Advertisement
১১ মে ২০২৪

রাজ্যে ওষুধ বাড়ন্ত, সোয়াইন ফ্লু রোখে কে

মাস সাতেক আগে উত্তরবঙ্গে খাবি খেয়ে রাজ্য সরকার আদৌ কোনও শিক্ষা নিয়েছে কি না, সোয়াইন ফ্লু-পরিস্থিতি নতুন করে সেই প্রশ্ন তুলে দিল। প্রশ্ন উঠছে। কারণ, সোয়াইন ফ্লু-র প্রধান ওষুধ ট্যামি ফ্লু কলকাতা বা রাজ্যের অন্য কোথাও পাওয়াই যাচ্ছে না। এমনকী বাংলায় সংক্রামক রোগের চিকিৎসার প্রধান কেন্দ্র, বেলেঘাটার আইডি হাসপাতালে বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত ট্যামি ফ্লু-র জোগান নেই বলে স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর। স্বাস্থ্যকর্তারা স্বীকার করে নিয়েছেন, সোয়াইন ফ্লুয়ে আক্রান্ত কেউ এই মুহূর্তে আইডি-তে ভর্তি হলে তাঁকে ট্যামি ফ্লু দেওয়া যাবে না।

আকাল এই ওষুধেরই।

আকাল এই ওষুধেরই।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:৪৩
Share: Save:

মাস সাতেক আগে উত্তরবঙ্গে খাবি খেয়ে রাজ্য সরকার আদৌ কোনও শিক্ষা নিয়েছে কি না, সোয়াইন ফ্লু-পরিস্থিতি নতুন করে সেই প্রশ্ন তুলে দিল।

প্রশ্ন উঠছে। কারণ, সোয়াইন ফ্লু-র প্রধান ওষুধ ট্যামি ফ্লু কলকাতা বা রাজ্যের অন্য কোথাও পাওয়াই যাচ্ছে না। এমনকী বাংলায় সংক্রামক রোগের চিকিৎসার প্রধান কেন্দ্র, বেলেঘাটার আইডি হাসপাতালে বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত ট্যামি ফ্লু-র জোগান নেই বলে স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর। স্বাস্থ্যকর্তারা স্বীকার করে নিয়েছেন, সোয়াইন ফ্লুয়ে আক্রান্ত কেউ এই মুহূর্তে আইডি-তে ভর্তি হলে তাঁকে ট্যামি ফ্লু দেওয়া যাবে না।

তাই প্রশ্ন উঠছে, কলকাতা এবং তার আশেপাশে সোয়াইন ফ্লুয়ে দু’জনের মৃত্যু এবং আক্রান্তের সংখ্যা ১১ ছোঁয়া সত্ত্বেও পরিস্থিতির মোকাবিলায় স্বাস্থ্য দফতর কতটা সচেষ্ট? সেই প্রশ্নের সূত্রেই উঠছে উত্তরবঙ্গের কথা। জুলাইয়ে উত্তরবঙ্গে জাপানি এনসেফ্যালাইটিসের উপসর্গ নিয়ে ছড়িয়ে পড়া রোগ মোকাবিলায় যথেষ্ট উদ্যোগী না-হওয়ায় সেখানকার কিছু স্বাস্থ্যকর্তাকে সাসপেন্ড করা হয়। দিল্লি থেকে এসেছিলেন বিশেষজ্ঞেরা। কিন্তু সেই রোগের স্বরূপ-সন্ধান সম্পূর্ণ হয়নি। সোয়াইন ফ্লু সেই তুলনায় চেনা রোগ এবং ট্যামি ফ্লু তার স্বীকৃত প্রতিষেধক। প্রশ্ন উঠছে, উত্তরবঙ্গের অভিজ্ঞতার নিরিখে এই ধরনের রোগ রুখতে সরকারের তরফে যথেষ্ট আগাম ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি কেন? রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, গুজরাত, তেলঙ্গানা-সহ বিভিন্ন রাজ্যে দীর্ঘদিন ধরে এই রোগের প্রকোপ চলছে। ব্যাপক প্রাণহানিও ঘটছে। সেই সব রাজ্যের পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নিয়ে আগে থেকে বাংলায় পর্যাপ্ত ওষুধ সংগ্রহ-সহ প্রস্তুতি সম্পূর্ণ করা হয়নি কেন?

আর শুধু তো ট্যামি ফ্লু-র আকালই নয়। সোয়াইন ফ্লুয়ে আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসার জন্য পেডিয়াট্রিক ভেন্টিলেটর জোগাতেও হিমশিম খাচ্ছে রাজ্য। ফুলবাগানের বিধানচন্দ্র রায় শিশু হাসপাতালে তিন দিন আগে প্রবল জ্বর ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে ভর্তি হয়েছিল বাগুইআটির হেলা বটতলার বাসিন্দা আট বছরের আবু রাহান। বুধবার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কলেরা অ্যান্ড এন্টেরিক ডিজিজেস বা নাইসেড-এ রক্তপরীক্ষায় তার দেহে সোয়াইন ফ্লু-র ভাইরাস মিলেছে। চিকিৎসকেরা জানান, তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। ডেঙ্গির জীবাণুও পাওয়া গিয়েছে তার রক্তে। তাকে বিসি রায় হাসাপাতালের পেডিয়াট্রিক ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিট বা পিকু-তে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়েছে।

সমস্যা হল, ওই হাসপাতালের পিকু-তে ১২টি শয্যা থাকলেও সব ক’টি রয়েছে একটি ওয়ার্ডের মধ্যেই। এবং সোয়াইন ফ্লুয়ে আক্রান্ত শিশুটি রয়েছে তারই একটিতে। একই ওয়ার্ডে পাশাপাশি শয্যায় গুরুতর অসুস্থ অন্য শিশুরা রয়েছে। ফলে যে-কোনও মুহূর্তে তাদের মধ্যেও সোয়াইন ফ্লু সংক্রমণের আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র নিয়ম অনুযায়ী সোয়াইন ফ্লুয়ে আক্রান্তকে ‘আইসোলেশন’ বা একেবারে আলাদা কোনও ঘরে রাখা উচিত। এ ক্ষেত্রে সেই নিয়ম মানা হচ্ছে না কেন?

বিসি রায়ের চিকিৎসকদের জবাব, এই মুহূর্তে কলকাতার অন্য কোনও সরকারি হাসপাতালে পেডিয়াট্রিক ভেন্টিলেটর পাওয়া যাচ্ছে না।

তা হলে কি সংক্রমণের আশঙ্কা সত্ত্বেও সোয়াইন ফ্লুয়ে আক্রান্ত রাহানের শয্যার আশেপাশেই রাখা হবে অন্য শিশু রোগীদের?

বিসি রায় হাসপাতালের সুপার দিলীপ পাল বলেন, “পিকু-র অন্য শিশুদের থেকে রাহানকে আলাদা রাখার জন্য আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। তার শয্যাটি ঘরের এক কোণে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। একটা পর্দা টাঙিয়ে দেওয়ারও ব্যবস্থা হচ্ছে। অন্য কোথাও পেডিয়াট্রিক ভেন্টিলেটর না-পাওয়া পর্যন্ত রাহানকে সরানো যাবে না। সরালে প্রাণসংশয় হতে পারে।”

সোয়াইন ফ্লু-র রোগীদের ভর্তির জন্য আইডি হাসপাতালকে চিহ্নিত করা হয়েছে। সেখানেও কোনও পেডিয়াট্রিক ভেন্টিলেটর নেই। ফলে আরও বেশি সংখ্যক শিশু সোয়াইন ফ্লুয়ে আক্রান্ত হলে পরিস্থিতি কী ভাবে সামলানো যাবে, কেউ জানে না। ট্যামি ফ্লু-র অপ্রতুল সরবরাহের কথা স্বীকার করেছেন বিসি রায়ের চিকিৎসকেরাও। রাহানের জন্য স্বাস্থ্য দফতরের দ্বারস্থ হয়ে অনেক কষ্টে কিছু ওষুধ মিলেছে বলে তাঁরা জানান।

আইডি হাসপাতালের কর্তৃপক্ষও জানান, পেডিয়াট্রিক ভেন্টিলেটরের অভাবের সঙ্গে সঙ্গে বড়দের ভেন্টিলেটর নিয়েও সমস্যা রয়েছে। ওই হাসপাতালে প্রাপ্তবয়স্কদের ভেন্টিলেটর রয়েছে মাত্র চারটি। একটু বেশি সংখ্যায় সোয়াইন ফ্লুয়ে গুরুতর অসুস্থ রোগী আসতে শুরু করলে এই পরিকাঠামোয় সামলানো যাবে না বলে আশঙ্কা করেছেন তাঁরা।

যদিও স্বাস্থ্য দফতরের জনস্বাস্থ্য বিভাগের যুগ্ম অধিকর্তা কমলকৃষ্ণ পতির দাবি, এখনও আতঙ্কিত হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। “আমরা প্রস্তুত আছি। কোথাও কোনও অসুবিধা হচ্ছে না। আলাদা ওয়ার্ড খোলা হচ্ছে জেলা হাসপাতালেও। সেখানে সোয়াইন ফ্লু-র রোগীদের চিকিৎসা হবে,” বলেন কমলবাবু।

স্বাস্থ্য ভবনের একাংশ অবশ্য কমলবাবুর সঙ্গে একমত নন। তাঁদের মতে, সমস্যা শুধু রোগের মোকাবিলাতেই নয়। রোগীর সংখ্যা আর কিছুটা বাড়লে রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষা করাই মুশকিল হবে। কারণ, গোটা রাজ্যে এখনও নাইসেড ছাড়া আর কোথাও সোয়াইন ফ্লু পরীক্ষার ব্যবস্থা হয়নি। কলকাতার স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনে জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনের টাকায় সোয়াইন ফ্লু নির্ণয়ের ল্যাবরেটরি তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল প্রায় পাঁচ বছর আগে। সেই কাজ এখনও শেষ হয়নি। সেখানকার চিকিৎসকেরা জানান, ল্যাবরেটরিতে ন’টি যন্ত্রের দরকার ছিল। তার মধ্যে মাত্র কয়েকটি এসেছে। বাকি যন্ত্রগুলো না-এলে কাজ শুরু করা যাবে না।

রাজস্থান-সহ বিভিন্ন রাজ্যে সোয়াইন ফ্লু-র দাপট অব্যাহত। সুইৎজারল্যান্ড থেকে জয়সলমের ঘুরতে এসে ৭০ বছরের এক মহিলা ওই রোগে আক্রান্ত হয়ে এ দিন জোধপুরের হাসপাতালে মারা গিয়েছেন। আরও আট জনের মৃত্যুতে রাজস্থানে সোয়াইন ফ্লুয়ে মৃতের সংখ্যা বেড়ে হল ১১৭। রাজস্থানের মোট ৩৩টি জেলার মধ্যে ২৯টিতেই এই সংক্রমণ ছড়িয়েছে। সব চেয়ে বেশি রোগী জয়পুর জেলায়। এ দিন আরও দু’জনের মৃত্যুতে পঞ্জাবে সোয়াইন ফ্লুয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৯। হায়দরাবাদেও এইচ১এন১ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে ছ’জনের। চলতি বছরে এ-পর্যন্ত সারা দেশে এই রোগে ৪০৭ জন প্রাণ হারিয়েছেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

swain flu kolkata
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE