দমদমের সাড়ে চার বছরের দিয়া ভট্টাচার্যের জ্বর হচ্ছিল কয়েক দিন ধরে। প্লেটলেট কিন্তু স্থিতিশীল ছিল। জ্বর কমলেও দিয়ার খাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে। রোগা পাতলা মেয়েটা আরও শুকিয়ে যাচ্ছিল। স্থানীয় চিকিৎসকের উপরে ভরসা গেল। কলকাতার এক পরজীবী বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন দিয়ার বাবা। তড়িঘড়ি মেয়েটিকে এনে ভর্তি করানো হল দক্ষিণ কলকাতার এক হাসপাতালে। ধরা পড়ল ডেঙ্গি।
১২ বছরের আকাশ মুখোপাধ্যায়ের জ্বরটা সারছিলই না। জ্বর নামাতে পাড়ার চিকিৎসক দু’ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে দিলেন আকাশকে। জ্বর তো নামলই না, আকাশ আরও ঝিমিয়ে পড়তে লাগল। পাল্লা দিয়ে কমছিল প্লেটলেট। নবমীর সকালে আকাশকে ভর্তি করাতে হল। নবমীতে এক ব্যাগ, দশমীতে তিন ব্যাগ প্লেটলেট দেওয়ার পরেও লেগেছে আরও দুই ব্যাগ। পুজোটা মাটি গোটা পরিবারের।
বারাসতের ৭০ বছরের হরিসাধন চক্রবর্তীর ঘুসঘুসে জ্বরটা বেশ কয়েক দিন ধরে। পাত্তা দেননি। পাড়ার দোকান থেকে ওষুধ কিনে খেয়েছেন। দমদমে অসুস্থ নাতনিকে দেখতে এসে মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। তখনই জানা গেল জ্বরের কথাটা। রক্ত পরীক্ষা হল। দেখা গেল প্লেটলেট ১ লক্ষ ৩০ হাজার। পরদিনই নেমে গেল ৩০ হাজারে। হাসপাতালে ভর্তি করে তিন দিন যমেমানুষে টানাটানি।
এক দিকে চলছে এক ধরনের চিকিৎসকের ভুল চিকিৎসা আর ভুল রোগ নির্ণয়। আর অন্য দিকে এক শ্রেণির মানুষের ওষুধের দোকানের উপরে অধিক নির্ভরতা। এই দুই ঘটনায় ডেঙ্গি পরিস্থিতি আরও জটিল হচ্ছে—বারবার সেটাই জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞেরা। দিল্লির ইনস্টিটিউট অব কমিউনিকেবল ডিজিজ-এর বিশেষজ্ঞেরা জ্বর, গা-হাত-পা ব্যথায় কেবল প্যারাসিটামল ব্যবহারের উপরে জোর দিচ্ছেন। রোগ নির্ণয়ের আগে কোনও ভাবেই অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া যাবে না, নির্দেশিকা জারি করেছেন তাঁরা। কিন্তু চিকিৎসকদের একাংশের তাতে হুঁশ ফিরছে না। কেউ বাজারে আসা নতুন অ্যান্টিবায়োটিকের পরীক্ষা চালাচ্ছেন ওই সব রোগীর উপরে। কেউ আবার একসঙ্গে দুটি অ্যান্টিবায়োটিক খেতে দিচ্ছেন।
বেলঘরিয়ার আকাশ মুখোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে ঠিক কিন্তু এমনটাই ঘটেছে। কয়েক দিন জ্বর না নামায় আকাশের চিকিৎসক তাকে দু’টি কড়া অ্যান্টিবায়োটিক দিয়েছিলেন। তিন দিন ধরে সেই ওষুধ খেয়েছে ছেলেটি। তাতে জ্বর সারেনি। বরং একেবারে বিছানায় শুয়ে পড়েছিল আকাশ। অন্য এক চিকিৎসকের পরামর্শে কিশোরটির রক্ত পরীক্ষা করানো হলে ডেঙ্গি ধরা পড়ে। একদিনে প্লেটলেট ১ লক্ষ কমে যাওয়ায় বাড়িতে রাখার আর ঝুঁকি নেননি দ্বিতীয় চিকিৎসক। এক ধাক্কায় এতটা প্লেটলেট নামায় ‘শক’ হয়েছিল আকাশের। পাঁচ ব্যাগ প্লেটলেট দেওয়ার পরে এখন ছেলেটির অবস্থা স্থিতিশীল। কিন্তু হঠাৎ করে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কেন প্লেটলেট এক ধাক্কায় ১ লক্ষ কমল তার হদিস পাচ্ছেন না চিকিৎসকেরা। কেউ কেউ অধিক পরিমাণে কড়া অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার উপরে দায় চাপিয়েছেন। অধিকাংশই অবশ্য অ্যান্টিবায়োটিকের উপরে দায় চাপাতে নারাজ।
পরজীবী বিশেষজ্ঞ অমিতাভ নন্দী বলেন, ‘‘অপ্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ায় প্লেটলেট এতটা কমে যায় কি না, তা নিশ্চিত করে বলা যাবে না। এমন কোনও সমীক্ষা এখনও হয়নি। তবে অপ্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিক শরীরের মারাত্মক ক্ষতি করে। বিভিন্ন জীবাণুর উপরে অ্যান্টিবায়োটিক আর কাজ করে না। তাই ডেঙ্গি বা ভাইরাল জ্বরে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া নিষিদ্ধ।’’ যে সব চিকিৎসক আকাশদের মতো রোগীদের একসঙ্গে একাধিক অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে দিচ্ছেন, তাঁদের নাম কেন স্বাস্থ্য দফতর নথিভূক্ত করে না— সেই প্রশ্ন তুলেছেন চিকিৎসকদের অনেকেই। স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তা জানাচ্ছেন, এ ব্যাপারে তাঁদের কাছে নির্দিষ্ট সুপারিশ এলে ভেবে দেখা হবে।
পরজীবী বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, গত দুই বছর ধরেই যে ডেঙ্গিটা পূর্ব ভারত এবং উত্তর-পূর্ব ভারতে হানা দিচ্ছে তাতে ডেঙ্গির নির্দিষ্ট উপসর্গ দেখা যাচ্ছে না। জ্বর, গায়ে চাকা চাকা দাগ, গাঁটে গাঁটে ব্যথা, এই সব উপসর্গ না থাকলেও ডেঙ্গির রক্ত পরীক্ষায় ‘পজিটিভ’ ফল আসছে। তাই জ্বর হওয়ার দু’দিনের মধ্যে ডেঙ্গির রক্ত পরীক্ষা এবং এক দিন অন্তর প্লেটলেট পরীক্ষার উপরে জোর দিচ্ছেন। কিন্তু সেই সুপারিশ স্বাস্থ্য দফতর থেকে নির্দেশিকা হিসেবে জেলায় জেলায় না পাঠানোয় তৈরি হয়েছে বিভ্রান্তি। কেন স্বাস্থ্য দফতর এই সংক্রান্ত কোনও নির্দেশিকা জারি করবে না, সেই প্রশ্নে চুপ স্বাস্থ্য-কর্তারা।
বিভিন্ন জায়গায় শিবির করলেও অতিরিক্ত, অপ্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার রোধ এবং নিয়মিত রক্ত এবং প্লেটলেট পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করার ক্ষেত্রে আইএমও তৎপর হয়নি এখনও। তাঁদের এই অক্ষমতা ঢাকতে আইএমএ-র রাজ্য সম্পাদক শান্তনু সেন ডেঙ্গি নিয়ে আতঙ্ক ছড়ানোয় জন্য দায় চাপিয়েছেন সংবাদ মাধ্যমের উপরে। তাঁর মন্তব্য, ‘‘এখানে যে ধরনের ডেঙ্গিটা হচ্ছে তা মারাত্মক নয়। হেমারজিক ডেঙ্গি বিশেষ হচ্ছে না। সংবাদমাধ্যম এবং কিছু লোক ডেঙ্গি নিয়ে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। প্লেটলেট কমলেই হইচই করার কিছু নেই।’’ চিকিৎসকদের সতর্ক করতে তাঁরা নির্দেশিকাও জারি করছেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন শান্তনুবাবু।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy