Advertisement
E-Paper

কালাজ্বর রুখতে বিহারে কাজ শুরু মুন্নি-মডেলে

উত্তরবঙ্গের এনসেফ্যালাইটিস নিয়ে মুখ পুড়েছিল রাজ্যের। সমালোচিত হতে হয়েছিল স্বাস্থ্যমন্ত্রকের কাছেও। এ বার সেই উত্তরবঙ্গেই অন্য একটি পতঙ্গবাহী রোগ কালাজ্বর প্রতিরোধে নজিরবিহীন সাফল্য পেয়ে মুখরক্ষা করল রাজ্য। দার্জিলিং জেলার ফাঁসিদেওয়া ব্লকের মুন্নি-তে কালাজ্বর নিয়ন্ত্রণে রাজ্য স্বাস্থ্যদফতরের নেওয়া পন্থাকেই এ বার গোটা দেশের মডেল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বাস্থ্যমন্ত্রক। ‘মুন্নি মডেল’-এ প্রথমে কালাজ্বর নিয়ন্ত্রণের কাজ শুরু হবে বিহারের ৩৩টি জেলায়।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায় ও সৌমিত্র কুণ্ডু

শেষ আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০১৪ ০২:২৫

উত্তরবঙ্গের এনসেফ্যালাইটিস নিয়ে মুখ পুড়েছিল রাজ্যের। সমালোচিত হতে হয়েছিল স্বাস্থ্যমন্ত্রকের কাছেও। এ বার সেই উত্তরবঙ্গেই অন্য একটি পতঙ্গবাহী রোগ কালাজ্বর প্রতিরোধে নজিরবিহীন সাফল্য পেয়ে মুখরক্ষা করল রাজ্য।

দার্জিলিং জেলার ফাঁসিদেওয়া ব্লকের মুন্নি-তে কালাজ্বর নিয়ন্ত্রণে রাজ্য স্বাস্থ্যদফতরের নেওয়া পন্থাকেই এ বার গোটা দেশের মডেল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বাস্থ্যমন্ত্রক। ‘মুন্নি মডেল’-এ প্রথমে কালাজ্বর নিয়ন্ত্রণের কাজ শুরু হবে বিহারের ৩৩টি জেলায়। কারণ, দেশের মধ্যে বিহারেই কালাজ্বর আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। তিন বছর আগে মুন্নি গ্রামেও তিনশো-র বেশি মানুষ প্রতি বছর কালাজ্বরে আক্রান্ত হতেন সেখানে এখন বছরে খুব বেশি হলে ২-৩ জন আক্রান্ত হন। বুধবার কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য অধিকর্তা জগদীশ প্রসাদ এবং কেন্দ্রীয় পতঙ্গবাহিত রোগ প্রতিরোধ কর্মসূচির অধিকর্তা অক্ষয় ধারিওয়াল সরজমিনে মুন্নি-তে এসে সেখানে কালাজ্বর নিয়ন্ত্রণের কাজ সরেজমিনে ঘুরে দেখেন। পশ্চিমবঙ্গের কাজের প্রশংসা করে তাঁরা জানান, বিহারের কালাজ্বরপ্রবণ ১৮০ ব্লকে এই মডেল অনুসরণ করেই ২০১৫ সালের মধ্যে তাদের কালাজ্বর নির্মূল অঞ্চলে পরিণত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

শিলিগুড়ি থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে মুন্নি গ্রাম। বাসিন্দারা বেশিরভাগই আদিবাসী এবং রাজবংশী সম্প্রদায়ের। কাছাকাছি বিভিন্ন চা বাগানে কাজ করেন, দরিদ্র। মাটির বাড়ির সংখ্যা অনেক। এই সব বাড়ির মেঝে এবং দেওয়ালের ফাটলে স্যান্ডফ্লাই বা বেলেমাছি বাসা করে এবং ডিম পাড়ে। বেলেমাছির কামড়ে কালাজ্বর হয়। দার্জিলিং জেলার কালাজ্বরপ্রবণ তিনটি ব্লকের অন্যতম ফাঁসিদেওয়া। এই ব্লকের মুন্নি, ভিমবার-এর মতো কয়েকটি গ্রাম তিন-চার বছর আগেও রোগের প্রকোপে জর্জরিত ছিল। স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারাই জানিয়েছেন, ২০১০-১১ সালেও মুন্নি-র ৩৩০টি বাড়ির প্রত্যেকটিতে অন্তত এক জন বাসিন্দা কালাজ্বরে আক্রান্ত হতেন। ২০১১ সালে গোটা দার্জিলিং জেলায় ৩৮৪ জন কালাজ্বরে আক্রান্ত হন তার মধ্যে ৩৪১ জন ছিলেন মুন্নির বাসিন্দা। কিন্তু কালাজ্বর নিয়ন্ত্রণে বিশেষ কর্মসুচি নেওয়ার পর পরিস্থিতি বদলে যায়। ২০১২ সালে মুন্নিতে আক্রান্তের সংখ্যা কমে হয় ১১২। ২০১৩ সালে ১১ আর ২০১৪ সালে এখনও পর্যন্ত মাত্র ৩ জন আক্রান্ত হয়েছেন।

কী ভাবে এটা সম্ভব হল?

রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী জানান, পঞ্চায়েত এবং স্থানীয় চা বাগানের মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করে তাঁদের থেকে অর্থসাহায্যের ব্যবস্থা করা হয়। সেই টাকায় গ্রামের সব বাড়ির মেঝে পাকা করা হয়। মেঝে থেকে দেওয়ালের চার ফুট পর্যন্ত পলিথিনের শিট দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয় যাতে দেওয়ালের ফাটলে বেলেমাছি জিম পারতে না-পারে। অনেক বাড়িতে আবার সিমেন্টের সঙ্গে বিশেষ ধরনের রাসায়নিক মিশিয়ে দেওয়াল ও মেঝের ফাটল বোজানো হয়। ফলে মাছির বংশবৃদ্ধি অনেক কমে। এতে বাড়িপিছু ৬-৭ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। সেই সঙ্গে পাড়ায়-পাড়ায় নিয়মিত ডিডিটি স্প্রে ছড়ানোর কাজে এবং জ্বরে আক্রান্ত রোগীর খোঁজ করে তাঁকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার কাজে নিযুক্ত করা হয় আশাকর্মীদের। এর জন্য আলাদা করে তাঁদের মাসে ৩০০ টাকা করে দেওয়া হয়। কালাজ্বরের রোগীরা যাতে নিজেরা উদ্যোগী হয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যায় তার জন্য তাঁদের ১৪০০ টাকা করে দেওয়া শুরু হয় এবং এতেই ম্যাজিকের মতো ফল পাওয়া যায়।

বুধবার সকালেই কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যকর্তাদের নিয়ে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারা মুন্নিগ্রাম ঘুরিয়ে দেখান। বোরকু হিমব্রম, প্রদীপ লাকড়া, কিরণ লোহারের মতো কিছু বাসিন্দার বাড়ি তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয়। কী ভাবে সেই বাড়ির মেঝে ও দেওয়ালের ফাটল বুজিয়ে বেলেমাছি নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে তা দেখানো হয়। স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথাও বলেন কেন্দ্রীয় কর্তারা। রোশনী হেমব্রম, সঞ্জীব হেমব্রম, প্যাট্রিক বরায়াদের মতো অনেকে তাঁদের জানান, গ্রামে বছর দু’য়েক আগেও কালাজ্বর লেগেই থাকত, এখন অবস্থা অনেক ভাল। তবে মুন্নিতে কালাজ্বর কমলেও আশপাশের কয়েকটি গ্রামে নতুন করে কালাজ্বর ছড়াচ্ছে বলে অভিযোগও করেন তাঁরা। বিষয়টি খোঁজ করে দেখার আশ্বাস দিয়েছেন স্বাস্থ্যকর্তারা।

মুন্নি থেকে দিল্লি ফেরার পথে বাগডোগরা বিমানবন্দর থেকে টেলিফোনে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যঅধিকর্তা জগদীশপ্রসাদ বলেন, “কালাজ্বর নিয়ন্ত্রণে পশ্চিমবঙ্গ দারুণ কাজ করেছে। এতদিন কানে শুনছিলাম, এখন চোখে দেখে আমরা সব দেখে খুব খুশি। মুন্নি-মডেল অবিলম্বে আমরা বিহারের জন্য ব্যবহার করতে চলেছি। ২০১৫-র মধ্যে দেশ থেকে কালাজ্বর খতম করতেই হবে আর সে ব্যাপারে মুন্নি পথ দেখাতে পারে।” তাঁর আরও বক্তব্য, “পশ্চিমবঙ্গের বড়তি সুবিধা হল, এখানে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বেশি, আশা কর্মীরা এবং প্রশাসন এখানে ভাল কাজ করছে। বিহারে বিষয়টা এতটা সহজ হবে না। তবে আশা করছি মুন্নি মডেল অনেকটা সাহায্য করবে।”

kala azar parijat bandyopadhyay soumitra kundu north bengal
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy