Advertisement
০৪ মে ২০২৪

একসাথে বাঁচবই, ওঁরা গল্প বললেন লড়াইয়ের

ভালবাসতে চেয়ে, কাছে থাকতে চেয়ে, আঁকড়ে ধরতে চেয়ে দেওয়া উপহার! শুধু তোমার জন্য। দ্যুতিময় হিরে, দামি বিদেশি চকোলেট, বহুমূল্য পোশাক, নাকি তার চেয়েও বেশি দামি কিছু? ও’ হেনরির বিখ্যাত গল্পে যেমন নিজের মেঘের মতো চুল বিক্রি করে স্বামীর প্রিয় ঘড়ির জন্য চেন কিনে আনেন নায়িকা। তত ক্ষণে অবশ্য স্ত্রীর চুলের জন্য চিরুনি কিনতে ঘড়িটি বিক্রি করেছেন নায়ক। কিন্তু ‘দ্য গিফট অব দ্য ম্যাজাই’-এর সেই অমর কাহিনিকেও যেন ম্লান করে দেয় আমাদের চার পাশের আপাত ছাপোষা কিছু দাম্পত্য জীবনের উপহার।

নিজের একটি কিডনি দিয়ে বাঁচিয়েছিলেন স্বামীকে। বৃহস্পতিবার এক হাসপাতালে সেই গল্পই শোনালেন বিষ্ণুমায়া মুখোপাধ্যায় ও ইন্দ্রদুলাল মুখোপাধ্যায়। দেশকল্যাণ চৌধুরীর তোলা ছবি।

নিজের একটি কিডনি দিয়ে বাঁচিয়েছিলেন স্বামীকে। বৃহস্পতিবার এক হাসপাতালে সেই গল্পই শোনালেন বিষ্ণুমায়া মুখোপাধ্যায় ও ইন্দ্রদুলাল মুখোপাধ্যায়। দেশকল্যাণ চৌধুরীর তোলা ছবি।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:৪৪
Share: Save:

ভালবাসতে চেয়ে, কাছে থাকতে চেয়ে, আঁকড়ে ধরতে চেয়ে দেওয়া উপহার! শুধু তোমার জন্য।

দ্যুতিময় হিরে, দামি বিদেশি চকোলেট, বহুমূল্য পোশাক, নাকি তার চেয়েও বেশি দামি কিছু? ও’ হেনরির বিখ্যাত গল্পে যেমন নিজের মেঘের মতো চুল বিক্রি করে স্বামীর প্রিয় ঘড়ির জন্য চেন কিনে আনেন নায়িকা। তত ক্ষণে অবশ্য স্ত্রীর চুলের জন্য চিরুনি কিনতে ঘড়িটি বিক্রি করেছেন নায়ক। কিন্তু ‘দ্য গিফট অব দ্য ম্যাজাই’-এর সেই অমর কাহিনিকেও যেন ম্লান করে দেয় আমাদের চার পাশের আপাত ছাপোষা কিছু দাম্পত্য জীবনের উপহার।

কিছু আশ্চর্য মানুষ। যাঁরা ভালবাসার মানুষটিকে হৃদয় তো আগেই দিয়েছিলেন, এ বার তাঁর জন্য নিজের শরীর থেকে একতাল মাংস কেটে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতেও মুহূর্ত সময় নেন না। ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’-র ঠিক দু’দিন আগে ফর্টিস হাসপাতালের সাততলার হলঘরে দেখা হয়েছিল এই রকম কিছু দম্পতির সঙ্গে। ভবিতব্যকে চ্যালেঞ্জ করে নিজেদের জীবন বাজি রেখে যাঁরা মৃত্যুর মুখ থেকে কেড়ে এনেছেন সঙ্গীকে। তাঁকে বাঁচিয়ে তুলেছেন নিজের একটি কিডনি দিয়ে।

আর এখানেই জিতে গিয়েছে এক আকাশ ভর্তি প্রেম। গুঁড়িয়ে গিয়েছে সময়ের সঙ্গে স্বামী-স্ত্রীর ভালবাসা ফিকে হয়ে যাওয়ার তত্ত্ব।

চোদ্দো বছর আগের এক পৌষমাসে সদ্য আঠারোয় পা দেওয়া রুমা-কে নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে বিয়ে করেছিলেন হাওড়া রামরাজাতলার দেবেন্দ্র। তিনি নিজেও তখন মেরেকেটে ২৩-২৪। আর্থিক সংস্থান ছিল না, কিন্তু ভালবাসায় আস্থা ছিল জবরদস্ত। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বজ্রপাত। হাসপাতালের হলঘরের টেবিলে বসে রুমার হাতটা ধরে সেই সময়ের কথা বলতে গিয়ে এখনও চোখ জলে ভরে যাচ্ছিল দেবেন্দ্রর। “ডাক্তারবাবু বললেন, ওর দু’টো কিডনিই নষ্ট। মরে যেতে পারে। ৪ বছর ধরে ডায়ালিসিস হল। ওর যা কষ্ট হতো, সহ্য করতে পারতাম না। ওর হাতে সুচ ফোটাত আর আমি বাথরুমে গিয়ে কাঁদতাম। তার পর এক দিন ঠিক করলাম, অনেক হয়েছে। রুমার হাত যখন এক বার ধরেছি তখন এই হাত কেউ কেটে না-দেওয়া পর্যন্ত ছাড়ব না। শেষ দেখব। ডাক্তারবাবুকে বললাম, ব্লাডগ্রুপ যখন মিলছে তখন আমি কিডনি দেব।”

ঝড় বয়ে গিয়েছিল পরিবারে। বেশির ভাগ আত্মীয়স্বজন বারণ করেছিলেন, ভয় দেখিয়েছিলেন। আবার বিয়ে করার পরামর্শ পর্যন্ত এসেছিল ‘যে মরছে সে মরছে, তার সঙ্গে যেচে মরার কী দরকার?’ কিন্তু সব আপত্তি উড়ে গিয়েছিল দেবেন্দ্রর একরোখাপনায়। ২০০৬-এ নিজের একটি কিডনি দিয়ে স্ত্রীকে বাঁচান দেবেন্দ্র। গল্প শোনাচ্ছিলেন অপারেশনের পরে যখন হুঁশ এল, তখন ডাক্তারেরা ব্যথা কমানোর ওষুধ দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি জানিয়েছিলেন, এত দিন বুকে যে মারাত্মক পাথরচাপা যন্ত্রণা ছিল সেটা যখন চলে গিয়েছে, তখন আর পেটের ব্যথার জন্য ওষুধ লাগবে না। শুনে লাজুক হেসে মুখ নামিয়েছেন রুমা। বলেছেন, “আমি শুধু ওকে বলেছিলাম ‘আমাকে বাঁচা। মরতে দিস না। আমি তোর সঙ্গে অনেক দিন বাঁচতে চাই।’ ও সেটা করেছে।”

হুগলির শিয়াখালার শেখ মহবুব অবশ্য পইপই করে বারণ করেছিলেন স্ত্রী নাফিসাকে। তাঁর থেকে প্রায় বছর দশেকের ছোট নাফিসা। মহবুব যখন অসুস্থ হলেন, নাফিসার কোলে সদ্যোজাত সন্তান। অনেকেই বলেছিলেন, কিডনি দিতে গিয়ে কোনও গোলমাল হলে নাফিসাও মারা যেতে পারেন। তখন বাচ্চাটার কী হবে? কিছুই অবশ্য নাফিসা বিবিকে টলাতে পারেনি। একগাল হেসে বলেন, “বাপের বাড়ি থেকে কত্ত বারণ করল। কিন্তু আমি ঠিক করে নিয়েছিলাম, ওকে বাঁচাতেই হবে। আমি কিডনি দেব, তার পর যা হবে আল্লা সামলাবে।” ২০০২ সালে দু’জনে একসঙ্গে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকেছেন। এসি ঘরের ঠান্ডায় নাফিসার শরীরে কাঁপুনি ধরছে আর তা দেখে মহবুব ভাবছেন, স্ত্রী বুঝি কিডনি দিতে ভয় পাচ্ছেন। বলেছিলেন, “এখনও বলো, আমি বারণ করে দিচ্ছি।” ধাতানি দিয়ে চুপ করিয়ে দিয়েছিলেন নাফিসা।

৩৯ বছরের দাম্পত্যজীবন বিষ্ণুমায়া ও ইন্দ্রদুলাল মুখোপাধ্যায়ের। বাড়ি বেহালা পর্ণশ্রীতে। ২০০২ সালে বিষ্ণুমায়া নিজের একটি কিডনি দিয়ে বাঁচিয়েছিলেন ইন্দ্রদুলালকে। সিদ্ধান্তটা স্ত্রীর ওপরেই ছেড়েছিলেন ইন্দ্রদুলাল। আর বিষ্ণুমায়া একটা কথা সাফ বুঝেছিলেন, ইন্দ্রদুলালকে ছাড়া তাঁর জীবনটা ঠিক ‘জীবন’ থাকবে না। ভয় দেখিয়েছিল অনেকে। কিন্তু মনস্থির করে ফেলার পর আর টলানো যায়নি বিষ্ণুমায়াকে। এমনকী অপারেশনের ঠিক আগের দিনও একটা বিয়েবাড়ি গিয়েছিলেন।

নেফ্রোলজিস্ট শিবাজি বসু বলছিলেন, “আমার দীর্ঘ চিকিৎসক জীবনে দেখেছি, স্বামীর জন্য স্ত্রী বা স্ত্রীর জন্য স্বামী কিডনি দিলে পরবর্তী কালে তাঁদের শারীরিক অসুবিধে অনেক কম হয়। ভাল ভাবে বাঁচতে পারেন তাঁরা। কেন এমন হয় ব্যাখ্যা দিতে পারব না। হয়তো মানসিক ব্যাপারটাও এর সঙ্গে জড়িত।” চিকিৎসক অরূপরতন দত্তের মতে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কিডনি দেওয়া-নেওয়া হলে দালালচক্র আটকানো যায়। রোখা যায় বেআইনি লেনদেন। আর কিডনি জোগাড়ের ঝক্কি তো কমেই। হাতের কাছে দাতা পাওয়া যায় বলে ডায়ালিসিস দরকার হয় না। দ্রুত কিডনি প্রতিস্থাপন করে রোগীকে ‘কোয়ালিটি লাইফ’ দেওয়া যায়। তাঁর বক্তব্য, “এখন এমন পদ্ধতি এসেছে যাতে স্বামী-স্ত্রী-র রক্তের গ্রুপ না মিললেও বিশেষ পদ্ধতিতে রক্তের অ্যান্টিবডি বাদ দিয়ে সেই কিডনি নেওয়া যায়। ফলে স্বামী বা স্ত্রী এগিয়ে আসতে চাইলে পদ্ধতিগত ভাবে বিষয়টা এখন আরও সহজ।”

পাশের টেবিলে পাশাপাশি বসে অরূপরতনবাবুর কথা শুনছিলেন শ্রীদাম পাত্র ও প্রতিমা পাত্র। বাড়ি পূর্ব মেদিনীপুরের পাঁশকুড়ার কৃষ্ণনগর গ্রামে। ২০১০ সালে নিজের একটি কিডনি স্বামী শ্রীদামকে দিয়েছিলেন প্রতিমা। শুধু প্রেম থেকেই তাগিদটা এসেছিল, নাকি মিশে ছিল দায়িত্ব-কর্তব্য? ব্যাখ্যা নেই প্রতিমার কাছে। শুধু একমুখ হাসি নিয়ে বললেন, “মানুষটার বড্ড রাগ। এখনও রেগে গেলে ভয়ানক চিৎকার করে। ভাতের থালা, দুধের গ্লাস উল্টে দেয়। আমার তখন খারাপ লাগে। আবার পর ক্ষণে মনে হয়, দেহের ভিতর আমার কিডনিখানা রয়েছে বলেই না অমন তেজ দেখাতে পারছে। ব্যস, তখনই আমার সব অভিমান জল হয়ে যায়।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

parijat bandyopadhyay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE