একে বর্ষশেষের দিন, তায় রবিবার। কিন্তু এমন রাতেও আনন্দ নয়, উৎকণ্ঠাকে সঙ্গী করেই নতুন বছরে পা রাখল অসম। টানা ছুটির বড়দিন থেকে বর্ষশেষ— প্রমোদভ্রমণ দূরের কথা, গভীর রাত পর্যন্ত দফতরে ব্যস্ত সরকারি আমলা-কর্মীরা। এমনটাই ছুটিহীন তাঁদের কেটেছে গত দু’মাস। সপ্তাহান্তের রাতে ১০টা পর্যন্ত সাংবাদিকদের সঙ্গে বসে মুখ্যমন্ত্রী। খাবার টেবিলে আশা-আশঙ্কার আলোছায়া। চর থেকে মহানগর, বরাক থেকে ব্রহ্মপুত্র বর্ষশেষের মধ্যরাতে উৎসবের জৌলুসে নয়, অধীর অপেক্ষায় চোখ রাখল সরকারি ওয়েবসাইটে। সৌজন্যে ‘জাতীয় নাগরিক পঞ্জি’ বা ‘এনআরসি’।
রাজ্যে ৩ কোটি ২৯ লক্ষ আবেদনকারী ছিলেন। প্রথম খসড়ায় ২ কোটি ২৪ লক্ষের আবেদন যাচাইয়ের লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হলেও রেজিস্ট্রার জেনারেল অব ইন্ডিয়া শৈলেশ জানান, আজ মধ্যরাতে প্রকাশিত প্রথম খসড়ায় ১ কোটি ৯০ লক্ষের নাম স্থান পেয়েছে। বাকি নাম পরে ঘোষণা হবে। রাজ্য খসড়া প্রকাশে আরও সময় চাইলেও, বারে বারে সময় পিছোনোয় বিরক্ত সুপ্রিম কোর্ট ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যেই খসড়া প্রকাশে নির্দেশ দেয়। মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল বলেন, “১৯৫১ সালের পরে ভারতে এই প্রথম কোনও রাজ্য এনআরসি নবীকরণে হাত দিয়েছে। তাই কী ভাবে কাজ চলবে, তার আগাম অভিজ্ঞতা কারও ছিল না। কাজ করতে করতেই শিখেছেন ৪০ হাজার কর্মী। ভিন রাজ্য থেকে লিগ্যাসি ডেটা যাচাইয়ে সমস্যা হয়েছে। বাড়ি গিয়ে আবেদনপত্র যাচাই ছিল সময়সাপেক্ষ কাজ।’’ মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, বিভিন্ন দফতরের অন্যান্য কাজও থমকে ছিল এত দিন। কিন্তু চেষ্টা ছিল যাতে কোনও প্রকৃত ভারতীয়ের নাম বাদ না পড়ে, কোনও বিদেশির নাম না ঢোকে।
আজ মধ্যরাতে প্রথম খসড়া প্রকাশ পেলেও ১ জানুয়ারি সকাল থেকে মানুষ নিজের ও পরিবারের নাম যাচাই করতে পারবেন। www.nrcassam.nic.in, www.assam.mygov.in, www.assam.gov.in, www.homeandpolitical.assam.gov.in— এই চারটি ওয়েবসাইট ছাড়াও ৯৭৬৫৫৫৬৫৫৫ নম্বরে এসএমএস করেও নিজের নাম যাচাই করা যাবে। ২৫০০টি এনআরসি সেবাকেন্দ্রে ১ জানুয়ারি সকাল ৮টা থেকে নাম দেখা যাবে।
এনআরসি-র প্রথম খসড়ায় নাম না-থাকলেও পরবর্তী খসড়াগুলিতে প্রমাণপত্রের ভিত্তিতে নাম তোলা যাবে বলে সরকারের তরফে বারবার প্রচার করা হয়েছে। তবে সরকারের আশঙ্কা যে সব জেলায় খসড়ায় কম নাম উঠছে, সেখানে ঝামেলা বাধতে পারে। ৮৫ কোম্পানি অতিরিক্ত আধাসেনা মোতায়েন করা হয়েছে। কিন্তু পুলিশ ও প্রশাসনের মূল মাথাব্যথার কারণ ‘সোশ্যাল মিডিয়া’। সোনোয়াল জানান, সোশ্যাল মিডিয়ায় গুজব ছড়ানো রুখতে পুলিশের বিশেষ সেল কাজ করছে।
উৎকণ্ঠা ব্রহ্মপুত্রের চেয়ে বরাকে বেশি। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মধ্যে উপজাতি ও চা শ্রমিকদের সুপ্রিম কোর্ট আদি বাসিন্দা হিসেবে আগেই জানিয়ে দিয়েছে। বাকিরা জানেন, বাংলাদেশি খুঁজে বের করতেই এনআরসি-র নবীকরণ। সংখ্যালঘু অধ্যূষিত এলাকাগুলির মানুষ প্রথমে শঙ্কিত থাকলেও এখন তাঁরা এনআরসি-কে স্বাগত জানাচ্ছেন। কারণ, তাঁদের মতে এনআরসি তালিকায় নাম উঠে গেলে নিত্যদিন ‘বাংলাদেশি’ গঞ্জনা থেকে তাঁরা মুক্তি পাবেন। কিন্তু বাঙালিপ্রধান বরাক উপত্যকায় এনআরসি ছাড়া আলোচনা নেই। বর্ষশেষে বনভোজন জমেনি। গানমেলায়ও শ্রোতা নেই। অবশ্য তুলনায় কম উদ্বেগে গুয়াহাটির বাঙালিরা। কারণ তাঁদের বাড়ি এসে যাচাইপর্ব ভাল ভাবেই মিটেছে। এখানে ১৯৭১-র পরে আসা বাঙালির সংখ্যা অতি নগণ্য।
বরাকে সরকারি ভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, করিমগঞ্জে প্রথম খসড়ায় ৫০ শতাংশ নাগরিকের নাম থাকবে। কাছাড়ে ৩৩-৩৪ শতাংশ। হাইলাকান্দিতে আরও কম, ৩০ শতাংশ। তার অর্থ দ্বিতীয় বা তৃতীয় খসড়ার জন্য অনিশ্চিত অপেক্ষা। তাই অস্বস্তি-আশঙ্কা নিয়েই নতুন বছরে পা দিলেন বরাকের বাঙালিরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy