Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
Monsoon Special

বৃষ্টি ভেজা দিনলিপি

ক’দিন ধরে এক নাগাড়ে বৃষ্টি পড়ছে। এক ঘেয়ে টিপ্ টিপ শব্দ কোন এক গভীর থেকে বিষাদ সিন্ধুর ধারা বইয়ে দিচ্ছেǀ — লেখক বিনয় কৃষ্ণ বিশ্বাস

প্রতীকী ছবি: লেখক বিনয় কৃষ্ণ বিশ্বাস

প্রতীকী ছবি: লেখক বিনয় কৃষ্ণ বিশ্বাস

সংগৃহীত প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ১১ জুলাই ২০২২ ০৮:১২
Share: Save:

সারাদিন অবিশ্রান্ত ভাবে রিম-ঝিম তালে বৃষ্টি হয়ে চলেছেǀ মাথার উপরে আকাশজুড়ে মেঘের ঘনঘটাǀ মধ্যচল্লিশের এই আমি, সহধর্মিনী এবং সন্তান সহযোগে এখন পুরোদস্তুর একজন সংসারি মানুষ। মাথার উপরে বাবা-মায়ের ভালবাসা আর শাসন কোনওটাই নেইǀ এই ধরাধামে তাঁদের অশরীরী আশীর্বাদ এখনও আছে কিনা আমি জানি নাǀ মহানগরের ভাগের বাড়ির ছোট্ট এক টুকরো ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে টিপ টিপ শব্দ শুনছি। সেই সকাল থেকে একাǀ ছোট হলেও এই ব্যালকনিটাই আমাকে খোলা আকাশের এক পশলা ঘ্রান এনে দেয়ǀ এই ফ্ল্যাটবাড়ির পাঁচিলের ওপারের পড়শির আমগাছের বেশিরভাগটাই হেলে পড়েছে এদিকেǀ

সেই গাছের পাতায়-পাতায় শাখায়-শাখায় মৃদুমন্দ ছন্দে টিপ টিপ সুর বেজে চলেছে সেই সকাল থেকে। মাথার উপর দিয়ে ভেসে চলেছে মেঘ ǀ কালো রঙেরও কত বৈচিত্র থাকে তা এই আষাঢ়ের মেঘ না দেখলে বোঝা মুশকিলǀ মেঘের কোনও কোনও টুকরোতো মনে হচ্ছে মাথার ঠিক উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। ছোটবেলায় এমন মেঘ দেখে আমার খুব ইচ্ছে হতো গ্রামের বাড়ির আকাশমনি গাছটার মগডালে উঠে তুলো জড়ানো লাঠি দিয়ে মেঘগুলোকে ছুঁয়ে দেখিǀ

আজকের এই উড়ন্ত মেঘ আর তার বাদলা দিনের টিপ টিপ নৈঃশব্দ এক ঝটকায় আমাকে নিয়ে গেল অবুঝ শৈশব থেকে দুরন্ত যৌবনেǀ এমনি এক টিপ টিপ বৃষ্টিভেজা দিন। শহরের কলেজ থেকে শনিবারে বাড়ি ফিরেছি। তিন দিন বাড়িতে কাটানো হয়ে গেল, কিন্তু কণিকার সঙ্গে একবারও দেখা হল নাǀ তখন তো আর হাতে হাতে মোবাইল ফোন ছিল না, যে শুধু মুধু খোশগল্প করতে ইচ্ছে হলেই আঙুলের স্পর্শে পৌঁছে যাব ওর কাছেǀ ওদের বাড়িতে যাওয়া যায়। কিন্তু প্রত্যেকবার যাওয়ার আগে একটা যুৎসই কারণ বানিয়ে নিয়ে ব্যাখ্যা করতে হয় ওর বাড়ির লোককে। সেই সঙ্গে যেন কিছুটা কণিকাকেও। কারণ সেই অর্থে ও আমার বন্ধু ছাড়া কিছুই ছিল না, অন্তত ওর তরফ থেকেǀ আর একটা মেয়ে বন্ধুর বাড়িতে হাজির হতে কিছু বাহানা তো বানাতেই হতোǀ

ক’দিন ধরে এক নাগাড়ে বৃষ্টি পড়ছে। এক ঘেয়ে টিপ্ টিপ শব্দ কোন এক গভীর থেকে বিষাদ সিন্ধুর ধারা বইয়ে দিচ্ছেǀ কেমন যেন একটা মনে হচ্ছে এই পৃথিবীতে আমার জন্য কেউ নেই। কিছু নেই। আমি দাঁড়িয়ে আছি এক মহা শূণ্যের মাঝেǀ ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছিল কণিকাকেǀ শেষ পর্যন্ত পৌঁছে গেলাম স্টেশনে। ও রানাঘাটে টিউশন পড়তে যায়। ট্রেন মোটামুটি এক ঘন্টা পরপর এবং ওর ফেরার ট্রেন আমি জানি। যেটা জানতাম না, সেটা হল এই ঘ্যান-ঘেনে বৃষ্টির মধ্যে ও কি বেড়িয়েছে?

অবশেষে আমার প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে সত্যি সত্যি কণিকা ট্রেন থেকে নামল। আমাকে দেখেই বললো, তুই?

‘তোকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল’, সরাসরি সেদিন বলেই ফেললাম। সেই ঘ্যানঘেনে বৃষ্টিই সেই মুহূর্তে আমাকে দুঃসাহসিক প্রেরণা জুগিয়েছিলǀ কণিকা অবশ্য সেকথা শুনেও শুনল না। বরং পুনরায় জিজ্ঞাসা করল কবে এসেছিস? প্রশ্ন আরও করেছিল। ছাতা আনিসনি তো; যাবি কি করে? এই বৃষ্টিতে এক ছাতায় যাওয়া যাবে?

বৃষ্টি থেমে আসার জন্য বৃথা অপেক্ষা শেষে যখন একটা ছাতার নিচে দু’জনে হাঁটতে শুরু করলাম, তার পরই ঝম ঝম করে মুষলধারায় বৃষ্টি নেমে এল। বৃষ্টির তোরে শরীর তো দূরস্থান, মাথাও বাঁচানো গেল নাǀ তাতে আমার অবশ্য কোনও আপত্তি ছিল না। মনে হল আপত্তি ওরও ছিল না। তবুও ওর মুখে উৎকণ্ঠা ‘এই বৃষ্টির মধ্যে ভিজে ভিজে যাচ্ছি। বাড়িতে কী বলবে?’ একটা ছাতায় দু’জনের হাত। ওর হাত উপরে, আমার নিচেয় উপর নিচ হলেও হাতের সাথে হাত মেশানো। হাঁটতে হচ্ছে শরীরের সঙ্গে শরীর মিশিয়েǀ বৃষ্টি ভেজা দিনের সেই স্পর্শ সুখের আনন্দ যে ফল্গুধারার সঞ্চার ঘটিয়েছিল, তা বর্ণনা করার মতো ভাষা অন্তত আমার কাছে নেইǀ ওর বাড়ির কাছকাছি পৌঁছে ও বলল, ‘এবার তুই যা। কেউ যদি এই অবস্থায় দেখে ফেলে খুব বাজে হয়ে যাবে! কিন্তু তুই যাবি কি করে? বিদ্যুৎও চমকাচ্ছে। তুই বরং কোথাও দাঁড়িয়ে যা। বৃষ্টিটা একটু ধরে এলে যাস- ভিজিসনা ঠান্ডা লেগে যাবেǀ’

‘ভিজতে কি বাকি আছে কিছু! আমার কথা ভাবিস না। আমার কিছু হবে না’, আমি মুচকি হেসে ওর ছাতার নিচ থেকে বেরিয়ে হাঁটা দিলাম। এতক্ষনে খেয়াল করলাম যে সেই আকাশ ভাঙা বর্ষণের মাঝে কোনও পথচারী আশেপাশে কোথাও নেইǀ বর্ষণের ঘনঘটায় মনের হরষে একটা গান ধরলাম, ‘মন মাঝিরে তুই খেয়াতে আজ দিলি যে পাল তুলে / যাবি রে ভেসে কে জানে কোন কূলেǀ’

আজও বৃষ্টি হচ্ছে। এখনও ঘরে আমি একা। কিন্তু সদ্য যৌবনের সে উন্মাদনা এখন সুদূর অতীত। যেন সেটা ছিল অন্য কোনো জন্মǀ কণিকার কোনও খবর আর জানি না। জানার চেষ্টাও সেভাবে করা হয়নি ওর বিয়ের পর। তবুও আজ এই মুহূর্তে ভীষণ মনে পড়ছে ওকে। এক মুহূর্তের জন্য ভুলে যেতে ইচ্ছে করছে ফেলে আসা মাঝের সময়ǀ আজ মনে হচ্ছে যে এমন এক বৃষ্টি ভেজা সাঁঝের বেলায় ও নিশ্চয় বসে আছে খোলা জানালার ধারে। হঠাৎ ডানা মেলে উড়ে গিয়ে হাজির হতে ইচ্ছে করছে। ওর জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়ে বলতে ইচ্ছে করছে ‘তোকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছিলো তাই চলে এলামǀ’

এই প্রতিবেদনটি ‘আষাঢ়ের গল্প’ কনটেস্ট থেকে সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE