Advertisement
১১ মে ২০২৪

কর্মী নেই, এক্স-রে মেশিন থেকেও বন্ধ

পরিকাঠামোর অভাব আর কর্মী সঙ্কটে জেরবার সরকারি হাসপাতাল। অথচ এলাকায় নেই বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবাও। ফলে বাধ্য হয়ে সেই সরকারি হাসপাতালের উপরেই নির্ভরশীল বাঁকুড়ার জঙ্গলমহল রাইপুর ব্লকের বিস্তীর্ণ এলাকার বাসিন্দারা। কারণ জনসংখ্যার পাল্লা যত বাড়ছে, ততই বাড়ছে রোগীর সংখ্যা।

দেবব্রত দাস
রাইপুর শেষ আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০২:৫৭
Share: Save:

পরিকাঠামোর অভাব আর কর্মী সঙ্কটে জেরবার সরকারি হাসপাতাল। অথচ এলাকায় নেই বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবাও। ফলে বাধ্য হয়ে সেই সরকারি হাসপাতালের উপরেই নির্ভরশীল বাঁকুড়ার জঙ্গলমহল রাইপুর ব্লকের বিস্তীর্ণ এলাকার বাসিন্দারা। কারণ জনসংখ্যার পাল্লা যত বাড়ছে, ততই বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। কিন্তু প্রায় হাজার বছরের পুরনো এই জনপদে এখনও গড়ে ওঠেনি বেসরকারি কোনও হাসপাতাল বা নার্সিংহোম। নেই কোনও পলি ক্লিনিকও। তাই বিশেষজ্ঞ চিকিত্‌সককে দেখানোর জন্য ৬২ কিলোমিটার দূরে বাঁকুড়া বা ৬০ কিলোমিটার দূরের ঝাড়গ্রামে ছুটে যেতে হয় রোগীকে। মোটা টাকা খরচ করে চিকিত্‌সা করাতে গিয়ে অনেকেই তাই নিঃস্ব হতে বসেছেন।

বাসিন্দাদের অভিযোগ, সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রাথমিক চিকিত্‌সাটুকু মেলে। একটু বাড়াবাড়ি হলেই রোগীকে স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে অন্যত্র স্থানান্তর করে দায় সারা হয়। কাছেপিঠে নার্সিংহোম থাকলে এই সমস্যা হতো না। এ দিকে, পরিকাঠামোর অভাব ও কর্মী সঙ্কটে জেরবার রাইপুর গ্রামীণ হাসপাতাল। ফলে পশ্চিম মেদিনীপুরের সীমানা লাগোয়া দক্ষিণ বাঁকুড়ার জঙ্গলমহলের এই গ্রামীণ হাসপাতালে চিকিত্‌সা পরিষেবা প্রতিনিয়ত ব্যাহত হচ্ছে। এমনটাই অভিযোগ রোগী ও তাঁদের পরিবারের লোকজনের।

দক্ষিণ বাঁকুড়ার জঙ্গলমহলের এই ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি বছর দশেক আগেই গ্রামীণ হাসপাতালে উন্নীত হয়েছে। রাইপুর ব্লকে তিনটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র ফুলকুসমা, মটগোদা ও ডুমুরতোড়, ৩৩টি উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে। রাইপুর থানার ঢেকো, বক্সি, মণ্ডলকুলি, সাতপাট্টা, ধানাড়া, মটগোদা থেকে বারিকুল থানার শ্যামসুন্দরপুর, মেলেড়া, ফুলকুসমা, গোজদা, লুড়কা-সহ বহু গ্রাম থেকে রোগীরা এই গ্রামীণ হাসপাতালে চিকিত্‌সা করাতে আসেন। এরই পাশাপাশি পশ্চিম মেদিনীপুরের বেলপাহাড়ি ও বিনপুর থানা এলাকা থেকেও বহু রোগী এই গ্রামীন হাসপাতালে আসেন। প্রতিদিন বহির্বিভাগে ৩০০ থেকে ৪০০ রোগীর ভিড় হয়। জঙ্গলমহলের প্রায় দু’লক্ষ মানুষ এই হাসপাতালের উপরে নির্ভরশীল। কিন্তু পরিকাঠামোগত ঘাটতির সঙ্গে কর্মীর অভাবে গুরুতর অসুস্থ রোগীদের প্রায় সময়ই বাঁকুড়া মেডিক্যালে রেফার করতে বাধ্য হচ্ছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। অনেক সময় এ নিয়েই রোগীর আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে গণ্ডগোল হচ্ছে স্বাস্থ্যকর্মীদের।

হাসপাতালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চিকিত্‌সক পদ ৫। বর্তমানে রয়েছেন ৪ জন। নার্স থাকার কথা ১২, রয়েছেন ৭ জন। সাফাইকর্মীর পদ ৯, এখন রয়েছেন মাত্র ৩ জন। চতুর্থ শ্রেণির কর্মী পদ ১৬, রয়েছেন ৯ জন। এ ছাড়াও হাসপাতালে স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞ কোনও চিকিত্‌সক নেই। নেই অ্যানাস্থেটিস্টও। এক্সরে টেকনিশিয়ান পদ ২, কেউ নেই। বক্সিবাজারের বাসিন্দা অপূর্ব মণ্ডলের ক্ষোভ, “মাস দুয়েক আগে পথ দুর্ঘটনায় আহত হয়ে রাইপুর গ্রামীন হাসপাতালে গিয়েছিলাম। হাসপাতালে এক্স-রে হয় বলে শুনেছিলাম। কিন্তু টেকনিশিয়ান না থাকায় এক্স-রে ওখানে হয়নি। শেষে বাইরে থেকে এক্স-রে করিয়ে আনতে হয়েছিল। সরকারি হাসপাতালে এক্স-রে মেশিন থাকার পরেও যদিও বাইরে থেকে করাতে হয় তাহলে এসব থেকে আর লাভ কী?” এই হাসপাতালে শয্যার সংখ্যা ৩০টি। কিন্তু প্রতিদিন গড়ে ৬০ থেকে ৮০ জন রোগীকে ভর্তি করতে হয়। ফলে একটা শয্যায় অনেক সময়ে দু’জন রোগী রাখতে হয়। মেঝেতেও রোগীদের জায়গা করে দিতে হয়।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, এই গ্রামীণ হাসপাতালে প্রসূতিদের সিজারের ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু এখানে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞই নেই, নেই অ্যানাস্থেটিস্টও। ফলে অধিকাংশ সময় সিজার করা তো দূরের কথা, প্রসূতিদের শারীরিক অবস্থা খারাপ হলে বাঁকুড়া মেডিক্যালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এই হাসপাতালে চিকিত্‌সা করাতে আসা বেশ কিছু রোগীর অভিজ্ঞতা তেমনই। রাইপুরের ঢেকো গ্রামের বাসিন্দা সুদর্শন মণ্ডল তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী-কে গত অগস্ট মাসে রাইপুর গ্রামীণ হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর অভিযোগ, “পরীক্ষা করে চিকিত্‌সক সিজার করতে হবে জানিয়ে অন্যত্র পাঠিয়ে দেন। বাধ্য হয়ে রাতেই বাঁকুড়ার একটি নার্সিংহোমে স্ত্রীকে নিয়ে যেতে হয়েছিল। কাছাকাছি একটা নার্সিংহোম থাকলে সেখানে ভর্তি করিয়েও সিজার করানো যেত। কিন্তু সে সুযোগও এখানে কোথায়?’’

স্থানীয় ভাবে রাইপুরের কিছু ওষুধের দোকানদার ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাইরে থেকে কয়েকজন বিশেষজ্ঞ চিকিত্‌সকে নিয়ে এসে বসাচ্ছেন। কিন্তু সেই সংখ্যাটাও যথেষ্ট কম। নির্দিষ্ট দিনে কয়েক ঘণ্টার জন্য ওই চিকিত্‌সককে এলাকায় পাওয়া যায়। বাকি সময়ে আর চিকিত্‌সকদের দেখা মেলে না। দু’-একটা প্যাথোলজি সেন্টার গড়ে ওঠলেও সেখানে রক্ত পরীক্ষা বা এক্স-রে ছাড়া বিশেষ কিছু হয় না বলে বাসিন্দাদের অভিযোগ। স্থানীয় ওষুধ ব্যবসায়ী আকাশ মণ্ডল বলেন, “রোগীদের সুবিধার্থেই আমরা বাইরে থেকে বড় বড় চিকিত্‌সককে নিয়ে আসছি। তবে রোগীর সংখ্যা কম এবং আরও কিছু কারণে অনেকে এখানে আসতে চান না।”

রাইপুর পঞ্চায়েত সমিতির সহ-সভাপতি শান্তিনাথ মণ্ডল অবশ্য দাবি করেন, “সিপিএমের রাজত্বে শুধু গ্রামীন হাসপাতালের ঘোষণাটুকু হয়েছিল। কাজ কিছুই হয়নি। আমাদের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই গ্রামীন হাসপাতালের উন্নয়নের জন্য একগুচ্ছ পরিকল্পনা নিয়েছেন। ১০০ শয্যার নতুন হাসপাতাল ভবন তৈরি করা হয়েছে। উন্নত পরিষেবাও মিলবে।” তবে সমস্যার কথা স্বীকার করেছেন রাইপুরের বিএমওএইচ কুণাল চক্রবর্তী। তিনি বলেন, “পরিকাঠামোর সমস্যা থেকে চিকিত্‌সক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীর ঘাটতি রয়েছে। কর্তৃপক্ষকে সব জানানো হয়েছে।” একই সঙ্গে তাঁর দাবি, “এত সমস্যার মধ্যেও পরিষেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি আমরা। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া রোগীদের স্থানান্তর করা হয় না।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

raipur debabrata das health service
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE