Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
উদ্বেগ এইচআইভি সংক্রমণ

ব্লাড ব্যাঙ্কে হচ্ছেটা কী, জানতে চায় বিশ্বব্যাঙ্ক

দেশের ব্লাড ব্যাঙ্কগুলি কতটা সুরক্ষিত তা নিয়ে যথাযথ সমীক্ষা চায় বিশ্বব্যাঙ্ক। ভারতে বেশ কিছু ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে পাওয়া রক্তে উদ্বেগজনক ভাবে এইচআইভি সংক্রমণ ছড়াচ্ছে বলে একটি আন্তর্জাতিক জার্নালে গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছিল। তার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাঙ্ককে চিঠি দেন চিকিৎসক মহলের একাংশ। ওই গবেষণাপত্র এবং চিকিৎসকদের চিঠি— এই দুইয়ের জেরে বিশ্বব্যাঙ্কও বিষয়টি নিয়ে নড়েচড়ে বসে।

সোমা মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:১২
Share: Save:

দেশের ব্লাড ব্যাঙ্কগুলি কতটা সুরক্ষিত তা নিয়ে যথাযথ সমীক্ষা চায় বিশ্বব্যাঙ্ক।

ভারতে বেশ কিছু ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে পাওয়া রক্তে উদ্বেগজনক ভাবে এইচআইভি সংক্রমণ ছড়াচ্ছে বলে একটি আন্তর্জাতিক জার্নালে গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছিল। তার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাঙ্ককে চিঠি দেন চিকিৎসক মহলের একাংশ। ওই গবেষণাপত্র এবং চিকিৎসকদের চিঠি— এই দুইয়ের জেরে বিশ্বব্যাঙ্কও বিষয়টি নিয়ে নড়েচড়ে বসে। আর তার পরেই সামনে আসে বহু উদ্বেগজনক তথ্য। জানা যায়, প্রতি বছর রক্ত নিতে গিয়ে এ দেশে কত মানুষ নতুন করে এইচআইভি সংক্রমণের শিকার হচ্ছেন, তার কোনও নির্দিষ্ট তথ্যই নেই কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে। ওই পরিসংখ্যান ছাড়া সংক্রমণ ঠেকানোর চেষ্টা যে সফল হবে না, সেটা বুঝেই তথ্যপঞ্জির উপরে জোর দিচ্ছে বিশ্ব ব্যাঙ্ক।

ভারতের ব্লাড ব্যাঙ্কগুলির পরিকাঠামো উন্নয়নে বেশ কিছু বছর ধরে অর্থ সাহায্য করে আসছে বিশ্বব্যাঙ্ক। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক সূত্রে খবর, সেন্ট্রাল ড্রাগস স্ট্যান্ডার্ড কন্ট্রোল অর্গানাইজেশন-এর নথিভুক্ত ব্লাডব্যাঙ্কের সংখ্যা প্রায় ২ হাজার ৭০০। কিন্তু এর মধ্যে মাত্র ৪১ শতাংশ ব্যাঙ্ককে পরিকাঠামোগত সহায়তা করে ন্যাকো। অর্থাৎ ৫৯ শতাংশ ব্লাড ব্যাঙ্কের পরিকাঠামো কী রকম, সে সম্পর্কে যে বিশ্বব্যাঙ্কের কোনও ধারণাই নেই।

ন্যাকো-র এক কর্তা বলেন, ‘‘সরকারি সব ব্লাড ব্যাঙ্ককে আমরা পরিকাঠামোগত সাহায্য করি। এ ছাড়া কিছু অলাভজনক প্রতিষ্ঠানকেও সহায়তা করা হয়। কিন্তু বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলিকে আমরা সাহায্য করি না।’’ অর্থাৎ সেগুলির কী হাল, সেগুলি সব নিয়ম, সুরক্ষাবিধি মেনে চলছে কি না সে সম্পর্কে কার্যত তাঁদের কোনও ধারণাই নেই বলে ন্যাকোর এক কর্তা জানিয়েছেন।

তা হলে বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলির উপরে নজরদারি চলে কী ভাবে? স্বাস্থ্য মন্ত্রকের কর্তারা জানিয়েছেন, সব দিক খতিয়ে দেখার জন্য জাতীয় রক্ত সঞ্চালন পর্ষদ রয়েছে। আর সেন্ট্রাল লাইসেন্সিং অথরিটি (সিএলএ) ব্যাঙ্কগুলিকে অনুমোদন দেয়। তারাই পরিকাঠামো খতিয়ে দেখে। এই পরিকাঠামো খতিয়ে দেখার ক্ষেত্রেই গোড়ায় গলদ থেকে গিয়েছে বলে অভিযোগ। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের এক কর্তা বলেন, ‘‘একটা সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ২০০০ সালে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে বছরে এইচআইভি সংক্রমণের যে হার ছিল, ২০১৪-য় সেটা অনেক কমে গিয়েছে। পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে সন্দেহ নেই। কিন্তু সমস্যা হল, কিছু ক্ষেত্রে ব্লাডব্যাঙ্কগুলির উপরে নজরদারি ঢিলেঢালা থেকে যাচ্ছে। ঠেকানো যাচ্ছে না কিছুতেই। আর তারই মাসুল গুনছেন বহু নিরপরাধ মানুষ।’’

সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারেরই এক সমীক্ষায় ধরা পড়েছিল, ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে রক্ত নিয়ে গত পাঁচ বছরে এ দেশে প্রায় ৯ হাজার মানুষ এইচআইভি সংক্রমণের শিকার হয়েছেন। শুধুমাত্র ২০১৪ সালের শেষ ছ’মাসে সংখ্যাটা ৭০০ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ভারতীয় ব্লাডব্যাঙ্কগুলির এমন ভয়াবহ চিত্র ধরা পড়ে ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালেও। ওই রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাঙ্কের প্রাক্তন কনসালট্যান্ট, চিকিৎসক কুণাল সাহা বিশ্বব্যাঙ্ককে একটি চিঠি দিয়েছিলেন। সোমবার কুণালবাবু বলেন, ‘‘শুধু বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে লাভ নেই। তাদের তো অনেক সমস্যা রয়েছেই। পাশাপাশি সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্কগুলির অবস্থাও কিছু ভাল নয়। আমি নিজে বিশ্ব ব্যাঙ্কের কনসালট্যান্ট হিসেবে কিছু সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্ক ঘুরে দেখেছি। সেখানে লোকবল, সরঞ্জাম, সদিচ্ছা— সব কিছুর অবস্থাই ভয়াবহ।’’

বিশ্বব্যাঙ্কের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ংয়ের হয়ে বিশ্বব্যাঙ্কের ভারতের ভারপ্রাপ্ত অধিকর্তা ওনো রুল কুণালবাবুকে চিঠি লিখে জানিয়েছেন, বিষয়টি নিয়ে তাঁরাও খুবই উদ্বিগ্ন। কারণ বিশ্ব জুড়ে নতুন করে এইচআইভি সংক্রমণ ঠেকানোর যে লক্ষ্য তাঁরা ঠিক করেছেন, তাতে ধাক্কা দেবে ভারতের এই পরিস্থিতি। বিষয়টি সম্পর্কে নজরদারি বাড়াতে এবং উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রককে অনুরোধ জানিয়েছেন তাঁরা।

১৯৯১ সালে ন্যাশনাল এডস কন্ট্রোল প্রোজেক্ট-এর শুরু থেকেই ভারতে বিশ্বব্যাঙ্কের আর্থিক সহায়তা শুরু হয়েছিল। রক্তসুরক্ষার উপরে যথেষ্ট জোর দিয়ে এসেছে বিশ্বব্যাঙ্ক। ন্যাশনাল এডস কন্ট্রোল অর্গানাইজেশন (ন্যাকো) গড়ে ওঠার পরে ব্লাড ব্যাঙ্কগুলির পরিস্থিতির অনেকটাই উন্নতি হয়েছে বলে জানিয়ে বিশ্ব ব্যাঙ্ক কর্তারা জানিয়েছেন, এখনও অনেকটা পথ এগোনো বাকি। এ জন্য বিভিন্ন রাজ্যকেও সক্রিয় হতে হবে।

রাজ্যেও রক্ত সুরক্ষা নিয়ে প্রশ্ন, অভিযোগ উঠেছে একাধিকবার। রাজ্য এডস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ সোসাইটির প্রকল্প অধিকর্তা ওঙ্কার সিংহ মীনার যদিও দাবি, এ রাজ্যে পরিস্থিতির অনেকটাই উন্নতি হয়েছে। বিশ্বব্যাঙ্কের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ন্যাকোর সাহায্যপ্রাপ্ত ব্লাড ব্যাঙ্কগুলি থেকে সংগৃহীত রক্তে এইচআইভি সংক্রমণ ২০১৩ সালে কমে হয়েছে মাত্র ০.২ শতাংশ। মীনা বলেন, ‘‘এ রাজ্যে হারটা আরও কমে গিয়েছে। পরিকাঠামোর অনেকটাই উন্নতি হয়েছে গত কয়েক বছরে।’’

রক্তদান আন্দোলনের কর্মীরা অবশ্য বলছেন, শুধু ব্লাড ব্যাঙ্কের সংখ্যা বাড়িয়ে বা সরঞ্জাম কিনে সুরক্ষা নিশ্চিত করা যায় না। সুরক্ষার বিষয়টি এ রাজ্যে ধাক্কা খাচ্ছে নানা ভাবেই। রক্তদান আন্দোলনের কর্মী দীপঙ্কর মিত্র বলেন, ‘‘এ রাজ্যে আগে রক্তদানের বহু ক্যাম্পে ব্যাগ, ছাতা দেওয়া হত রক্তদাতাদের। এখন ট্রলি ব্যাগ, প্রেশার কুকার, ক্যামেরাও দেওয়া হচ্ছে। কোথাও কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। এটা তো এক অর্থে রক্ত বিক্রি। তাই অনেকে জিনিসের লোভে রোগ লুকিয়ে রক্ত দিচ্ছেন। মদ্যপ অবস্থায় রক্ত দিচ্ছেন। এক বার দেওয়ার দু’-তিন মাসের মাথায় ফের রক্ত দিচ্ছেন। মেডিক্যাল অফিসাররা কাউকে বাতিল করলে উল্টে তাঁদের হুমকি শুনতে হচ্ছে। কে নিশ্চিত করবে রক্ত সুরক্ষা? সবটাই তলানিতে। প্রশাসন কঠোর না হলে হাল বদলাবে না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE