রাজেন্দ্রনাথ পাণ্ডে। এসএসকেএম-এর নেফ্রোলজির বিভাগীয় প্রধান।
নামজাদা সরকারি হাসপাতালের নামজাদা নেফ্রোলজিস্ট তিনি। তাঁকে এক বারটি দেখানোর জন্য ফি সোমবার ভিড় উপচে পড়ে আউটডোরে। দূর-দূরান্ত থেকে রোগীরা আসেন। ভোর থেকে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট করান। কিন্তু ডাক্তারবাবু কই?
অভিযোগ, কার্যত আউটডোরে তাঁর দেখাই মেলে না! হাসপাতাল-সূত্রের খবর: এ জন্য কর্তৃপক্ষের তরফে ওঁকে কারণ দর্শাতেও বলা হয়েছিল। জবাবে ডাক্তারবাবু সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, খোদ মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে তাঁকে অন্য বহু কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। তাই আউটডোরে সময় দিতে পারেন না!
ডাক্তারবাবুর নাম রাজেন্দ্রনাথ পাণ্ডে। যিনি বর্তমানে রাজ্যের একমাত্র সুপার স্পেশ্যালিটি সরকারি হাসপাতাল এসএসকেএমের নেফ্রোলজি’র বিভাগীয় প্রধান। এবং ঘটনাচক্রে কুকুর-কাণ্ডের প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি যিনি শিরোনামে এসেছেন। অভিযোগ, তৃণমূল চিকিৎসক-নেতার সুপারিশে মানুষের হাসপাতালে কুকুরের ডায়ালিসিস করাতে কোমর বেঁধেছিলেন ওই নেফ্রোলজিস্ট।
শেষমেশ উদ্যোগটি বাস্তবায়িত হয়নি। তবে তা ঘিরে বিতর্ক হয়েছে বিস্তর। যার রেশ বহাল থাকতেই নতুন বিতর্কে জড়িয়েছে রাজেন পাণ্ডের নাম। হাসপাতাল-সূত্রের খবর, আউটডোরে ওঁর লাগাতার গরহাজিরা দেখে অন্যান্য বিভাগের ডাক্তারেরা প্রশ্ন তুলেছিলেন। ক্ষোভের আঁচ পেয়ে কর্তৃপক্ষ রাজেনবাবুকে কারণ দর্শাতে বলেন। কিন্তু তাঁর ‘ব্যাখ্যা’ শুনে কর্তারা আর রা কাড়েননি।
অতএব, তেমনই চলছে। ‘‘রাজেনবাবুর যুক্তি, ওঁর অন্য কাজ আছে। মুখ্যমন্ত্রী নানা দায়িত্ব দিয়েছেন, অনেক কমিটিতেও রয়েছেন। তাই আউটডোরে সময় দিতে পারবেন না।’’— বলছেন হাসপাতালের এক কর্তা। তাঁর দাবি, ‘‘আমরা ওঁকে বলেছিলাম, এটা উনি স্বাস্থ্য ভবনকে জানান। তা হলে বিকল্প ব্যবস্থা হতে পারে!’’ কিন্তু রাজেনবাবু এর কোনও জবাবই দেননি বলে কর্তাটির আক্ষেপ।
রাজেনবাবুর এ হেন আচরণের পিছনে অবশ্য শাসকদলের শীর্ষ নেতৃত্বের ‘ছত্রচ্ছায়া’ দেখতে পাচ্ছেন চিকিৎসক মহলের বড় অংশ। দীর্ঘ দিন যাবৎ মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অত্যন্ত কাছের লোক’ হিসেবে পরিচিত রাজেন পাণ্ডে। মুখ্যমন্ত্রীর মা এসএসকেএমে ভর্তি থাকাকালীন রাজেনবাবু ছিলেন তাঁর অন্যতম চিকিৎসক। এবং সেই ঘনিষ্ঠতার সূত্র ধরেই তিনি হাসপাতালের কাজ না-করে রেহাই পেয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ। অনেকের দাবি, মুখ্যমন্ত্রীর ছায়া পিছনে থাকার সুবাদে স্বাস্থ্যভবনের কর্তারাও রাজেনবাবুর ‘অনিয়ম’ নিয়ে জলঘোলা করতে চাইছে না।
বস্তুত গত সোমবার (৬ জুলাই) এসএসকেএমের আউটডোরে সকাল ন’টা থেকে বারোটা ঠায় দাঁড়িয়েও রাজেনবাবুর দেখা পাওয়া যায়নি। আউটডোর সামলাচ্ছিলেন অধস্তনেরা। রাজেনবাবু কোথায় জানতে চাইলে এক জুনিয়র পরিষ্কারই বললেন, ‘‘স্যার তো আউটডোরে থাকেন না!’’ কেন?
জুনিয়র ডাক্তারদের ব্যাখ্যা: ‘স্যার’ জানিয়েছেন, রাজ্যের বিভিন্ন হাসপাতালে ডায়ালিসিস চালু করার ভার রয়েছে ওঁর ওপরে, তাই আসতে পারবেন না। তবে ফি সোমবার যে রাজেনবাবুর জেলা সফর বাঁধা থাকে, তা নয়। তেমন দিনে সকালে হাসপাতালের অন্যত্র ওঁকে পাওয়া যায়। বিকেলে, বেসরকারি ক্লিনিকে।
ফলে বঞ্চিত হয় শুধু আউটডোর। সোমবারও একাধিক রোগী রাজেন পাণ্ডেকে দেখাতেই এসেছিলেন। যেমন, পূর্ব মেদিনীপুরের দীপন মণ্ডল। যাঁর প্রশ্ন, ‘‘আগে তিন দিন ঘুরেছি। প্রতি বারই শুনলাম, আসবেন না। তা হলে ওঁর নামটা লেখা থাকছে কেন?’’
স্বাস্থ্যকর্তারা এই নিয়ে কেউ মন্তব্য করতে চাননি। কেউ কেউ অবশ্য একান্তে বিরক্তিও লুকোননি। ‘‘বছরখানেক আগে এসএসকেএমে এক অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, কলকাতা থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা মাসে অন্তত এক দিন জেলায় গিয়ে পরিষেবা দেবেন। উদ্যোগটি তত্ত্বাবধানের ভার তিনি রাজেনবাবুর উপরে সঁপেন। অথচ সেই ডাক্তার নিজের হাসপাতালেই রোগী দেখছেন না!’’— কটাক্ষ এক কর্তার। দফতরের এক শীর্ষ আধিকারিকের মন্তব্য, ‘‘অভিযোগ এসেছে, রাজেন পাণ্ডে নিজের অধীনে ভর্তি রোগীদেরও দেখতে যান না। নিয়মিত ক্লাস নেন না। নিয়ম মতো টেকনিশিয়ানদের তালিমও দেন না।’’ ঘটনাটা এ বার মুখ্যমন্ত্রীর কর্ণগোচর করার চেষ্টা হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি।
রাজেনবাবু কিন্তু অভিযোগ পুরো নস্যাৎ করতে পারেননি। ফোনে ধরা হলে তিনি বলেন, ‘‘অনেক রকমের কাজ থাকে। তাই প্রতি সপ্তাহে আউটডোর করা সম্ভব নয়। মাসে দু’দিনের বেশি পারছি না। আজ আমার যাওয়ার কথা নয়, তাই যাইনি।’’ কিন্তু আপনি তো মাসে দু’টো সোমবারও থাকেন না বলে শোনা যাচ্ছে?
উত্তর না-দিয়ে রাজেনবাবু ফোন কেটে দেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy