Advertisement
০১ মে ২০২৪

খিঁচুনি-জ্বরে মৃতের সংখ্যা বাড়ছে, এখনও প্রস্তুতই হয়নি কলকাতা

কলকাতা পুরসভা ও শহরের সরকারি হাসপাতালগুলির কর্তাব্যক্তিরা বিষয়টিকে যতই লঘু করে দেখান না কেন, বাস্তব কিন্তু অন্য কথা বলতে শুরু করেছে। খাস কলকাতায় অ্যাকিউট এনসেফ্যালাইটিক সিনড্রোম (এইএস)-এর রোগীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। গত শনিবার ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে ওই উপসর্গ নিয়ে ভর্তি হওয়া দু’বছরের একটি শিশু মারা গিয়েছিল। বৃহস্পতিবার কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে মৃত্যু হল চার বছরের এক শিশুর। সে-ও এসেছিল এইএস নিয়ে।

রিপোর্টের অপেক্ষায় রোগী ও পরিজনেরা। বৃহস্পতিবার, ট্রপিক্যালে। ছবি: সুদীপ আচার্য।

রিপোর্টের অপেক্ষায় রোগী ও পরিজনেরা। বৃহস্পতিবার, ট্রপিক্যালে। ছবি: সুদীপ আচার্য।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ অগস্ট ২০১৪ ০২:৩৭
Share: Save:

কলকাতা পুরসভা ও শহরের সরকারি হাসপাতালগুলির কর্তাব্যক্তিরা বিষয়টিকে যতই লঘু করে দেখান না কেন, বাস্তব কিন্তু অন্য কথা বলতে শুরু করেছে। খাস কলকাতায় অ্যাকিউট এনসেফ্যালাইটিক সিনড্রোম (এইএস)-এর রোগীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। গত শনিবার ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে ওই উপসর্গ নিয়ে ভর্তি হওয়া দু’বছরের একটি শিশু মারা গিয়েছিল। বৃহস্পতিবার কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে মৃত্যু হল চার বছরের এক শিশুর। সে-ও এসেছিল এইএস নিয়ে।

ন্যাশনালে ভর্তি থাকা প্রান্তিক রায় নামে বাঁশদ্রোণীর বাচ্চাটির চিকিৎসার তেমন সুযোগ পাননি ডাক্তারেরা। জাপানি এনসেফ্যালাইটিস নির্ণয়ের জন্য যা আবশ্যিক, সেই রক্ত ও সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড (সিএসএফ)-ও পরীক্ষাও হয়নি তার। স্রেফ ‘ক্লিনিক্যাল ডায়গনিসিসের’ ভিত্তিতে প্রান্তিকের ডেথ সার্টিফিকেটে মৃত্যুর কারণ ‘এনসেফ্যালাইটিস’ লিখে দেওয়া হয়, যা নিয়ে বিতর্ক দানা বেঁধেছে। হাসপাতালের ব্যাখ্যা চেয়েছে স্বাস্থ্য দফতর। তবে এ দিন মেডিক্যাল কলেজে মারা যাওয়া সোনু মণ্ডল নামে ডোমজুড়ের বালকটির রক্ত এবং সিএসএফ টেস্ট হয়েছিল। তাতে জাপানি এনসেফ্যালাইটিসের জীবাণু মেলেনি বলে হাসপাতাল-সূত্রের দাবি।

তালিকা এখানেই শেষ নয়। প্রান্তিকের বাবা প্রণব রায়ও জ্বরে আক্রান্ত। এনসেফ্যালাইটিসের উপসর্গ নিয়ে তিনি আপাতত এসএসকেএমে। আবার স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনে ভর্তি হরিপদ সরকারের শরীরে আগেই জাপানি এনসেফ্যালাইটিসের ভাইরাস ধরা পড়েছে। ডাক্তারদের অনুমান, আদতে গুয়াহাটির বাসিন্দা হরিপদবাবু সেখান থেকে জীবাণুটি নিয়ে এসেছেন। ২৮ জুন তাঁর রোগ ধরা পড়ে। কলকাতার আরও বিভিন্ন হাসপাতালে জ্বর ও এনসেফ্যালাইটিসের উপসর্গ নিয়ে রোগী আসছেন।

কিন্তু তাঁদের রোগ নির্ণয় ও ঠিকঠাক চিকিৎসা করার মতো পরিকাঠামো বা সচেতনতা সর্বত্র রয়েছে কি?

প্রশ্নটা দিন দিন প্রকট হয়ে উঠছে। কারণ, কোথাও ‘ফিভার ক্লিনিক’ খোলা হয়নি। ট্রপিক্যালে ‘ম্যালেরিয়া ক্লিনিক’ থাকলেও ‘ফিভার ক্লিনিক’ খোলার কথা এই মুহূর্তে ভাবা হচ্ছে না। “এখনও যা অবস্থা, তাতে চব্বিশ ঘণ্টার ক্লিনিক দরকার নেই।” বলছেন প্রতিষ্ঠানের অধিকর্তা নন্দিতা বসু। কলকাতা পুরসভারও তেমন কোনও পরিকল্পনা নেই। তারা আপাতত জোর দিচ্ছে শুয়োর হঠানোয়।

পাশাপাশি পর্যাপ্ত পরিকাঠামো না-থাকায় ফ্যাসাদে পড়ছে সরকারি হাসপাতাল। এনসেফ্যালাইটিসের উপসর্গ নিয়ে ভর্তি হওয়া রোগীদের চিকিৎসা-সঙ্কট দেখা দিচ্ছে। এ দিন যেমন সোনু মণ্ডলের ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছিল। চার বছরের বাচ্চাটির জন্য একটি পেডিয়্যাট্রিক ভেল্টিলেটার জোগাড় করতে হন্যে হয়ে গিয়েছিল কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ। শেষমেশ ভেন্টিলেটর মিললেও সোনুকে অবশ্য বাঁচানো যায়নি। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে ট্রপিক্যালে যাওয়া হরিপদবাবুর অবস্থাও আশঙ্কাজনক। এ দিকে ট্রপিক্যালে ভেন্টিলেটরের ব্যবস্থা নেই। এমতাবস্থায় হরিপদবাবুর জন্য মেডিক্যাল কলেজ থেকে ভেন্টিলেটর ধার করতে হয়েছে। কিন্তু আরও রোগী ভর্তি হলে কী হবে সামাল দেবেন?

ট্রপিক্যালের কর্তারা সে ব্যাপারে অন্ধকারে। বস্তুত মহানগরের মেডিক্যাল কলেজগুলোয় খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছে, পর্যাপ্ত পেডিয়্যট্রিক ভেন্টিলেটর কোথাওই মজুত নেই। উত্তরবঙ্গের মতো কলকাতাতেও এইএস সংক্রমণ ব্যাপক ভাবে ছড়ালে কী ভাবে মোকাবিলা করা যাবে, তা ভেবে স্বাস্থ্যভবনের অন্দরে স্বভাবতই উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। প্রসঙ্গত, দুর্ঘটনা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা বড় ধরনের রোগের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিভিন্ন হাসপাতালে ‘ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট’ পরিকাঠামো তৈরি রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন, যেখানে জরুরি ভিত্তিতে রোগী ভর্তির জন্য যাবতীয় পরিকাঠামো-সহ কয়েকটি শয্যা বছরভর নির্দিষ্ট থাকার কথা। কিন্তু তাঁর নির্দেশ যে স্রেফ কথার কথা হয়ে রয়ে গিয়েছে, দু’-পাঁচ জন করে এইএস-রোগী আসা শুরু হতেই তা পরিষ্কার। দেখা যাচ্ছে, আপৎকালীন এমন কোনও পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে কলকাতার মেডিক্যাল কলেজগুলো আদৌ প্রস্তুত নয়।

কেন? হাসপাতাল-কর্তাদের ব্যাখ্যা, এ ব্যাপারে স্বাস্থ্যভবনের কোনও নির্দেশ তাঁরা পাননি। স্বাস্থ্যভবন কি নির্দেশ দেয়নি? রাজ্যের দুই শীর্ষ স্বাস্থ্য-কর্তার পরস্পর-বিরোধী মন্তব্যে কিছুটা বিভ্রান্তি জাগতে বাধ্য। কারণ, উত্তরবঙ্গে সংক্রমণ ও কলকাতার বিভিন্ন হাসপাতালে এইএস-রোগী ভর্তি, এমনকী তাতে মৃত্যুর পরেও দক্ষিণবঙ্গে কতটা সতর্কতা দরকার, সে প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য-অধিকর্তা এবং স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তার মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। সতর্ক থাকার প্রয়োজনীয়তা মেনে নিয়ে স্বাস্থ্য-অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীর বক্তব্য, ঝুঁকি এড়ানোর তাগিদেই তাঁরা জ্বর ও খিঁচুনির উপসর্গ নিয়ে আসা প্রত্যেক রোগীর রক্ত পরীক্ষার নির্দেশ দিয়েছেন। অন্য দিকে সমস্ত মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের দায়িত্ব যাঁর হাতে, সেই স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় ‘এত বিচলিত’ হওয়ার মতো কিছু দেখছেন না। তাঁর বক্তব্য, হাসপাতাল এমনিতেই রোগীদের চিকিৎসা করতে প্রস্তুত থাকে। আলাদা ভাবে প্রস্তুতির যৌক্তিকতা সম্পর্কে পাল্টা প্রশ্ন তুলে তাঁর দাবি, এতে অযথা আতঙ্কই ছড়াবে। অতএব সুশান্তবাবু ‘বিশেষ প্রস্তুতি’র নির্দেশ দেননি। সুতরাং কোনও মেডিক্যাল কলেজেই আপৎকালীন পরিকাঠামো গড়ে ওঠেনি। ফলে এক জন এইএস-রোগীকে (সোনু মণ্ডল) নিয়েই কলকাতা মেডিক্যাল কলেজকে এ দিন হিমসিম খেতে হয়েছে। তারাও জানে না, সোনুর মতো আরও রোগী এলে কী অবস্থা হবে। বস্তুত বাচ্চাটির কী রকম অবস্থা, তার কী ধরনের চিকিৎসা চলছিল, মেডিক্যালের ডেপুটি সুপারেরও সে বিষয়ে সম্যক ধারণা ছিল না। “শুনেছি, এমন একটা ঘটনা হয়েছে। কিন্তু বাচ্চাটির নাম বা ঠিক কী চিকিৎসা হয়েছিল, তার কিছুই জানি না।” বলেন মেডিক্যালের ডেপুটি সুপার মুক্তিসাধন মাইতি।

এক দিকে এলোমেলো, সমন্বয়হীন সরকারি স্বাস্থ্য-পরিষেবা। অন্য দিকে চেহারা লুকোনো রোগ-জীবাণু। যার হামলা বাঁধ ভাঙলে পরিণাম ভেবে শিউরে উঠছেন সকলে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

patients acute encephalitis syndrome kolkata
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE