বারো বিঘে, দশ বিঘে, চার বিঘে— বিঘে দিয়ে তখন আমের জমি ভাগ হতো। হলে কী হবে! আম গড়িয়ে এ দিক, ও দিক। আমজনতার বাড়ি।
শহরের ছোট্ট ফ্ল্যাট, সাজানো বাড়ি ছেড়ে জমিদার বাড়ির বড় দালান, ছোট ছাদ, করিবর্গার দিকে চেয়ে চিনি বলেছিল, “এ কী গো! এত সুন্দর মেহগনি কাঠের আলমারি তার তলায় আম আর সামনে লিচুর ঝাড়। তোমরা কী গো!”
পরে সেই শহুরে মেয়ে গরমের ছুটি এলেই টিনের ছোট বাক্সে বই খাতা পুরে মায়ের আঁচল ধরে মামারবাড়ি চলে যেত। মামারবাড়ি নাকি আমের বাড়ি? মুর্শিদাবাদের রঘুনাথগঞ্জের বিশাল বাড়ি তখন আমময়।
গরমের ছুটির দুপুর আমের গন্ধে ভরপুর!
জানেন কি সামার ভেকেশনের প্রাচীন নাম ছিল ‘আমকাঁঠালের ছুটি’? এ কথা কি সাম্প্রতিক বাঙালিরা মনে রেখেছে যে, ‘পথের পাঁচালী’-র কিশোর সংস্করণের নাম স্বয়ং বিভূতিভূষণই রেখেছিলেন ‘আম আঁটির ভেঁপু’? সে কাহিনির সেই বিখ্যাত অধ্যায়, যেখানে অপু-দুর্গা এক বাগানে আম কুড়োতে গিয়ে বিতাড়িত হয়ে কল্পনার ছাতা মাথায় দিয়ে নেমে পড়ছে উপুরঝান্ত বৃষ্টি আর বেদনায়, তাকে কি মনে রেখেছেন আজকের আম বাঙালি?
থাক সে সব।
যে সময়কার কথা এখন বলছি তখন ফ্যানের হাওয়া মাঝে মাঝে পাওয়া যেত! বাতাস আম পাতা, জাম আর লিচু গাছের গন্ধ নিয়ে দোল দিয়ে যেত। আর রাতের জন্য ছিল হ্যারিকেনের আলো। সঙ্গে ঝিঁঝিঁ, কখনও এক আধটা সোনা ব্যাঙ। এর মাঝে হলদে আভায়, সোনালি বিভায়, রসে রঙিন আম আমাদের বশ করে ফেলত। বর্ষীয়া, রানি, গোলাপখাস, তোতাপুলি, জর্দালু...কত বাহার!
‘বিশ্বনাথ মুখুজ্যে’ এবং ‘বিশ্বনাথ চাটুজ্যে’ নামের দু-খানা আমও ছিল।
আরও পড়ুন, ফলে ক্ষতিকর পালিশ, কমতে পারে প্রজননও
সকালে পুকুরের জলে হাত মুখ ধুয়েই বাড়ির উঠোনে ছোট ছোট অ্যালুমিনিয়ামের বালতি সাজিয়ে দেওয়া হত। সবেতেই নানা রকমের আম। সঙ্গে তালশাঁস, লিচু। পাশের বাড়ির ভুতো আসতো, সীতা, লালু, পোস্ত ...আম ফুটো করে আম খাওয়া! কেউ আদিখ্যেতা করে কেটে দেওয়ার নেই। শাসনও নেই, ক’টা খাব? কোথায় থামব? উল্টে অনেক সময় আমের পাতা দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে একেকজন বীরপুরুষ হয়ে দেখানোর একটা চাপা খেলা চলতো সেই দিন গুলোয়।
আজ মনে হয়, এই খুলে রাখা শৈশব। আমের পাতার কেতবাজি, জৈষ্ঠের চাপা গরমের উঠোন জুড়ে বৌ বাসন্তী খেলা...এই স্বভাবিক খোলামেলা বেড়ে ওঠায় মনের ভেতর ভালবাসা, স্বপ্ন,বিশ্বাস, আবেগ সব সবুজ হয়ে বাঁচতে চাইত।
আমার বড় মাসি শ্বেতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে শুনেছি, উঠোন ঘেরা দিন দুপুরের আমের দরবারে স্বয়ং দাদাঠাকুর আমের আড্ডায় যোগ দিতে আসতেন। আমের আকর্ষণে আমের জমি দানও হত সে কালে। সে সময় তো সব কিছুকে 'আমার' বলে আঁকড়াবার অবকাশ ছিল না।
সন্ধে নামব নামব করছে কী আম পাড়া হত। তার পর আমাদের মন্টু কাকা সব ঘরের খাটের তলায় আগে আমের পাতা বিছিয়ে এত্ত এত্ত আম সাজিয়ে রাখত। আমরা বলতাম, "আম আপাতত বিছানায় ঘুম দিল!"
আরও পড়ুন, ভয়াল অসুখের আশঙ্কা, সিগারেট ছাড়বেন কী ভাবে?
পরের দিন, বিকেল, সন্ধে, আম বিছানা ছেড়ে বালতিতে। খাওয়ার কোনও সময় নির্দিষ্ট ছিল না। ঘুরতে ফিরতে যে যখন! এর মধ্যেও মাঝরাতে শেয়ালের ঝগড়ায় ঘুম ভেঙে দেখেছি বাড়ির অল্প বয়সী ছেলেরা, ভাদুদের ছেলেরা, যারা আমাদের বাড়িতেই পড়াশুনা করতো তাদের সঙ্গে জোট বেধে লন্ঠনের ঝিলিক আলোয় তারা ভরা রাতে আমের আসর বসিয়েছে।
প্রায় মধ্য রাত...ঘুম ভেঙে খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে দেখে মনে হতো যেন আমের দরবারে কানাড়ার আলাপ! রস, গন্ধ আর আলোর মধ্যে কতগুলো কিশোর আম এর জন্য রাত জাগছে! কী আছে এই হলদে-সবুজ সম্মোহনে?
আজকের ইনস্টাগ্রামে আম প্রচারে ক্যাটরিনার শরীর লাগে! কিন্তু তখন? কৈশোরের ওই ছেলেগুলো আমকে ঘিরে রাত কাটাতো। এমনকী তখন আমের খোসা শুদ্ধু চেটেপুটে সাফ!
এ তো গেল বাড়ির ছেলেপুলের আম ময়তার কথা।
অন্যদিকে আমার দিদিমাদের দেখেছি ঘরে পরা সাদা জমির শাড়ি বহু ব্যবহারে যার এ পিঠ ও পিঠ দেখা যায়, সেই শাড়ির ওপরে নুন হলুদ মাখিয়ে আম কেটে জৈষ্ঠের কড়া রোদে শুকোতে দিত। এই আম শুকনোর শাড়ি বহু যত্নে তোলা থাকত জৈষ্ঠের জন্য! হতে পারে আষাঢ়, শরৎ, বসন্তের আসন বঙ্গ হৃদয়ে অনেক বেশি, কিন্তু আমের মধুরতায় প্যাচপেচে গরমের ঘ্যানঘেনে জীবনে নিমেষে মধুরেন সমাপয়েৎ হতো।
এ মাস মধুমাস। আমের সর্বনাশ!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy