সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে বহু প্রসূতির মৃত্যু হয়। কোথাও তার কারণ অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, কোথাও সংক্রমণ, কোথাও বা অন্য কিছু। কিন্তু তাঁদের শারীরিক সঙ্কটের পিছনে হাসপাতালের পরিকাঠামোগত ঘাটতি, চিকিৎসায় গাফিলতি, প্রসূতিকে হাসপাতালে আনতে দেরি করা অথবা পরিবারের তরফে কোনও গলদ ছিল কি না তা অজানাই থেকে যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সব সম্ভাব্য কারণ খতিয়ে দেখা হয় না বলেও প্রসূতি-মৃত্যু আটকাতে সমস্যা হচ্ছে।
সমস্যার শিকড় খুঁজে বার করার জন্য বছরখানেক আগে প্রসূতি-মৃত্যুর ব্যাপারে অডিট চালু করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কী রকম এই অডিট?
স্বাস্থ্যকর্তারা জানান, এই অডিট আসলে কিছু প্রশ্নের যথাযথ উত্তর সন্ধান। প্রশ্নগুলো এই ধরনের:
• প্রসূতিকে হাসপাতালে আনতে দেরি হয়েছে কি না?
• আনার সময় গাড়ি ছিল কি না?
• হাসপাতালে চিকিৎসক-নার্স ছিলেন কি না?
• তাঁরা ঠিক সময়ে প্রয়োজনীয় ওষুধ এবং অন্যান্য পরিষেবা দিয়েছেন কি না?
এই সব প্রশ্নের জবাব পাওয়ার জন্যই অডিট। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, কোনও প্রসূতির মৃত্যু হলেই এই অডিট হবে অর্থাৎ মৃত্যুর কারণ যাচাই করা হবে। উদ্দেশ্য, প্রসূতি-মৃত্যুর সম্ভাব্য সব কারণ চিহ্নিত করে তার মোকাবিলায় উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া। কিন্তু গত এক বছরে সরকারের এই সদিচ্ছার প্রতিফলন বিশেষ দেখা যায়নি! স্বাস্থ্য ভবনের খবর, গত এক বছরে সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যত প্রসূতির মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে, তার প্রায় অর্ধেক ক্ষেত্রেই কোনও অডিট করা হয়নি।
কেন এমন হচ্ছে, তা জানতে চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সম্প্রতি প্রতিটি জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য অধিকর্তাদের কার্যত ভর্ৎসনা করে চিঠি পাঠিয়েছেন রাজ্যের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কমিশনার সঙ্ঘমিত্রা ঘোষ। অবিলম্বে প্রসূতি-মৃত্যুর প্রতিটি ঘটনার অডিট করে স্বাস্থ্য ভবনে রিপোর্ট পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। তাঁর কথায়, “যে-উদ্দেশ্যে অডিটের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তা পূরণ করতে গিয়ে ব্লক ও জেলা স্তরে সমন্বয় ও নজরদারিতে বড় ফাঁক থেকে যাচ্ছে।” এই তদন্ত হওয়ার কথা প্রধানত দু’ভাগে। প্রথমত, প্রসূতির বাড়ি যেখানে, সেই এলাকায় গিয়ে। দ্বিতীয়ত, যেখানে প্রসূতির মৃত্যু হয়েছে, সেই চিকিৎসা কেন্দ্রে।
বিভিন্ন জেলা থেকে স্বাস্থ্য ভবনে পাঠানো রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, বর্ধমান, পশ্চিম মেদিনীপুর, মুর্শিদাবাদ, কোচবিহার, দক্ষিণ ২৪ পরগনার মতো জেলায় স্বাস্থ্যকর্মীরা অধিকাংশ মৃত প্রসূতির এলাকায় বা বাড়িতে গিয়ে কোনও তদন্তই করেননি। প্রসূতির মৃত্যুর পিছনে হাসপাতালের পরিকাঠামো বা ডাক্তার-নার্সদের কোনও গাফিলতি ছিল কি না বীরভূম, উত্তর ২৪ পরগনা, হাওড়া, মালদহ, পুরুলিয়া, নদিয়া, হুগলি, পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর, দক্ষিণ দিনাজপুরের মতো জেলায় অনেক ক্ষেত্রে সেটা খতিয়ে দেখা হয়নি। “স্রেফ আলস্য ও গাফিলতিতেই কাজটা করা হচ্ছে না,” অভিযোগ করলেন মা ও শিশুর মৃত্যু রুখতে গঠিত বিশেষ টাস্ক ফোর্সের চেয়ারম্যান ত্রিদিব বন্দ্যোপাধ্যায়।
জেলার স্বাস্থ্যকর্তারা কী বলছেন?
পশ্চিম মেদিনীপুরের মুখ্য স্বাস্থ্য অধিকর্তা গিরীশচন্দ্র বেরার কথায়, “সমস্যা আসলে অভ্যাসের। কোনও দিন নিয়ম করে এই রকম তদন্তের অভ্যাস তো ছিল না। নতুন নিয়মে অভ্যস্ত হতে সময় লাগছে।” লোকাভাবের কারণ দেখাচ্ছেন বীরভূমের মুখ্য স্বাস্থ্য অধিকর্তা কার্তিকচন্দ্র মণ্ডল। তিনি বলেন, “আমার জেলায় স্বাস্থ্যকর্মীর অভাব। তার উপরে প্রসূতি-মৃত্যুর তদন্তের জন্য কোনও নোডাল অফিসারই নেই এখানে।” কর্মী-ঘাটতির সাফাই দিয়েছেন বর্ধমানের মুখ্য স্বাস্থ্য অধিকর্তা প্রণবকুমার রায়ও। মালদহের মুখ্য স্বাস্থ্য অধিকর্তা দিলীপ মণ্ডল বলেছেন, “মালদহ মেডিক্যাল কলেজে প্রসূতি-মৃত্যুর তদন্ত ঠিকমতো করা হয়নি। আবার যে-ক’টি তদন্ত হয়েছিল, সেগুলি ঠিকমতো অনলাইন রিপোর্টে ঢোকানো হয়নি। ভবিষ্যতে যাতে এমনটা না-হয় তার জন্য চিকিৎসকদের সতর্ক করে দিয়েছি।”
তা হলে অডিটের নিয়মবিধি মেনে রাজ্যে প্রত্যেক প্রসূতির মৃত্যুর কারণ জানা যাবে কবে?
উত্তর নেই স্বাস্থ্য ভবনের কাছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy