Advertisement
১১ মে ২০২৪

প্রাণঘাতী হতে পারে দ্বিতীয় সংক্রমণ

এক বারের সংক্রমণে শরীর তেমন ধাক্কা না খেলেও দ্বিতীয় বারের ডেঙ্গি সংক্রমণ কিন্তু প্রাণঘাতী হতে পারে। একই প্রজাতির ডেঙ্গি খুব দ্রুত নিজেদের চরিত্র বদলে ফেলায় রক্ত কোষ তাদের ঠিকমতো চিনতে পারছে না।

দেবদূত ঘোষঠাকুর
কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:১৬
Share: Save:

এক বারের সংক্রমণে শরীর তেমন ধাক্কা না খেলেও দ্বিতীয় বারের ডেঙ্গি সংক্রমণ কিন্তু প্রাণঘাতী হতে পারে।

একই প্রজাতির ডেঙ্গি খুব দ্রুত নিজেদের চরিত্র বদলে ফেলায় রক্ত কোষ তাদের ঠিকমতো চিনতে পারছে না। ফলে প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি হওয়ার আগেই নতুন জিনগত চরিত্রের ডেঙ্গি ভাইরাস অতিসক্রিয় হয়ে উঠছে। রক্তরসের মধ্যে ঢুকে তা রক্তের কোষগুলিকে দ্রুত ফাটিয়ে দিয়ে মৃত্যু ডেকে আনছে বলে পরজীবী বিজ্ঞানীদের দাবি।

যেখানে বার বার করে ডেঙ্গির সংক্রমণ হচ্ছে সেখানেই এই ধরনের দ্বিতীয় সংক্রমণে মৃত্যুহার বাড়ছে— মত পরজীবী বিজ্ঞানীদের। প্রথমবার সংক্রমণের আপাত নিরীহ জীবাণু পরবর্তী সংক্রমণের সময়ে এমন ভাবে নিজেদের জিনগত চরিত্র বদলে ফেলছে যে তাতে একদিকে উপসর্গ পাল্টে যাচ্ছে। পাশাপাশি ওই নতুন প্রজাতির জীবাণুর বিরুদ্ধে দেহের ল়ড়াই করার শক্তিও বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। কারণ নতুন করে অ্যান্টিবডি তৈরি করতে হচ্ছে শরীরকে। সেই সুযোগে নয়া প্রজাতির জীবাণু রক্তের কোষগুলিকে নষ্ট করে দিচ্ছে। ডেঙ্গির দ্বিতীয় সংক্রমণে এ ভাবেই বাড়ছে মৃত্যুর আশঙ্কা।

প্রকৃতিতে চার প্রজাতির ডেঙ্গি ভাইরাস রয়েছে। পরজীবী বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, ভাইরাসের বাইরের দেওয়ালে অ্যামাইনো অ্যাসিডের তারতম্যের নিরিখেই চারটি বিভিন্ন প্রজাতির ডেঙ্গি ভাইরাসকে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু গোল বেধেছে প্রতিটি প্রজাতির ভাইরাসের মধ্যে আবার একাধিক শ্রেণি তৈরি হওয়ায়। প্রতিকূল পরিবেশে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনে প্রতি প্রজাতির ডেঙ্গি ভাইরাস ছদ্মবেশ নিচ্ছে। সেই ছদ্মবেশ চিনতে পারছে না রক্ত। যখন চিনতে পারছে তত ক্ষণে সেই জীবাণু রক্তে নিজের কাজ শুরু করে দিয়েছে।

পরজীবী বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, যে কোনও জিনিস বাইরে থেকে শরীরে ঢুকলে কোষ তার পরিচয় যাচাই করে নেয়। ভাইরাস বা ব্যাক্টেরিয়ার মতো প্রোটিনঘটিত কোনও বাইরের জিনিস কোষে ঢুকলে তাকে বলে অ্যান্টিজেন। কোষের মধ্যে কোনও অ্যান্টিজেন ঢুকলে তার প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় নির্দিষ্ট অ্যান্টিবডি। ওই অ্যান্টিবডি বাইরে থেকে ঢোকা অ্যান্টিজেনকে ঠেকাতে তার সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করে। তাতে অ্যান্টিবডির হার হলে ওই অ্যান্টিজেন বা বাইরের জিনিস অর্থাৎ রোগজীবাণু কোষের ক্ষতি করে। যদি এক সঙ্গে অনেক অ্যান্টিজেন ঢুকে পড়ে তা হলে তাদের সঙ্গে তাল রেখে সমপরিমাণ অ্যান্টিবডি তৈরি হতে পারে না। ফলে আক্রান্ত ব্যক্তির শারীরিক অবস্থা খারাপ হতে শুরু করে।

কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্থা ন্যাশনাল ইনস্টটিউট অব কলেরা অ্যান্ড এন্টেরিক ডিজিজ-এর ভাইরোলজিস্ট প্রভাসচন্দ্র সাধুখাঁ বলেন, ‘‘ডেঙ্গির চারটি প্রজাতির মধ্যে প্রথম সংক্রমণে যেটি শরীরে ঢোকে, সেটিকে পরবর্তীকালে রোধ করার জন্য তৈরি হয় অ্যান্টিবডি। কিন্তু দ্বিতীয় সংক্রমণে অন্য যে কোনও প্রজাতির ভাইরাস ঢুকলে তাকে প্রথম সংক্রমণে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডিটি চিনতে পারে না। ফলে নতুন ভাইরাস নিজের কাজটা করে যায়। দেখা যায় দ্বিতীয় সংক্রমণে হেমারেজিক ডেঙ্গির প্রবণতা অনেক বেশি। হেমারেজিক ডেঙ্গিতেই প্রধানত মানুষের মৃত্যু হয়।’’

স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের ভূতপূর্ব অধিকর্তা পতঙ্গবিদ অমিয় হাটি প্রভাসবাবুর মতকে সমর্থন করে বলেছেন, ‘‘প্রথম বার যে ডেঙ্গি ভাইরাসের সংক্রমণ হয়েছিল, সেটিই যদি দ্বিতীয় বার একই মানুষের শরীরে প্রবেশ করে, তা হলে সেটা রোগীর তেমন কোনও ক্ষতি করতে পারে না। কিন্তু দ্বিতীয় সংক্রমণে অন্য প্রজাতি যদি প্রবেশ করে, তা হলেই যত গোলমাল। কারণ প্রথম সংক্রমণে তৈরি হওয়া প্রতিরোধব্যবস্থা দ্বিতীয় সংক্রমণে ঢোকা ভাইরাসকে শনাক্ত করতে পারে না। সব তালগোল পাকিয়ে যায়। সেই সুযোগটাই কাজে লাগায় নতুন ভাইরাসটি।’’

পরজীবী বিজ্ঞানীদের অনেকে আবার বলছেন, একই প্রজাতির ভাইরাস দ্বিতীয় বার যখন শরীরে প্রবেশ করে, তখনও দেখা যায় আগের বার তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডিটি তাকেও চিনতে পারে না। এমন কেন হয়?

পরজীবী বিজ্ঞানীদের কেউ কেউ আবার বলছেন, দ্বিতীয় বার ঢোকা অচেনা ভাইরাসটিকে পুরোপুরি চিনতে না পারলেও আগের সংক্রমণে তৈরি হওয়া অ্যন্টিবডি তাকে সহজে ঢুকতে দেয় না। সেটি নতুন প্রজাতির ভাইরাস বা নতুন অ্যান্টিজেনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। সেটা হিতে বিপরীত হয়। স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের অন্য প্রাক্তন অধিকর্তা পরজীবী বিজ্ঞানী অমিতাভ নন্দীর ব্যাখ্যা, ‘‘একই প্রজাতির ভাইরাস প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করার জন্য প্রতিনিয়ত নিজেদের জিনগত পরিবর্তন ঘটিয়ে চলছে। সুতরাং একই প্রজাতির মধ্যেই একাধিক উপজাতি তৈরি হওয়ায় প্রথম অ্যান্টিবডিটি নতুন ভাইরাসটিকে চিনতে পারে না। তাতেই গন্ডগোল হয়।’’

অমিতাভবাবু বলেন, ‘‘পুরনো অ্যান্টিবডিটি নতুন উপজাতি চিনতে না পারলেও তাকে সহজে যেতে দেয় না। বরং তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। এই প্রক্রিয়ায় জটিলতা বাড়ে। হিতে বিপরীত হয়। রক্তকোষগুলিকে ফাটিয়ে দেয় ওই জটিল অ্যান্টিজেন-অ্যান্টিবডির সংযোজন। রোগীর শরীরের ভিতরে রক্তপাত শুরু হয়ে যায়, এক সময়ে তার মৃত্যু পর্যন্ত হয়।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE