিনিং নিয়ে এখনও আমাদের আলাদা পরিকল্পনা নেই। তবে সরকারি হাসপাতালে ক্যানসারের যাবতীয় চিকিৎসা নিখরচায় পাওয়া যাবে।’’
অতএব, রোগীর সংখ্যা বাড়লেও সরকারি স্তরে চিকিৎসা পেতে কোনও অসুবিধে হবে না বলে আশ্বাস দিচ্ছেন অধিকর্তা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy