কথা ছিল, মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী, অন্যান্য স্বাস্থ্য পরিষেবার সঙ্গে সম্পূর্ণ নিখরচায় স্টেন্ট বসানো যাবে সরকারি হাসপাতালে। কিন্তু তার বদলে গত ১৬ নভেম্বর থেকে স্টেন্ট বসানোই সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গিয়েছে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের মতো প্রথম সারির হাসপাতালে! পাশাপাশি, পুরো বন্ধ না হলেও আগে যা স্টেন্ট বসানো হত, তার থেকে সংখ্যাটা এক ধাক্কায় অর্ধেকেরও বেশি কমে গিয়েছে কলকাতার নীলরতন সরকার, আরজিকরের মতো মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।
কর্তৃপক্ষ সাফাই দিচ্ছেন, সব কিছু ‘ফ্রি’ করার নতুন নিয়মে তাঁরা এখনও ধাতস্থ হতে পারেননি বলে সরকারি ভাবে দরপত্র ডেকে স্টেন্ট কেনার ব্যবস্থা করে উঠতে পারেননি। ফলে রোগীর ভিড় দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে কিন্তু অস্ত্রোপচার হচ্ছে না। নিখরচায় স্টেন্ট পাওয়ার বদলে শূন্য হাতে ফিরতে হচ্ছে রোগীদের। মেডিক্যালে গড়ে মাসে ৪০-৪৫ জনের দেহে স্টেন্ট বসানো হয়। সব এখন বন্ধ।
যদি পরিষেবা দেওয়া থামিয়েই দিতে হয়, তা হলে মুখ্যমন্ত্রী স্বাস্থ্যে সব কিছু ‘ফ্রি’ ঘোষণা করায় লাভ কী হল?
স্বাস্থ্যকর্তাদের অধিকাংশই জানিয়েছেন, স্বার্থে ঘা লাগায় এক শ্রেণির চিকিৎসক ইচ্ছাকৃত ভাবে এই রকম ‘পারছি না’ গোছের পরিস্থিতি তৈরি করছেন। ওই স্বাস্থ্যকর্তাদের কথায়, ‘‘স্টেন্ট, পেসমেকার, ভাল্ভ আর অর্থোপেডিক ইমপ্লান্টের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি কমিশনের খেলা চলত। এগুলি হাসপাতালে পাওয়া গেলেও রোগীকে বাইরে থেকে কেনানোই ছিল দস্তুর। সেটা বন্ধ হওয়ায় একাংশ চিকিৎসক অস্থির হয়ে গিয়েছেন। তাই তাঁরা নানা রকম ভাবে বাধা দিতে চাইছেন।’’
স্বাস্থ্যকর্তারা আরও জানিয়েছেন, উন্নততর ‘ড্রাগ এলিউটিং স্টেন্ট’ বা ‘বেয়ার মেটাল স্টেন্ট’ যা সরকারি মেডিক্যাল স্টোর্সের তালিকায় নেই, সেগুলি স্পট কোটেশন করে দরপত্র ডেকে কিনতে কিছু সময় লাগতে পারে। কিন্তু বিপিএল স্টেন্ট তো সরকারই দেয়। হাসপাতালের ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকানেও তা পাওয়া যায়। তা হলে মেডিক্যাল কলেজে গত সতেরো দিনে সেই স্টেন্টও বসানোর কাজ হল না কেন?
কলকাতা মেডিক্যালের কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান শান্তনু গুহর কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে তাঁর জবাব, ‘‘গত ২৫ নভেম্বর থেকে আমি ছুটিতে রয়েছি। কোমরে যন্ত্রণা হচ্ছে। তার পরে ১ ডিসেম্বর একটা কনফারেন্সে চেন্নাই এসে বৃষ্টিতে আটকে গিয়েছি। ফলে মেডিক্যালে আমার বিভাগে কী হচ্ছে না হচ্ছে, জানি না।’’ কিন্তু স্টেন্ট বসানো বন্ধ হয়েছে ১৬ নভেম্বর থেকে। এর পরে ২৪ নভেম্বর বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে স্পট কোটেশন নিয়ে বৈঠকেও তিনি ছিলেন। তা হলে তিনি কেন স্টেন্ট বসানো বন্ধ হওয়ার কারণ বলতে পারবেন না?
তখন শান্তনুবাবুর জবাব, ‘‘আসলে নতুন নিয়মকানুন নিয়ে ডাক্তারবাবুরা একটু বিভ্রান্ত। আর দু’-এক দিনের মধ্যেই সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে বলে আশা করছি।’’ বিপিএল স্টেন্টও কেন বসল না? বিভাগীয় প্রধানের উত্তর, ‘‘ওই স্টেন্টের মান নিয়ে আমাদের সংশয় রয়েছে।’’
যুতসই কোনও উত্তর মেলেনি মেডিক্যালের সুপার শিখা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখেও। তিনি বলেছেন, ‘‘একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। আমরা ভেন্ডারদের ডেকে স্টেন্টের বরাত দিয়েছিলাম। কিন্তু ডাক্তারবাবুরা এখন বলছেন, আলাদা করে হাসপাতাল থেকে নির্দেশিকা জারি না করলে তাঁরা ওই ভেন্ডারদের থেকে জিনিস কিনতে পারবেন না। আমরা নির্দেশিকা বার করছি।’’ কিন্তু ‘স্টেট ইলনেস ফান্ড’-এর টাকা দিয়ে ন্যায্যমূল্যের দোকান থেকে কেন স্টেন্ট কিনে বসানো হচ্ছে না, তার কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি মেডিক্যাল কর্তৃপক্ষ।
একই ভাবে, এত দিনেও কেন ‘স্পট কোটেশন’ করে নন-ক্যাটলগ (যা সরকারি তালিকায় নেই) স্টেন্ট কেনা হয়নি, তার জবাব দিতে পারেননি নীলরতন ও আরজিকর মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ। নীলরতনে দিনে ৬-৭টি এবং আরজিকরে দিনে ৮-১০টি স্টেন্ট বসত। সেখানে নীলরতনের বিভাগীয় প্রধান কাজল গঙ্গোপাধ্যায় আর আরজিকরের বিভাগীয় প্রধান কনক মিত্র জানিয়েছেন, দিনে এক জন বা দু’দিনে এক জনের দেহে শুধু বিপিএল স্টেন্ট বসছে। বাদবাকি কোনও স্টেন্ট বসানো হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না? তাঁদের উত্তর, ‘‘সুপার এবং স্বাস্থ্য ভবনের কর্তারা বলতে পারেন। আমরা অন্য স্টেন্টের জোগান না পেলে কী করব?’’ এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে আরজিকরের সুপার প্রবীর মুখোপাধ্যায় এবং নীলরতনের সুপার শেখ আলি ইমাম দু’জনেরই জবাব, স্বাস্থ্য ভবন থেকে তাঁদের সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে বারণ করে দিয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy