এসএসকেএম চত্বরে অ্যাম্বুল্যান্সের অভাব নেই। কিন্তু প্রয়োজনে পাওয়া যাবে কি? —নিজস্ব চিত্র
ট্যাক্সির মতো এখন অ্যাম্বুল্যান্সও সটান জানিয়ে দিচ্ছে ‘যাব না।’ চলছে ভাড়া নিয়ে দর কষাকষিও। আর ট্যাক্সির মতো অ্যাম্বুল্যান্সের উপরেও কার্যত নিয়ন্ত্রণ নেই রাজ্য সরকারের।
কোন দূরত্বে যাওয়া হবে, কত ভাড়া নেওয়া হবে, সে নিয়ে মুমূর্ষু রোগীর পরিজনদের সঙ্গে বহু ক্ষেত্রেই বচসায় জড়িয়ে পড়ছেন চালকেরা। রোগীকে নিরাপদে হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়াটাই যাঁদের দায়িত্ব, তাঁদের বিরুদ্ধেই নানা ভাবে রোগী শোষণের অভিযোগ উঠছে। গত এক মাসে কলকাতা ও জেলা থেকে এমন ২৪টি অভিযোগ জমা পড়েছে স্বাস্থ্য দফতরে। কোথাও রোগী বা তাঁর পরিবার, কোথাও আবার হাসপাতালের চিকিৎসকেরা অ্যাম্বুল্যান্স চালকদের দাপটের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন।
হালিশহর থেকে রোগীকে নিয়ে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আসার কথা ছিল আম্বুল্যান্সের। কিন্তু তা গিয়ে থামল একটি নার্সিংহোমের সামনে। রোগীর বাড়ির লোকজন হতভম্ব। এখানে আসার কথা তো তাঁরা বলেননি। তা হলে? অ্যাম্বুল্যান্স চালকের নির্বিকার জবাব, “ওখানে বেড নেই। তাই এখানেই আসতে হত আপনাদের। সময় বাঁচিয়ে দিলাম।”
এসএসকেএম হাসপাতাল থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতাল। এসএসকেএম হাসপাতালের নেফ্রোলজি বিভাগ থেকে রোগীকে রেফার করা হল সেখানে। হাসপাতাল চত্বরে থাকা একটি অ্যাম্বুল্যান্সে রোগীকে তুললেন পরিজনেরা। চালক জানালেন, ৫০০ টাকা লাগবে। ওইটুকু দূরত্বে ৫০০ টাকা কেন? প্রশ্ন তুলতেই গাড়ি থামিয়ে স্ট্রেচার সমতে রোগীকে হাসপাতাল চত্বরে নামিয়ে দিলেন চালক।
এ ভাবেই চলছে দিনের পর দিন। হাসপাতাল চত্বরের ভিতরে ও হাসপাতালের সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অ্যাম্বুল্যান্স দাঁড় করিয়ে রাখা নিয়মবিরুদ্ধ। দিন কয়েক আগে মুর্শিদাবাদ জেলা হাসপাতালে বেআইনি ভাবে জায়গা আটকে রাখা অ্যাম্বুল্যান্স পুলিশ জোর করে সরিয়ে দিয়েছিল। তার প্রতিবাদে অ্যাম্বুল্যান্স চালকেরা এমন একটি জরুরি পরিষেবা বন্ধ করে দেন যে, সময়ে হাসপাতালে পৌঁছতে না পেরে মৃত্যু হয় এক তরুণীর। এই ঘটনা নিয়ে গোটা জেলা তোলপাড় হয়। বীরভূমের রামপুরহাট হাসপাতালেও অ্যাম্বুল্যান্স চালকদের ধর্মঘটে মৃত্যু হয় এক রোগীর। স্বাস্থ্যকর্তারা জানিয়েছেন, এমন ঘটনা কলকাতা শহরেও আকছার ঘটছে।
রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তারা স্বীকার করেছেন, সরকারি অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবার দুরবস্থার জন্যই বেসরকারি অ্যাম্বুল্যান্স চালকেরা এমন বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারছেন। সরকারি হাসপাতালে নাম-কা-ওয়াস্তে অ্যাম্বুল্যান্স থাকে ঠিকই। কিন্তু তার বেশির ভাগই অকেজো। কোথাও আবার অ্যাম্বুল্যান্স থাকলেও চালক থাকেন না। ফলে মওকা বুঝে দাঁও মারেন অ্যাম্বুল্যান্স চালকেরা।
কলকাতার বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে গিয়ে দেখা গিয়েছে, সকাল ন’টার পর থেকেই বিভিন্ন হাসপাতালের ইমার্জেন্সি বিল্ডিং-এর অদূরে দাঁড়িয়ে থাকে অন্তত ১০ থেকে ১২টি অ্যাম্বুল্যান্স। এর মধ্যে হাসপাতালের নিজস্ব একটিও নেই। হাসপাতালের নিরাপত্তাকর্মীরা জানতে চাইলেই এক বাক্যে সব অ্যাম্বুল্যান্সের চালক জানিয়ে দেন, ইমার্জেন্সি বা আউটডোরে গুরুতর অসুস্থ রোগীকে নিয়ে এসেছেন তাঁরা। ওই অ্যাম্বুল্যান্সেই রোগী ফেরত যাবেন, তাই অপেক্ষা করছেন। কিন্তু কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেই যে কেউ বুঝতে পারবেন, ওই ১০-১২টি অ্যাম্বুল্যান্সের মধ্যে অন্তত সাত-আটটি ‘খদ্দের’ খোঁজায় ব্যস্ত। দেখা যাবে, ‘গুরুতর রোগীকে নিয়ে আসা’ অ্যাম্বুল্যান্সের চালকই অন্য রোগীর পরিবারের লোকের সঙ্গে রীতিমতো দরদস্তুর শুরু করে দিয়েছেন। কখনও কখনও আবার ‘অ্যাডভ্যান্স বুকিং’ও চলছে!
এসএসকেএমে দাঁড়িয়ে থাকা এক অ্যাম্বুল্যান্স চালক জানালেন, ঝামেলা এড়াতে দু’টাকা দিয়ে একটা আউটডোর টিকিট কেটে রাখেন তাঁর সহকারী। হাসপাতালে পুলিশ কিছু জিজ্ঞাসা করলে ওই টিকিটটি দেখানো হয়।
স্বাস্থ্যকর্তারা জানিয়েছেন, কিছুদিন আগে স্থির হয়েছিল, অ্যাম্বুল্যান্সগুলিকে হাসপাতালে দাঁড়াতে হলে দু’ঘণ্টার জন্য স্লিপ করাতে হবে। তার পরেও যদি থাকতে হয়, তা হলে সঙ্গত কারণ উল্লেখ করে স্লিপ রিনিউ করাতে হবে। কেউ যদি তা না করেন তাহলে নিরাপত্তাকর্মীরা সেই অ্যাম্বুল্যান্স হাসপাতালের বাইরে বার করে দেবেন। কিন্তু কোনও কিছু করেই লাভ হয়নি। কারণ, নিরাপত্তাকর্মীদের একাংশের সঙ্গেও অ্যাম্বুল্যান্স চালকদের যোগশাজস রয়েছে।
সাধারণ মানুষ তবে কী করবেন? কোনও দিশা দেখাতে পারেনি স্বাস্থ্য দফতর। স্বাস্থ্য-অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী বলেন, “অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা নিয়ন্ত্রণের কোনও ক্ষমতাই সরকারের নেই। নির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে আমরা বড়জোর সেটা তদন্ত করে দেখতে পারি। তার চেয়ে বেশি কিছু নয়।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy