Advertisement
২১ মে ২০২৪
পায়ে বিষ-ক্ষত

ফিরিয়ে দিল চার হাসপাতাল, ঠাঁই হল না বাড়িতেও

মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বাস্থ্য পরিষেবাকে দরিদ্রমুখী করার উপরে জোর দিয়েছেন। অথচ কলকাতার বুকে পায়ে গ্যাংগ্রিন হয়ে পোকা বেরোতে থাকা এক রোগীকে ভর্তি না করে তিনটি মেডিক্যাল কলেজ-সহ চারটি সরকারি হাসপাতাল ফিরিয়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সংক্রমণের আশঙ্কায় মধ্যবয়সী ওই রোগীকে বাড়ি থেকে বার করে দিয়েছেন আত্মীয়েরাও। তাঁর ঠাঁই হয়েছে ফুটপাথে একটা ভাঙা চৌকিতে। ঘা ও শরীরে ধুম জ্বর নিয়ে অশোক সিংহ নামে সেই রোগী বলেন, “সরকারি হাসপাতালে নেতামন্ত্রীরা ভর্তি থাকবেন। আমাদের মতো গরিবদের নিয়তি হল পচে মরা।”

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০১৪ ০২:০২
Share: Save:

মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বাস্থ্য পরিষেবাকে দরিদ্রমুখী করার উপরে জোর দিয়েছেন। অথচ কলকাতার বুকে পায়ে গ্যাংগ্রিন হয়ে পোকা বেরোতে থাকা এক রোগীকে ভর্তি না করে তিনটি মেডিক্যাল কলেজ-সহ চারটি সরকারি হাসপাতাল ফিরিয়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

সংক্রমণের আশঙ্কায় মধ্যবয়সী ওই রোগীকে বাড়ি থেকে বার করে দিয়েছেন আত্মীয়েরাও। তাঁর ঠাঁই হয়েছে ফুটপাথে একটা ভাঙা চৌকিতে। ঘা ও শরীরে ধুম জ্বর নিয়ে অশোক সিংহ নামে সেই রোগী বলেন, “সরকারি হাসপাতালে নেতামন্ত্রীরা ভর্তি থাকবেন। আমাদের মতো গরিবদের নিয়তি হল পচে মরা।”

গড়িয়াহাট বাজারের পিছন দিকে কাঁকুলিয়া রোডে বড় দুই ভাই শুকদেব ও ফুলচাঁদ সিংহের সঙ্গে থাকতেন অশোক। তেমন কিছু করতেন না। ডায়াবেটিসেও ভুগছিলেন। ১০ নভেম্বর তাঁর ডান পায়ের বুড়ো আঙুলে আঘাত লেগে কেটে যায়। সংক্রমণ হয়ে পুঁজ-রক্ত বেরোতে থাকে। ১৬ নভেম্বর থেকে ক্ষতস্থান দিয়ে পোকা বেরোনো শুরু হয়। পরদিনই তাঁকে শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে সার্জারির আউটডোরে দেখানো হয়।

শম্ভুনাথ ‘রেফারড টু এসএসকেএম’ লিখে দেয়। অশোকবাবুর কথায়, “শম্ভুনাথের ডাক্তারবাবুরা আমায় ছুঁয়ে দেখলেনও না। ব্যান্ডেজ বাঁধার জন্য যেতে বললেন। সেখানে বলা হল পিজি-তে যেতে।” শম্ভুনাথের সুপার সৌমাভ দত্তের ব্যাখ্যা, “ভদ্রলোককে ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ওঁর চামড়া অনেকটা ফাঁক হয়ে পোকা বেরোচ্ছিল। স্কিন গ্রাফটিং ছাড়া ঠিক করা যেত না বলে পিজি-র প্লাস্টিক সার্জারি আউটডোরে যেতে বলেছিলাম।”

২০ নভেম্বর পিজি-তেই যান অশোকবাবু। কিন্তু সেই আউটডোর টিকিটে রোগীর ক্ষতের বিবরণ ও ডাক্তারদের পরামর্শের জায়গায় কিচ্ছু লেখা হয়নি। অশোকবাবুর পরিজনদের অভিযোগ, ড্রেসিংটুকুও করেননি ওঁরা। জানানো হয়, হাসপাতালে জায়গা নেই। রোগীকে যেন এম আর বাঙুর বা ন্যাশনাল মেডিক্যালে নিয়ে যাওয়া হয়। ডেপুটি সুপার সর্বেশ্বর মণ্ডলের বক্তব্য, “আমরা বারবার বলেছি, ইমার্জেন্সি কেস হলে ভর্তি নিতেই হবে। অন্যথায় ডিউটিরত মেডিক্যাল অফিসারদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা হবে। বুঝতে পারছি না তা-ও কেন এ রকম হল।”

২১ নভেম্বর অশোকবাবুকে নিয়ে যাওয়া হয় ন্যাশনাল মেডিক্যালে। সেখানকার টিকিটে বেশ কিছু ট্যাবলেট ও ড্রেসিংয়ের কথা লেখা হয়, কিন্তু ভর্তি নেওয়া হয়নি। সুপার পীতবরণ চক্রবর্তীর যুক্তি, “নিশ্চয়ই ক্ষত এত বড় ছিল না যাতে ভর্তির দরকার হয়।” কিন্তু শম্ভুনাথ কর্তৃপক্ষ যে দাবি করেছেন ক্ষত অত্যন্ত মারাত্মক ছিল বলেই রোগীকে তাঁরা পিজি-তে রেফার করেছেন। তা হলে ন্যাশনাল সেই ক্ষতকে ‘সামান্য’ বলছেন কীসের ভিত্তিতে? উত্তর মেলেনি।

২২ নভেম্বর সেই রোগীকে নিয়ে যাওয়া হয় বাঙুরের আউটডোরে। সেই আউটডোর টিকিটে লেখা, রোগীর পায়ে গ্যাংগ্রিন শুরু হয়ে গিয়েছে। তবুও অশোকবাবুকে ভর্তি করা হয়নি বলে অভিযোগ। রোগীর আত্মীয়দের দাবি, তাঁরা পুলিশে ডায়েরি করার ভয় দেখালে অশোকবাবুর পায়ে ডাক্তারেরা ড্রেসিং করেন। বলা হয়, বেড খালি হলে রোগীকে ভর্তির জন্য ডাকা হবে। সে ডাক আসেনি। বাঙুর কর্তৃপক্ষ বলেছেন, “কলকাতার অন্য সরকারি হাসপাতাল বা মেডিক্যাল কলেজ এমন রোগী ভর্তি নেয় না। সব আমাদের কাছে ঠেলে। শুধু আমরাই কেন এঁদের ভর্তি নেব? তাই রোগীকে ফের ন্যাশনালে যেতে বলি।”

অকৃতদার অশোকবাবু অবশ্য আর কোনও হাসপাতালে যাননি। বাড়ি ফিরেছিলেন। কিন্তু পরিবারে স্থান হয়নি। কাঁকুলিয়া রোডে একটা গলির মুখে ছেঁড়া চাদর জড়িয়ে জবুথবু হয়ে আছেন। হাঁটতে পারছেন না। পড়ে গিয়ে কানের উপরে ফেটে গিয়েছে।

ভাই শুকদেব সিংহের বক্তব্য, “দু’টো মাত্র ঘরে এত জন থাকি। পোকা থেকে বাচ্চাদের গায়ে রোগ ছড়ালে সর্বনাশ হবে।” আর এক ভাই ফুলচাঁদ বলেন, “হাসপাতালে ভর্তির কত চেষ্টা তো করলাম। কেউ নিল না। দু’বেলা খেতে দিয়ে যাচ্ছি ভাইকে।” মাথা নিচু করে অশোকবাবু বলেন, “কেউ নেই আমার। এখানেই পা পচে মরে যাব।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

parijat bandyopadhyay ashok singh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE