Advertisement
১১ মে ২০২৪

ডাক্তার নেই, রোগী দেখলেন বহিরাগত

নীল কলারের সাদা-কালো ডোরাকাটা টি-শার্ট পরে একের পর এক রোগী দেখছেন তিনি। টুকটাক সাহায্য করছেন এক নার্স। পুজোর চার দিনই এ ভাবে সাদা কাগজে ওষুধ লিখে, রোগীদের বুকে স্টোথোস্কোপ লাগিয়ে কাটোয়া ২ ব্লকের অগ্রদ্বীপ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ‘চিকিৎসা’ চালালেন সোমনাথ ভট্টাচার্য। তবে তিনি কোনও চিকিৎসক নন, ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কোনও কর্মীও নন।

রোগী দেখতে ব্যস্ত সোমনাথবাবু।—নিজস্ব চিত্র।

রোগী দেখতে ব্যস্ত সোমনাথবাবু।—নিজস্ব চিত্র।

সৌমেন দত্ত
কাটোয়া শেষ আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০১৪ ০১:৪৯
Share: Save:

নীল কলারের সাদা-কালো ডোরাকাটা টি-শার্ট পরে একের পর এক রোগী দেখছেন তিনি। টুকটাক সাহায্য করছেন এক নার্স। পুজোর চার দিনই এ ভাবে সাদা কাগজে ওষুধ লিখে, রোগীদের বুকে স্টোথোস্কোপ লাগিয়ে কাটোয়া ২ ব্লকের অগ্রদ্বীপ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ‘চিকিৎসা’ চালালেন সোমনাথ ভট্টাচার্য। তবে তিনি কোনও চিকিৎসক নন, ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কোনও কর্মীও নন। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সঙ্গে যোগসূত্র বলতে সোমনাথবাবুর স্ত্রী ওই হাসপাতালের নার্স ছিলেন।

বুধবার থেকে শনিবার পর্যন্ত হাসপাতালের বহির্বিভাগে আসা রোগীদের দেখার পরে এ বিষয়ে সোমনাথবাবুকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, “আমি রোগীদের উপকারই করেছি।” কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, চিকিৎসা সংক্রান্ত কোনও তালিম, অভিজ্ঞতা ছাড়া কী ভাবে টানা চার দিন চিকিৎসা করে গেলেন তিনি? হাসপাতালের বাকি কর্মীরাও কোনও প্রতিবাদ করলেন না বা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে কিছু জানালেন না কেন?

অগ্রদ্বীপ স্বাস্থ্যকেন্দ্র সূত্রে জানা গিয়েছে, মাসকয়েক আগে সোমনাথবাবুর স্ত্রী সন্ধ্যাদেবী প্রয়াত হন। তার পরেও মানবিকতার খাতিরে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের আবাসনে থাকতে দেওয়া হয় তাঁদের। এর মধ্যেই ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসক উচ্চশিক্ষার জন্য ছুটিতে যান। ফার্মাসিস্টও পুজোর চারদিন ছুটি নেন। এ অবস্থায় নিজেই এগিয়ে হাসপাতালের বহির্বিভাগে বসে রোগী দেখার দায়িত্ব নেন সোমনাথবাবু। এই চারদিন হাসপাতালে সোমনাথবাবুকে সাহায্য করছিলেন নার্স পিয়ালি মণ্ডল। তাঁর সাফ কথা, “চিকিৎসক নেই। ফার্মাসিস্ট ছুটিতে। তার বদলে সোমনাথবাবু রোগীদের স্বেচ্ছায় দেখেছেন। তাঁর স্ত্রী নার্স হওয়ার সুবাদে সোমনাথবাবুর একটু হলেও অভিজ্ঞতা রয়েছে। তা থেকেই জ্বরজ্বালার ওষুধ দিয়েছেন তিনি।” যদিও এ ক’দিন হাসপাতালে আসা, অগ্রদ্বীপের রেল স্টেশন এলাকার বাসিন্দা, কাটোয়া কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র কামাল দাস থেকে স্থানীয় পলাশি গ্রামের চিত্ত ঘড়ুইদের দাবি, “সোমনাথবাবু গলায় স্টেথোস্কোপ দিয়ে চিকিৎসা করেছেন। তারপর সাদা কাগজে ওষুধ লিখে দিয়েছেন। ওষুধ নেওয়ার পরেই কাগজটা জোর করে চতুর্থ শ্রেণির কর্মী ছিঁড়ে দিয়েছেন।”

খবর পাওয়ার পরেই ছুটিতে থাকা কাটোয়া ২-এর বিএমওএইচ চন্দ্রশেখর মাইতি খোঁজখবর নিতে শুরু করেন। অগ্রদ্বীপেরই বাসিন্দা, স্থানীয় সিঙ্গী প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রর ফার্মাসিস্টকে তদন্তের দায়িত্ব দেন তিনি। ওই ফার্মাসিস্ট খোঁজখবর নিয়ে রবিবার দুপুরেই বিস্তারিত ভাবে ফোনে ঘটনাটি বিএমওএইচকে জানান। মৌখিক রিপোর্ট পাওয়ার পরে বিএমওএইচ বলেন, “সোমনাথবাবু চিকিৎসা করছিলেন বলে জানতে পেরেছি। এর পিছনে নার্সদেরও মদত রয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা নেব।” সোমনাথবাবুর অবশ্য দাবি, “আমার কী আর চিকিৎসা করার যোগ্যতা আছে! দিদিমনিদের সাহায্য করেছি। এতে তো রোগীদের উপকারই হয়েছে।” কাটোয়া ২ পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষ তথা তৃণমূলের ওই ব্লকের সভাপতি সুব্রত মজুমদারও স্বীকার করে নেন, সোমনাথবাবু রোগী দেখেছেন। তাঁর কথায়, “দূরদূরান্তের রোগীদের তো ফিরে যেতে হয়নি। সে জন্য কিছু বলাও যাচ্ছে না।”

ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের উপর কাটোয়ার গাজিপুর, অগ্রদ্বীপ, পূর্বস্থলীর একাংশ বাসিন্দা নির্ভরশীল। প্রতিদিন বহির্বিভাগে গড়ে ২০০ রোগী চিকিৎসার জন্য আসেন। তবে দশ শয্যার হাসপাতালে উন্নীত হলেও চিকিৎসকের অভাবে সম্পূর্ণ চালু হয়নি ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্র। কাটোয়ার কংগ্রেস বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “এই একটা চিত্রেই রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দৈন্যদশা ফুটে উঠেছে।” তৃণমূলের ব্লক সভাপতি সুব্রতবাবুর অবশ্য দাবি, “স্বাস্থ্য দফতরে চিঠি দিয়েছি। স্বাস্থ্যকর্তাদের সঙ্গে দেখা করে চিকিৎসকের দাবিও জানিয়েছি।” জেলা স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, আগামী বছরের জুন-জুলাইয়ের আগে বর্ধমান জেলায় চিকিৎসকের সঙ্কট মেটার সম্ভাবনা খুবই কম।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE