Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
সাত মিনিটেই জামিন

এজলাস থেকে বেরিয়ে এসেই হুঙ্কার সনিয়ার

বড় জোর সাত মিনিট! এবং ওইটুকু সময়ের মধ্যেই ‘হাই ভোল্টেজ’ ন্যাশনাল হেরাল্ড মামলায় সনিয়া গাঁধী ও রাহুল গাঁধীর নিঃশর্ত জামিন মঞ্জুর করে দিল আদালত।

আদালত চত্বরে কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী ও সহ-সভাপতি রাহুল গাঁধী। শনিবার নয়াদিল্লিতে। ছবি: পিটিআই।

আদালত চত্বরে কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী ও সহ-সভাপতি রাহুল গাঁধী। শনিবার নয়াদিল্লিতে। ছবি: পিটিআই।

শঙ্খদীপ দাস
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০১৫ ০৩:২২
Share: Save:

বড় জোর সাত মিনিট! এবং ওইটুকু সময়ের মধ্যেই ‘হাই ভোল্টেজ’ ন্যাশনাল হেরাল্ড মামলায় সনিয়া গাঁধী ও রাহুল গাঁধীর নিঃশর্ত জামিন মঞ্জুর করে দিল আদালত। অভিযোগকারী বিজেপি নেতা সুব্রহ্মণ্যম স্বামী জামিনের বিনিময়ে অভিযুক্তদের পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করে বিদেশযাত্রার ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের দাবি তুললেও তা ধোপে টেকেনি। ‘সমাজের প্রতিষ্ঠিত মানুষগুলির’ ওপর এমন নিয়ন্ত্রণ আরোপে রাজি হল না আদালত।

এই জামিনের পরেও ‘ন্যাশনাল হেরাল্ড’ বিতর্ক কিন্তু সাময়িক বিরতি পেল না। বরং বলা চলে, অন্য মাত্রা পেল। দলের একাধিক ওজনদার নেতাকে নিয়ে আদালতে হাজির হলেও এজলাসে সনিয়া-রাহুলের শরীরী ভাষা ছিল যথেষ্ট নরম। এমনকী জামিনের জন্য প্রয়োজনীয় মুচলেকা লিখে দিতেও দ্বিধা করেননি তাঁরা। কিন্তু জামিন নিয়ে মা-ছেলে বাইরে পা রাখতেই শীতের রাজধানীর উত্তাপ বেড়ে গেল বহুগুণ! ইন্ডিয়া গেট লাগোয়া এই নিম্ন আদালত থেকে ২৪ আকবর রোড গাড়িতে মিনিটখানেকের ব্যবধান। ওইটুকু পথ যেতেই এজলাসের যাবতীয় সংযম ঝেড়ে ফেললেন কংগ্রেস সভানেত্রী!

দলের সদর দফতরের সামনেটা তখন নেতা-কর্মীদের থিকথিকে ভিড়। ক্ষোভে ফুটছে। তাঁদের সামনে দাঁড়িয়ে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে কার্যত জেহাদ ঘোষণা করলেন সনিয়া। শীর্ষ নেতাদের দু’পাশে নিয়ে তিনি বলেন, ‘‘জেনেবুঝে সরকার বিরোধীদের নিশানা করছে। সে জন্য সরকারি এজেন্সিগুলোকে ব্যবহার করছে। কিন্তু ভয় পাওয়ার বান্দা আমরা নই।’’ রাহুলের সুর ছিল আরও ঝাঁঝালো। সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর নাম তুলে কংগ্রেসের সহ-সভাপতি বলেন, ‘‘মোদীজি মিথ্যা আরোপ লাগিয়ে বিরোধীদের ঝোঁকাতে চাইছেন। কিন্তু আমরা ঝোঁকার পাত্র নই। এক ইঞ্চিও পিছু হঠব না।’’


সবিস্তার পড়তে ক্লিক করুন...

এ ক্ষেত্রে কংগ্রেসের যুক্তি, রাহুল-সনিয়ার বিরুদ্ধে মামলাটি করেছেন বিজেপি নেতা সুব্রহ্মণ্যম স্বামী এবং তাঁর অভিযোগের ভিত্তি নেই বলে তদন্ত বন্ধ করে দিতে চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর চক্ষুশূল হয়েছেন এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের (ইডি) আগের প্রধান রাজন কাটোচ। নরেন্দ্র মোদীর নির্দেশে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে তাঁকে। পরের ইডি-প্রধান এসে নতুন করে তদন্ত শুরু করেছেন।

এর পাল্টা যুক্তি দিতে ছাড়ছে না বিজেপি শিবিরও। তাদের বক্তব্য, ২০১৩-র জানুয়ারিতে দিল্লির আদালতে মামলাটি করেছিলেন স্বামী। তখন তিনি মোটেই বিজেপির সদস্য ছিলেন না। আর কাটোচকেও হেরাল্ড তদন্তের কারণে ইডি থেকে সরানো হয়নি। তাঁর চাকরির মেয়াদ যখন তৃতীয় বারের জন্য বাড়ানো হয়, তখন তাঁকে পদোন্নতি দিয়ে ভারী শিল্প মন্ত্রকের সচিব করা হয়েছিল। তিনি এক সঙ্গে দু’টি দায়িত্বই সামলাচ্ছিলেন। ফলে তুলনামূলক নিচু পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়াটাকে অপসারণ বলা যায় না, দাবি বিজেপির।

কিন্তু কংগ্রেস যে ‘ন্যাশনাল হেরাল্ড’ মামলা নিয়ে সমান্তরাল ভাবে আইনি ও রাজনৈতিক লড়াই চালাবে, সেটা আজ সনিয়া রাহুলের মন্তব্য থেকে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। বিচার ব্যবস্থাকে না-চটিয়ে তাঁরা যেমন আইনি কৌশলে মেপে পা ফেলছেন, তেমনই মোদী সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসার রাজনীতির তকমা সেঁটে দেশ জুড়ে দলের কর্মীদের তাতাচ্ছেন।

এ দিন আদালতে কী হয়, সে দিকে নজর রাখার পাশাপাশি কৌতূহল ছিল কংগ্রেসের আইনি কৌশলের দিকেও। সনিয়া-রাহুল-সহ কংগ্রেসের ৬ অভিযুক্ত নেতাকেই পঞ্চাশ হাজার টাকার ব্যক্তিগত বন্ড ও এক জন করে জামিনদারের বিনিময়ে জামিন মঞ্জুর করে আদালত। সনিয়ার জামিনদার হন প্রবীণ কংগ্রেস নেতা এ কে অ্যান্টনি। আর রাহুলের জামিনদার হন বোন প্রিয়ঙ্কা বঢরা। আর এক অভিযুক্ত শ্যাম পিত্রোদা চিকিৎসার জন্য বিদেশে থাকায় হাজির হতে পারেননি। সুব্রহ্মণ্যম স্বামী তাঁর বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির দাবি তুললে বিচারক জানান, পরের শুনানি দিন পিত্রোদা হাজির না-হলে তখন বিষয়টি দেখা যাবে। পরবর্তী শুনানি ২০ ফেব্রুয়ারি। এজলাস থেকে বেরিয়ে কপিল সিব্বল ও অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি জানিয়ে দেন, ২০ ফেব্রুয়ারি আদালতে হাজির হতে প্রস্তুত অভিযুক্তরা। সে জন্য কোনও ছাড়ও চাওয়া হয়নি।

তবে কংগ্রেস সূত্র জানাচ্ছে, আইনি প্রশ্নে আজ এই নমনীয়তা দেখালেও তলে তলে অন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে দল। নিম্ন আদালতে পরবর্তী শুনানির আগেই সুপ্রিম কোর্টে যাবে কংগ্রেস। সনিয়া-রাহুলের বিরুদ্ধে সুব্রহ্মণ্যম স্বামী মামলা দায়ের করার পরে কংগ্রেস স্থগিতাদেশ চেয়েছিল। দিল্লি হাইকোর্ট সেই আবেদন খারিজ করে জানায়, ন্যাশনাল হেরাল্ড নিয়ে অভিযোগে ‘অপরাধের গন্ধ রয়েছে’। হাইকোর্টের সেই পর্যবেক্ষণ খারিজের জন্য আবেদন করার পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্টের কাছে নিম্ন আদালতের মামলাটাই খারিজের আবেদন জানাতে পারেন সিব্বল-সিঙ্ঘভিরা।

সুব্রহ্মণ্যম স্বামীর অভিযোগ, রাজনৈতিক দল হিসেবে চাঁদা থেকে যে করমুক্ত আয় হয়েছে, তা দিয়ে ন্যাশনাল হেরাল্ডের ঋণ মেটাতে চেয়েছে কংগ্রেস। আবার ইয়ং ইন্ডিয়া নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে সনিয়া-রাহুল ন্যাশনাল হেরাল্ডের কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি হাতাতে চেয়েছেন। কংগ্রেসের পাল্টা যুক্তি, ন্যাশনাল হেরাল্ডের বোর্ডে যাঁরা রয়েছেন, তাঁরাই ইয়ং ইন্ডিয়ার কর্ণধার। সুতরাং কে কাকে ঠকাবে? তা ছাড়া ইয়ং ইন্ডিয়া একটি অমুনাফাভোগী সংস্থা। তার বোর্ডের সদস্য হিসেবে এক টাকা মুনাফা বা সুবিধা নেওয়ার ক্ষমতা নেই সনিয়া-রাহুলের। তবে সনিয়া-রাহুলরা বিলক্ষণ বুঝছেন যে, এই মামলার তাঁরা কিছুটা হলেও প্যাঁচে। আর সেটা বুঝেই এ বার হিসেবের খাতাপত্র ঠিক করতে নেমেছে কংগ্রেস! ন্যাশনাল হেরাল্ডের চরিত্র বদলেরও চেষ্টা শুরু হয়েছে। এ জন্য সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়ে জরুরি ভিত্তিতে ন্যাশনাল হেরাল্ডের সাধারণ সভা ডাকা হয়েছে। নোটিসে বলা হয়েছে, ন্যাশনাল হেরাল্ডের চরিত্র বদল করে কোম্পানি আইনের ৮ নম্বর ধারায় এনে সেটিকেও অমুনাফাভোগী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হবে। অর্থাৎ

ন্যাশনাল হেরাল্ড বা ইয়ং ইন্ডিয়া দু’টিই যদি অমুনাফাভোগী সংস্থা হয়, তা হলে টাকা জালিয়াতির কোনও আশঙ্কা নেই।

কিন্তু স্বামীর মতে, এই মারপ্যাঁচে চিঁড়ে ভিজবে না। আদালত থেকে বেরিয়ে তিনি বলেন, ‘‘সনিয়া-রাহুলকে আদালত পর্যন্ত যে হিড়হিড় করে টেনে আনতে পেরেছি, মানুষ তাতেই খুশি!’’ কংগ্রেস যাতে সহানুভূতি আদায় করতে না-পারে, সে জন্য মাঠে নেমেছে বিজেপি-ও। আর সেটা করতে গিয়ে নরেন্দ্র মোদীর ‘কংগ্রেস মুক্ত ভারত মানেই দুর্নীতি মুক্ত ভারত’— এই পুরনো স্লোগানের আশ্রয় নিতে হল তাদের! মন্ত্রী মুখতার আব্বাস নকভি বললেন, ‘‘সকলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করে। ইতিহাসে এই প্রথম বার দুর্নীতির পক্ষে লড়াই করতে দেখা গেল কংগ্রেসকে!’’

এই আকচাআকচির মধ্যে রাজনীতিকরা বলছেন, হেরাল্ড-মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির সম্ভাবনা কম। বরং রাজনীতিটাই এখন বাস্তব। এবং সে দিক থেকে বিজেপির বিরুদ্ধে আজ বড় অস্ত্র পেয়ে গিয়েছে কংগ্রেস।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

National Herald case sonia gandhi rahul gandhi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE