Advertisement
০৪ মে ২০২৪

দুই রোগেই খাঁড়া তাঁদের ঘাড়ে, ক্ষুব্ধ ডাক্তারেরা

পার্থক্য আছে উপসর্গে। অবশ্যই ইতরবিশেষ আছে জাপানি এনসেফ্যালাইটিস এবং সোয়াইন ফ্লু-র মারণ ক্ষমতায়। কিন্তু চিকিৎসকদের একটি বড় অংশের বক্তব্য, তাঁদের অবস্থার দিক থেকে দেখলে জাপানি এনসেফ্যালাইটিস পরিস্থিতির সঙ্গে সোয়াইন ফ্লু পরিস্থিতির আদতে কোনও পার্থক্যই নেই! অন্তত এ রাজ্যের নিরিখে। দু’টি ক্ষেত্রেই নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে দায় চাপানো হচ্ছে ডাক্তারদের উপরে।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ১৬ মার্চ ২০১৫ ০২:৫৩
Share: Save:

পার্থক্য আছে উপসর্গে। অবশ্যই ইতরবিশেষ আছে জাপানি এনসেফ্যালাইটিস এবং সোয়াইন ফ্লু-র মারণ ক্ষমতায়। কিন্তু চিকিৎসকদের একটি বড় অংশের বক্তব্য, তাঁদের অবস্থার দিক থেকে দেখলে জাপানি এনসেফ্যালাইটিস পরিস্থিতির সঙ্গে সোয়াইন ফ্লু পরিস্থিতির আদতে কোনও পার্থক্যই নেই! অন্তত এ রাজ্যের নিরিখে। দু’টি ক্ষেত্রেই নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে দায় চাপানো হচ্ছে ডাক্তারদের উপরে।

সোয়াইন ফ্লু-র দৌরাত্ম্যের মধ্যে কিছু কিছু চিকিৎসককে প্রশাসনের রোষ, এমনকী শাস্তির মুখেও পড়তে হচ্ছে। ডাক্তারদের খেদ সেই কারণেই। গত বছর এনসেফ্যালাইটিসের দাপটের মুখে সাসপেন্ড করা হয়েছিল উত্তরবঙ্গের তিন স্বাস্থ্যকর্তাকে। এ বার সোয়াইন ফ্লু-র প্রকোপের মধ্যে সেই উত্তরবঙ্গেই এক জেলা স্বাস্থ্যকর্তা এবং একটি হাসপাতালের সুপারকে বদলি করা হয়েছে। মারণ রোগের আঁচ এ ভাবেই এসে লাগছে চিকিৎসকদের একাংশের গায়ে। এবং এই শাস্তির সূত্রেই দু’টি রোগ-পরিস্থিতির মধ্যে মিল এবং সিঁদুরে মেঘ দেখছেন তাঁরা।

জলপাইগুড়ি সদর হাসপাতালের দুই চিকিৎসক সোয়াইন ফ্লুয়ে আক্রান্ত হয়েও কাজ চালিয়ে গিয়েছিলেন। কী ভাবে রোগাক্রান্ত দুই চিকিৎসক ওয়ার্ডে সব ধরনের রোগীর মধ্যে কাজ করার সুযোগ পেলেন, তার কারণ দর্শানোর জন্য বৃহস্পতিবার ওই হাসপাতালের সুপার পার্থ দে-কে নোটিস দেয় রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর। সেই শো-কজ নোটিসের জবাব জমা পড়তে না-পড়তেই গত শুক্রবার পার্থবাবুকে নদিয়ায় এবং জেলার অতিরিক্ত মুখ্য স্বাস্থ্য অধিকর্তা গৌতম মণ্ডলকে উত্তর দিনাজপুরে বদলি করার নির্দেশ দেওয়া হয়।

দু’টিই রুটিনমাফিক বদলি বলে জানাচ্ছে স্বাস্থ্য দফতর। কিন্তু গত বারের এনসেফ্যালাইটিসের অভিজ্ঞতা থেকে এতে বিপদের গন্ধ পাচ্ছেন চিকিৎসকদের একাংশ। জলপাইগুড়ির দুই চিকিৎসকের বদলির নির্দেশের পরে বিভিন্ন জেলা থেকে ডাক্তারদের ক্ষোভের কথা এসে পৌঁছচ্ছে স্বাস্থ্য ভবনে। শনিবার দিনভর সেই ক্ষোভের স্রোত সামলাতে হয়েছে রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তাদের। রবিবার ছুটির দিন হওয়ায় বিষয়টি সাময়িক ভাবে চাপা পড়লেও আজ, সোমবার থেকে ফের বিক্ষোভের আঁচ জোরদার হবে বলে মনে করছেন কিছু স্বাস্থ্যকর্তা।

জলপাইগুড়ির বদলি হওয়া অতিরিক্ত মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক গৌতমবাবু এবং হাসপাতালের সুপার পার্থবাবু অবশ্য এখনও পুরনো জায়গাতেই কাজ করছেন। হাসপাতাল সূত্রের খবর, তাঁদের জায়গায় নতুন চিকিৎসক চলে এলেই তাঁরা সরে যাবেন। ওই হাসপাতালে যে-দুই চিকিৎসক সোয়াইন ফ্লুয়ে আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁদের অবস্থা আপাতত স্থিতিশীল। সোম বা মঙ্গলবার তাঁদের হাসপাতাল থেকে ছুটি দেওয়া হবে।

স্বাস্থ্য ভবনের খবর, বিভিন্ন জেলা থেকে ডাক্তারেরা যা বলছেন, তার সারমর্ম হল, পরিকাঠামোর উন্নয়নের ন্যূনতম চেষ্টা না-করে শুধু ডাক্তারদের উপরে শাস্তির খাঁড়া নামিয়ে আনা চলবে না। কেন সোয়াইন ফ্লু শুরু হওয়ার পরেই জেলায় জেলায় প্রয়োজনীয় তথ্য পাঠানো হল না, পর্যাপ্ত মাস্ক এবং ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত করা হল না কেন, কেন সচেতনতা বাড়ানোর ব্যাপারে আদৌ উদ্যোগী হল না স্বাস্থ্য ভবন এই সব প্রশ্নও তুলেছেন তাঁরা।

চিকিৎসকদের এই ক্ষোভ যে অযৌক্তিক কিছু নয়, স্বাস্থ্য দফতরের শীর্ষ কর্তাদের অনেকেই তা স্বীকার করে নিচ্ছেন। ওই দফতরের এক বড় কর্তা বলেন, “যে-কোনও বড় রোগের দাপটের সামনে বরাবরই এ ভাবে অরক্ষিত থাকতে হয় চিকিৎসকদের। অথচ তাঁদের তরফে পান থেকে সামান্য চুন খসলেই সকলে রে-রে করে ওঠেন। এ বার হয়তো বিষয়টা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে।”

শিলিগুড়িতে শনিবার সোয়াইন ফ্লুয়ে একটি শিশুর মৃত্যুর পরে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় আতঙ্ক ছড়িয়েছে। জ্বরের খবর আসছে দার্জিলিঙের বিভিন্ন এলাকা থেকেও। জেলা স্বাস্থ্যকর্তারা জানান, প্রোটোকল অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কোনও জায়গা থেকে এই ধরনের উপসর্গের খবর এলেই পৌঁছে যাচ্ছে মেডিক্যাল টিম। কিন্তু জলপাইগুড়িতে দুই চিকিৎসকের বদলিকে কেন্দ্র করে যে-ভাবে ক্ষোভ-বিক্ষোভ বাড়ছে, সেই ব্যাপারে জেলা স্বাস্থ্যকর্তাদের কেউই বিশেষ কিছু বলতে চাননি।

ডাক্তারদের ক্ষোভের মধ্যে মারণ রোগ প্রশমিত হওয়ার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। রবিবারেও সোয়াইন ফ্লুয়ের এক রোগীর মৃত্যু হয়েছে। হাওড়ার বাসিন্দা মধ্যবয়স্ক ওই ব্যক্তি ভর্তি ছিলেন হাওড়ারই একটি বেসরকারি হাসপাতালে। রাজ্যের স্বাস্থ্যসচিব মলয় দে জানান, এ দিন আরও সাত জনের থুতুর নমুনা পরীক্ষায় সোয়াইন ফ্লু ধরা পড়েছে। এই নিয়ে রাজ্যে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াল ৩১১। মৃতের সংখ্যা ২০। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার পরে এ-পর্যন্ত ২০৯ জনকে ছুটি দেওয়া হয়েছে। এখনও হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন ৮২ জন।

চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, জনবহুল এলাকায় সোয়াইন ফ্লু-র ভাইরাস এইচ১এন১ দ্রুত ছড়ায়। বাতাসের সঙ্গে মিশে কিংবা আক্রান্তের কফ-থুতুর সঙ্গে মিশে ওই ভাইরাস অন্যের শরীরে ঢোকে। হাঁচি, কাশি, জ্বর, গলা ব্যথার উপসর্গ থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে বাজার, স্কুল-কলেজের মতো জনবহুল জায়গায় যেতে নিষেধ করে দিয়েছেন পরজীবী বিশেষজ্ঞেরা। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক এই মর্মে নির্দেশিকাও জারি করেছে। কিন্তু তার পরেও স্বাস্থ্য দফতর বা পুরসভার তরফে কোথাওই তেমন প্রচার চোখে পড়ছে না। ফলে কলকাতা এবং বিভিন্ন জেলায় আমজনতার মধ্যে এই নিয়ে ঘোরতর বিভ্রান্তি রয়েছে। কিছু কিছু রাজনৈতিক দল এবং বেসরকারি সংস্থা অবশ্য প্রচারে নেমেছে। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা কেন্দ্রের সামনে একাধিক রাজনৈতিক দলের তরফে ‘মাস্ক’ বিলি করা হচ্ছে। পরীক্ষার দিনগুলিতে কী ভাবে সাবধানে থাকা যায়, সেই বিষয়ে প্রচার চালাচ্ছে কয়েকটি বেসরকারি সংস্থাও।

কিন্তু সেখানেও রাজ্য সরকারের ভূমিকা কার্যত নীরব দর্শকের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

japanese encephalitis swine flu blame on doctors
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE