Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

প্লেটলেট যাচাই জরুরি, নিয়মিত রক্ত পরীক্ষাও

কেউ বলছেন, জ্বরের পরে পাঁচ দিন না গেলে রক্ত পরীক্ষা করা যাবে না। কারণ তার আগে এলাইজা পরীক্ষায় রক্তে ডেঙ্গির জীবাণুই ধরা পড়বে না। কারও পরামর্শ, জ্বর হলে এনএস-ওয়ান পরীক্ষা করিয়ে নিলেই সুবিধা। তাতে ডেঙ্গি হয়েছে কি না, তার একটা আভাস পাওয়া যাবে।

দেবদূত ঘোষঠাকুর
কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০২:৫০
Share: Save:

কেউ বলছেন, জ্বরের পরে পাঁচ দিন না গেলে রক্ত পরীক্ষা করা যাবে না। কারণ তার আগে এলাইজা পরীক্ষায় রক্তে ডেঙ্গির জীবাণুই ধরা পড়বে না।

কারও পরামর্শ, জ্বর হলে এনএস-ওয়ান পরীক্ষা করিয়ে নিলেই সুবিধা। তাতে ডেঙ্গি হয়েছে কি না, তার একটা আভাস পাওয়া যাবে।

চিকিৎসকদের কারও আবার সুপারিশ, জ্বর থাকতে থাকতেই রক্ত দিতে হবে। না হলে ম্যালেরিয়া বা ডেঙ্গির জীবাণু পাওয়া যাবে না।

যে সব এলাকা ডেঙ্গি কিংবা ম্যালেরিয়াপ্রবণ, সেখানে কারও শরীরে সংক্রমণ ছড়িয়েছে কি না, তা বোঝার একমাত্র উপায় রক্ত পরীক্ষা। কিন্তু রক্ত পরীক্ষা নিয়ে বিভিন্ন চিকিৎসকের নানা রকম সুপারিশে বিভ্রান্তিতে পড়ছেন সাধারণ মানুষ। কী করবেন, তা তাঁরা বুঝে উঠতে পারছেন না। স্বাস্থ্য ভবনের এক কর্তার মন্তব্য, ‘‘কলকাতা পুরসভার ক্লিনিকে নিখরচায় ডেঙ্গি ও ম্যালেরিয়ার পরীক্ষা করানো হয়। সরকারি হাসপাতালেও কম খরচে ওই পরীক্ষা হয়। কিন্তু সেগুলিতে আস্থা রাখতে না পেরে অনেকেই বেসরকারি প্যাথোলজিক্যাল ক্লিনিকে যাচ্ছেন। সেখানে এলাইজায় ডেঙ্গির জীবাণু পরীক্ষা করতে দু’হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা লাগছে। আর তাতে ধাক্কা খাচ্ছেন অনেকেই। রক্ত পরীক্ষা না করিয়েই চলে যাচ্ছেন।’’

কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের নির্দেশিকা অনুযায়ী ম্যালেরিয়া-ডেঙ্গিপ্রবণ এলাকায় বর্ষার পরে পরেই জ্বর হলে রক্ত পরীক্ষা আবশ্যিক। পরজীবী বিশেষজ্ঞ অমিতাভ নন্দী জানাচ্ছেন, কারও শরীরে ম্যালেরিয়া কিংবা ডেঙ্গির জীবাণু ঢুকলে, তা বিভাজিত হতে শুরু করে। তার ফলে এক দিকে যেমন সেই ব্যক্তির শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হয়, তেমনই তিনি নিজেও অন্যদের চিন্তার কারণ হয়ে ওঠেন। কারণ, অসুস্থ ওই ব্যক্তিকে মশা কামড়ালেই জীবাণু মশার শরীরে প্রবেশ করে। ওই মশা (ডেঙ্গির ক্ষেত্রে এডিস ইজিপ্টাই, ম্যালেরিয়ার ক্ষেত্রে অ্যানোফিলিস স্টিফেনসাই, এনসেফ্যালাইটিসের ক্ষেত্রে কিউলেক্স বিসনই) এর পরে যাঁকেই কামড়াবে, তিনিই ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়া বা এনসেফ্যালাইটিসে আক্রান্ত হবেন। তাই চটজলদি রক্ত পরীক্ষা করে সংক্রমণটা আসলে কী, তা জেনে চিকিৎসা শুরু করতে বলেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।’’

কিন্তু খরচের ধাক্কা এবং ‘নানা মুনির নানা মতে’র মাঝে পড়ে কী করবেন সাধারণ মানুষ?

পরজীবী বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, এনএস-ওয়ান, এলাইজা-র চক্করে না পড়ে জ্বর হওয়ার তিন দিনের মাথায় রক্তের তিনটি কোষ— লোহিত কণিকা, শ্বেত কণিকা কিংবা অণুচক্রিকা কত রয়েছে, তা নিয়মিত পরীক্ষা করালেই প্রাথমিক সংক্রমণের পূর্বাভাস পাওয়া যাবে। এবং সেই রিপোর্ট দেখেই পরবর্তী পদক্ষেপ করতে সুবিধা হবে। যেমন প্লাসমোডিয়াম ফ্যালসিপেরাম (ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়ার জীবাণু) রক্তে ঢুকলে লোহিত কণিকা কমে যায়। কারণ ওই জীবাণু লোহিত কণিকার কোষপ্রাচীর ফাটিয়ে দেয়। এই প্রক্রিয়াকে বলে হিমোলাইসিস। সুতরাং ম্যালেরিয়াপ্রবণ এলাকায় কোনও জ্বরের রোগীর রক্তে লোহিত কণিকা কমে গেলে তবে ওই ব্যক্তি ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হতে পারেন বলে ধারণা করা চলে। সেইমতো ওই ব্যক্তির রক্তে ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়ার জীবাণু রয়েছে কি না, তা খুঁজে বের করার পরীক্ষা করতে হবে।

রক্ত পরীক্ষায় যদি শ্বেত কণিকা এবং প্লেটলেট কমে যায়, তবে ওই ব্যক্তির ডেঙ্গি হতে পারে বলে ধারণা করা যায়। সে ক্ষেত্রে এলাইজা পরীক্ষা করে ওই ব্যক্তির ডেঙ্গি সংক্রমণ হয়েছে কি না, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে হবে বলে পরজীবী বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন।

রক্তের মধ্যে বাইরে থেকে কোনও প্রোটিন জাতীয় বস্তু প্রবেশ করলে তার সঙ্গে লড়াই করার জন্য সাধারণত শ্বেত কণিকার সংখ্যা বেড়ে যায়। কিন্তু ডেঙ্গির ক্ষেত্রে শ্বেত কণিকার পরিমাণ কমে যায়। কেন? পরজীবী বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ, ‘‘ডেঙ্গির জীবাণু সরাসরি শ্বেত কণিকাকে আক্রমণ করে। তাই শ্বেত কণিকা কমে যায়। এর ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। রোগীর অবস্থার দ্রুত অবনতি হয়। তাই ডেঙ্গির সংক্রমণ মারাত্মক হলে রোগীকে আলাদা ঘরে খুব সাবধানে (আইসোলেশন ওয়ার্ডে) রাখতে হয়। যে কোনও ধরনের সংক্রমণ রুখতেই এই ব্যবস্থা।’’

শারীরবিজ্ঞানীরা বলছেন, হেমারেজিক ডেঙ্গির ক্ষেত্রে শরীরের ভিতরে রক্তক্ষরণ হয়। দাঁতের মাড়ি, নাক দিয়ে রক্ত পড়ে। কখনও বা খাদ্যনালীর ভিতরে রক্তক্ষরণ হয়। এই রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে পারে প্লেটলেট। কিন্তু ডেঙ্গির জীবাণু প্লেটলেটকে সরাসরি আক্রমণ করে। প্লেটলেট কমে গেলে হেমারেজিক ডেঙ্গিতে রক্তক্ষরণ বন্ধ হয় না। এক দিকে শরীরের ভিতরে রক্তপাত ঘটায় ডেঙ্গির জীবাণু। আর প্লেটলেট কম থাকায় সেই রক্ত শরীরের মধ্যে বেরোতেই থাকে। ফলে রোগীর শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হয়। ঠিক সময়ে রোগ ধরা না পড়লে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হয়।

অর্থাৎ প্লেটলেট এবং শ্বেত কণিকা কমে গেলে ডেঙ্গির আশঙ্কা থাকে। তখন প্রথাগত পরীক্ষা (এলাইজা) করানোর পরামর্শ দিয়েছেন পরজীবী বিশেষজ্ঞেরা। তাতে কিছু না মিললে ম্যালেরিয়া পরজীবীর পরীক্ষা করাতে হবে। যদি কাঁপুনি দিয়ে জ্বর হয়, তা হলে ম্যালেরিয়ার জীবাণু রয়েছে কি না দেখতে হবে।

তবে জ্বর হওয়ার দিনই ডেঙ্গি জীবাণু খুঁজতে হলে এনএস-ওয়ান পরীক্ষার উপর নির্ভর করতে হবে বলে কেউ কেউ পরামর্শ দিচ্ছেন। এক পরজীবী বিশেষজ্ঞের মন্তব্য, ‘‘এনএস-ওয়ান পরীক্ষা কোনও চূড়ান্ত ফল নয়। এটা ডেঙ্গির সংক্রমণ সম্পর্কে একটা ধারণা দেয় মাত্র। ওই পরীক্ষার ফল দেখে প্রাথমিক চিকিৎসা শুরু করে দিতে হয়। সাবধানের কিন্তু মার নেই।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE