Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
Health

করোনা আতঙ্ক

বিশ্বময় বাড়ছে মৃত্যুর খতিয়ান। আবার ভারতেও বাড়ছে এই ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা। কতটা বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে আমরা?সম্প্রতি ভারতেও অস্তিত্ব মিলেছে করোনাভাইরাসের।

রূম্পা দাস
শেষ আপডেট: ০৭ মার্চ ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

এ কটা ভাইরাস। তাতে ক্রমশ বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। ঠিক মতো কিছু বুঝে ওঠার আগেই মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে ভাইরাসে, শরীর অসুস্থ হচ্ছে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে মৃত্যুও। ফলে করোনাভাইরাস আতঙ্কের রূপ ধারণ করেছে। এখনও অবধি নিশ্চিত করে এর প্রতিকার বা ওষুধের খোঁজ মেলেনি। অনুমান করা হচ্ছে, ২০১৯ সালের একেবারে শেষের দিকে চিনের উহানে প্রথম এই ভাইরাস থেকে মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল। গোড়ায় এতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা এতটাই বাড়তে থাকে যে, কোয়ারান্টাইন ক্যাম্প বসানো হয়। তড়িঘড়ি তৈরি হয়েছে অস্থায়ী হাসপাতাল। তবু চিন থেকে সেই ভাইরাস ছড়িয়েছে গোটা বিশ্বে। একটি আন্তর্জাতিক মাধ্যম বলছে, আন্টার্কটিকা ছাড়া প্রতিটি মহাদেশেই প্রবেশ করেছে করোনা। সাম্প্রতিক সমীক্ষা ও খবর অনুযায়ী, ৭৩টি দেশে আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৯০,০০০। মৃতের সংখ্যাও কম নয়। চিনে ঢোকার এবং বেরোনোর উড়ান পুরোপুরি বন্ধ করা হয়েছে। বেশ কিছু দেশে সাময়িক ভাবে নিষিদ্ধ রাখা হয়েছে পর্যটক প্রবেশ। চিন থেকে এই ভাইরাস ছড়িয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নানা দেশে। জাপান সাময়িক ভাবে বন্ধ রেখেছে ঐতিহ্যবাহী চেরি ব্লসম ফেস্টিভ্যাল। আবার পাশ্চাত্যেও রোগবিস্তার করেছে এই ভাইরাস। ইটালি, ফ্রান্স, জার্মানি-সহ বেশ কিছু দেশে আতঙ্কের আবহ তৈরি হয়েছে।

সম্প্রতি ভারতেও অস্তিত্ব মিলেছে করোনাভাইরাসের। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষ বর্ধন বুধবার জানিয়েছিলেন, ভারতে এই ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ২৮ ছাড়িয়েছে। যদিও তাঁরা বেশির ভাগই ইটালি থেকে এসেছিলেন। কলকাতাতেও এক জাপানি মহিলাকে ভাইরাসে আক্রান্ত অনুমান করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ভারতে করোনাভাইরাস আক্রান্তের হদিশ মেলার পর থেকেই শুরু হয়েছে চাপানউতোর। এখানে বিপদের আশঙ্কা কতটা? আদৌ কি প্রতিরোধ করা যায় করোনাকে?

করোনাভাইরাস কী?

করোনা মানে হল সূর্যের ছটা। ভাইরাসটির গায়ে সূর্যের রশ্মির মতো বেশ কিছু কাঁটা দেখা যায় বলে এর নাম করোনা। করোনাভাইরাস একেবারেই নতুন নয়। এই ভাইরাসটি পরিচিত COVID-19 নামে। এর অর্থ করোনাভাইরাস আইডেন্টিফায়েড-২০১৯। সম্প্রতি ছড়িয়ে পড়া ভাইরাসটির প্রথম সন্ধান ২০১৯ সালেই পাওয়া গিয়েছিল বলে এমন নাম। করোনাভাইরাস আসলে এক ধরনের প্রজাতি। এটি মানুষ ছাড়াও অন্য পশুপাখি সকলের মধ্যেই ছড়াতে পারে। জিনের অদলবদল ঘটলে তা অন্যান্য পশু বা পাখিকে আক্রান্ত করতে পারে। তার মধ্যে করোনাভাইরাসের আরও ক’টি সাবটাইপ এর আগেই পৃথিবীতে নিজেদের প্রকোপ ছড়িয়েছে। যেমন SARS (Severe acute respiratory syndrome) বা MERS (Middle east respiratory Syndrome related coronavirus)। আবার সোয়াইন ফ্লুকেও ধরা যেতে পারে এর মধ্যে। এর প্রায় সব ক’টিই ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রজাতির।

কেন ফিরছে করোনা?

এ ধরনের ভাইরাস পাঁচ-সাত বছর পরপর অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য নিজেরাই নিজেদের জিনের অদলবদল ঘটাচ্ছে। তবে জিনগত বদলের পরে ভাইরাস যখন ফের মানুষের মধ্যে ছড়ায়, তখন এক-দু’বছর তা প্রকট হয়। কখনও মহামারীর আকার ধারণ করে। আবার একটা সময়ের পরে তা থিতিয়েও যায়। খানিক ‘সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট’ তত্ত্বের মতোই ভাইরাস নিজের জিন বদলাতে থাকে। মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অরুণাংশু তালুকদার বলছেন, ‘‘আমাদের শরীর কোনও ভাইরাসকে প্রতিহত করার জন্য অ্যান্টিবডি তৈরি করে নিজের ভিতরে। সে ভাবেই দমন করা সম্ভব হয় যে কোনও ভাইরাসকে। সামান্য জ্বর, ঠান্ডা লাগার মতো সমস্যা মানুষ কাটিয়ে ওঠে এ ভাবেই। ধরে নেওয়া যাক SARS ভাইরাসের কথাই। যে সময়ে এর অ্যান্টি-ভাইরাস ডোজ় তৈরি হল বা মানুষের শরীরের মধ্যে নিজে থেকেই ইমিউনিটি পাওয়ার তৈরি হল, তখন থেকে SARS ভাইরাসের প্রকোপও কমে গেল। দেখা গেল, SARS আর মানুষের ক্ষতি করতে পারছে না। ভিতরে প্রবেশ করলেই শরীর নিজে থেকে তাকে মারতে সক্ষম হচ্ছে। বেঁচে থাকার তাগিদে এ ধরনের ভাইরাস নিজেরাই প্রোটিনের কিছু গঠন বদলে নেয়। এটা তো জীবনেরই ধর্ম। তাই নতুন ভাইরাস আসার পরে প্রাথমিক ভাবে অসুবিধে হয় তাকে চিহ্নিত করে মোকাবিলা করতে।’’

মানুষের শরীরে পাওয়া করোনাভাইরাসের স্ট্রাকচার বা গঠনের সঙ্গে পশুপাখির শরীরে পাওয়া করোনাভাইরাসের খানিক মিল দেখা গিয়েছে। তাই মনে করা হয়েছে যে, পশুর শরীর থেকেই সংক্রমণ ছড়িয়েছে মানুষের মধ্যে। পশুপাখি হত্যা বা বলি বা মাংস কাটার সময়ে রক্ত চোখ, মুখ ইত্যাদির মাধ্যমে শরীরের ভিতরে প্রবেশ করতে পারে। তবে কোন পশু এবং কী ভাবে তা মানুষের শরীরে প্রবেশ করেছে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। আবার অন্য মত বলছে, এটাও হতে পারে, মানুষের মধ্যে পাওয়া এই ভাইরাসের গঠন বদলে গিয়েছে এবং তা নতুন রূপে প্রবেশ করেছে।

লক্ষণ

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে একেবারেই সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জার লক্ষণ দেখা দেয়। সর্দি, কাশি, জ্বর, মাথাব্যথা হয়। তবে তার সঙ্গে দেখা যাচ্ছে শ্বাসকষ্টও। ডা. তালুকদার বলছেন, ‘‘আমরা শ্বাস গ্রহণ করলে তা সরাসরি গিয়ে পৌঁছয় ফুসফুসে। শ্বাসনালীর গায়ের যে পর্দা, সেই মিউকাস এপিথেলিয়ামে গিয়ে বাসা বাঁধে ভাইরাসগুলি। বাসা বাঁধার পরে সেগুলি ফুলে ফুলে ওঠে। ফলে অক্সিজেন ও কার্বন ডাই অক্সাইড প্রবেশ-নির্গমন রুদ্ধ হয়ে যায়। আর এই ভাইরাস খুব তাড়াতাড়ি বংশবিস্তার করে। দেখা যায়, ফুসফুসের প্রতিটি কোষ, শ্বাসনালীকে ভীষণ দ্রুত আক্রমণ করে। তাই এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে পরিণতি দ্রুত খারাপ হতে থাকে।’’ তবে এটাও লক্ষণীয় যে, করোনায় আক্রান্ত হয়ে যাঁদের মৃত্যু হয়েছে, তাঁদের বেশির ভাগই প্রবীণ, শিশু এবং অন্য রোগে আক্রান্ত। অর্থাৎ যাঁদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, মৃত্যু হয়েছে তাঁদেরই।

আশার কথা

কিন্তু এই পরিস্থিতি কি এ রকমই চলতে থাকবে? কয়েক মাসের মধ্যে শরীর যখন বুঝতে পারবে ভাইরাসের ধরন, তখন আপনাআপনিই প্রত্যেকের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে যাবে বলে অনুমান করছেন চিকিৎসকেরা। তখন স্বাভাবিক ভাবেই কমবে করোনা ভাইরাসের প্রকোপ, কাবু করার শক্তি এবং মারণক্ষমতাও।

ওষুধ কি আদৌ আছে?

আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই সর্বত্র চলছে করোনাভাইরাস দমন করার ওষুধ আবিষ্কারের প্রয়াস। এমন দু’-তিনটি ওষুধের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে, যা আংশিক ভাবে কাজ করছে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের উপরে। আসলে ওষুধ যে কাজ করছে, তা প্রমাণ করতেও সময়ের প্রয়োজন। আমেরিকার আটলান্টার সেন্টার ফর ডিজ়িজ় কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন সম্প্রতি নন অ্যান্টি-ভাইরাল ড্রাগ ও বিশেষ কিছু ড্রাগ দিয়ে ওষুধ তৈরির প্রোটোকল তৈরি করেছে বলেও শোনা যাচ্ছে। তবে যেহেতু এখনও ওষুধ তৈরি আবিষ্কারের পথে, তাই কিছু সচেতনতা নেওয়া আবশ্যিক।

কী কী করণীয়?

n ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন যাঁরা, অবশ্যই তাঁদের কাছ থেকে দূরে থাকতে হবে। আক্রান্তের হাঁচি-কাশি-সর্দির মাধ্যমেই তা ছড়াতে পারে। অর্থাৎ আক্রান্তদের চিহ্নিত করে ২৮ দিন পর্যন্ত আলাদা ভাবে রাখতে হবে। এতে তাঁর থেকে সংক্রামিত হওয়ার ভয় কমবে। তবে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও অধ্যাপক অমিতাভ নন্দী বলছেন, ‘‘ভারতে যদি অনেকের মধ্যে এই ভাইরাস ছড়ায়, সেখানে আক্রান্তদের আলাদা রেখে কোয়ারান্টাইন করার মতো কতটা সুযোগ পাওয়া যাবে, তা বড় প্রশ্ন। তবে অবশ্য ভারতে এখনও পর্যন্ত যাঁরা আক্রান্ত, তাঁরা প্রত্যেকেই বাইরে থেকে আগত।’’

n আক্রান্তকে অবশ্যই মাস্ক পড়ে থাকতে হবে। যদি কোনও অঞ্চলে করোনা ছড়াতে শুরু করে, তবে সুস্থ মানুষদেরও পরতে হবে মাস্ক। এতে যেমন আক্রান্তের কাছ থেকে সংক্রমণের আশঙ্কা কমবে, তেমনই কমবে নিজের সংক্রামিত হওয়ার ভয়ও। তবে বাজারচলতি যে কোনও মাস্ক নয়, এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকর এন-৯৫ জাতীয় মাস্কই। কিন্তু এটি না পেলে বিকল্প হিসেবে অন্য মাস্ক ব্যবহার করতে পারেন।

n আক্রান্তদের কাছ থেকে অন্তত তিন-চার ফুট তফাতে থাকাটাই শ্রেয়। হতেই পারে যে, অচেনা বা অপরিচিত কেউ আক্রান্ত কি না, তা জানা নেই। সে ক্ষেত্রে ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলুন। ডা. তালুকদারের কথায়, ‘‘এই ভাইরাস অত্যন্ত নরম প্রকৃতির, সুখী। একমাত্র ভেজা অবস্থাতেই এটি বংশবিস্তার করতে পারে। ফলে হাঁচি-কাশি ইত্যাদির সময়ে তিন-চার ফুটের দূরত্ব বজায় রাখলে অত দূর এসে পৌঁছয় না ভাইরাসটি। আর একবার মেঝেয় পড়ে কিংবা বাতাসে যদি ভাইরাস শুকিয়ে যায়, তা হলেই তা আর আক্রমণ করতে পারে না। তাপমাত্রা বাড়লেই এই ভাইরাস বেঁচে থাকতে পারবে না।’’ ফলে স্বাভাবিক ভাবেই অনুমেয় যে, গরম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কমবে করোনাভাইরাসের প্রকোপ।

n এই পরিস্থিতিতে বেসিক হাইজিন মেলে চলা ভীষণ জরুরি। ডা. নন্দী বলছেন, ‘‘রাস্তা থেকে বাড়ি ফিরলে অবশ্যই একটি বিশেষ জায়গায় জামাকাপড় ছেড়ে ভাল করে হাত পরিষ্কার করতে হবে। রাস্তার নোংরা হাত মুখে দেওয়া চলবে না। চোখে হাত দেওয়া, চোখ কচলানোও উচিত নয়। স্যানিটাইজ়ার, স্যানিটাইজ়িং স্প্রে সঙ্গে রাখতেই হবে।’’ ঘনঘন হাত ধোয়ার পরামর্শ দিচ্ছে ইউনিসেফ। সচেতনতা বাড়াতে একটি ভিডিয়ো প্রকাশ করেছে তারা। তাদের পরামর্শ, অন্তত কুড়ি সেকেন্ড ধরে সাবান দিয়ে ভাল করে কচলে হাত ধোয়াই বাঞ্ছনীয়।

n কোনও অন্তঃসত্ত্বা মহিলা যদি এই ভাইরাসে আক্রান্ত হন, তাঁর কাছ থেকে গর্ভস্থ সন্তানও আক্রান্ত হবে কি না, তার প্রমাণ এখনও মেলেনি।

সীমারেখা পেরোনোর আগে

করোনাভাইরাসের আতঙ্ক বিশ্বজুড়ে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় সাময়িক কালের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছে। বন্ধ করা হয়েছে স্থানীয় উৎসব। অথচ সামনেই আসছে গরমের ছুটি। বেড়ানোর জন্য অনেকেই ইউরোপের কোনও দেশ অথবা প্রাচ্যের জাপান, সিঙ্গাপুর, ব্যাঙ্কক, তাইল্যান্ডের মতো দেশ বেছে নেন। ফলে যে সব দেশে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, সে সব দেশে কি আদৌ আগামী কয়েক মাসে যাওয়া উচিত? ‘‘আমার মত নিলে একেবারেই নয়,’’ বলছেন ডা. নন্দী। তবে ডা. তালুকদার বলছেন, ‘‘অনেক দেশ ইতিমধ্যেই জানিয়েছে যে, সেখানে না যেতে। তবে যেমন অতিরিক্ত প্যানিক করার দরকার নেই, তেমনই উদাসীন হওয়ারও প্রয়োজন নেই। কেউ যদি সাবধানতা অবলম্বন করতে পারেন, তা হলে যেতেই পারেন। কিন্তু ভয় পেলে বিদেশভ্রমণ বাতিল করাই শ্রেয়।’’

সমস্ত কিছুর শেষে দুষ্টের দমন হয়ই। তা সে অশুভ শক্তি হোক কিংবা ভাইরাস। এমনটাই তো দস্তুর। করোনাভাইরাসের প্রকোপ কমবে বলে যেমন আশাবাদী চিকিৎসকেরা, তেমনই তাঁরা সাধারণ মানুষকে সচেতন থাকার পরামর্শই দিচ্ছেন। এতে সুস্থ থাকবেন নিজেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus China Health
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE