Advertisement
১০ মে ২০২৪
ভুয়ো খবরে ‘চৌকিদারি’

ফিনল্যান্ড পারে, আমরা পারি না!

হোয়াইট হাউসে আসার আগে ট্রাম্পের প্রচারসভার এই ভিডিয়োটা সত্যি। তবে অডিয়োটা জাল। একটু খুঁটিয়ে শুনলেই বোঝা যায়, ‘ডাব’ করা। নেহাতই নিরীহ, কিন্তু নিমেষে ভাইরাল।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ০৩ জুন ২০১৯ ০৩:৪৭
Share: Save:

বয়স বছর তিনেকের বেশি নয়। সোনালি চুল। আর পরনে গাঢ় নীল স্যুট। খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কোলে, তবু কি বেপরোয়া! কেবল নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত খুদে। ফাঁক বুঝে ট্রাম্প তবু প্রশ্নটা করেই ফেললেন— ‘‘হু ডু ইউ লাইক দ্য মোস্ট?’’ উত্তরে ‘মোদী’, বলেই সে আবার ফিরে গেল নিজের জগতে। আমোদিত ট্রাম্প, হাসির তুফান উঠল ভরা সভাতেও।

হোয়াইট হাউসে আসার আগে ট্রাম্পের প্রচারসভার এই ভিডিয়োটা সত্যি। তবে অডিয়োটা জাল। একটু খুঁটিয়ে শুনলেই বোঝা যায়, ‘ডাব’ করা। নেহাতই নিরীহ, কিন্তু নিমেষে ভাইরাল। আসল মজাটা টের পাওয়ার আগে ‘দিনে-দেড়-জিবি-ডেটা’-র কল্যাণে সম্প্রতি এই ভিডিয়োটা ছড়িয়ে পড়েছিল ভারতের ঘরে-ঘরেও। ফিনল্যান্ডে কিন্তু ছবিটা উল্টো। সে দেশের ছেলেমেয়েরা কিন্ডারগার্টেন থেকেই ‘ডিজিটাল গোয়েন্দা’ হওয়ার পাঠ নিচ্ছে। উদ্যোগটাও সরকারি। ভুয়ো খবরের মোকাবিলায় ২০১৪-য় সরকারি ফ্যাক্ট-চেকিং সংস্থা ‘ফ্যাক্টবার’-কে সঙ্গে নিয়ে মাঠে নামে ফিনল্যান্ড প্রশাসন। মার্কিন ভোটে রুশ হস্তক্ষেপের অভিযোগ উঠতে তখনও বছর দুয়েক বাকি।

ভুযো খবর ঠেকাতে শুধু আগামী প্রজন্ম নয়, দায়িত্ব নিতে হবে দেশের প্রত্যেক নাগরিককে— ডাক দিয়েছেন ফিনিস প্রেসিডেন্ট সাউলি নিনিস্তো। ২০১৬ থেকে সরকারি আমন্ত্রণে আমেরিকা থেকে এক ঝাঁক বিশেষজ্ঞ যাতায়াত করছেন হেলসিঙ্কিতে।

যার ফল মিলেছে সদ্য, হাতেনাতে। সোফিয়ার ওপেন সোসাইটি ইনস্টিটিউটের সমীক্ষা বলছে, ‘মিডিয়া-লিটারেসি’ সূচকে ৩৫টি ইউরোপীয় দেশের মধ্যে এখন ফিনল্যান্ডই প্রথম। ওয়র্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্টেও সব চেয়ে সুখী এই নর্ডিক দেশই। সংবাদমাধ্যমের ‘বাক্-স্বাধীনতা’ দ্বিতীয় হলেও, দেশীয় সংবাদমাধ্যমের প্রতি ফিনিসদের আস্থা কিন্তু এক নম্বরে।

এই দেশে সকলেই আড়চোখে সকলকে দেখে। অর্থাৎ যা পেলাম, তা-ই বিশ্বাস করে শেয়ার করে দিলাম—এই প্রবণতা ফিনিস স্কুলপড়ুয়াদের মধ্যে অনেকটাই কমেছে বলে জানালেন হেলসিঙ্কির ফ্রেঞ্চ-ফিনিস স্কুলের ডিরেক্টর তথা ইউরোপিয়ান স্কুলস-এর প্রাক্তন ডিরেক্টর জেনারেল কারি কিভিনেন। ইমেলে লিখলেন, ‘‘সাম্প্রতিক ভোটে রাজনৈতিক নেতাদেরও দেখেছি, অনলাইনে কিছু লেখা বা শেয়ার করার আগে অন্তত দু’বার ভাবছেন।’’

ভারত কিন্তু দিব্যি ‘ভোটে ভাইরাল’। ভোটের পরেও। ভুয়ো ওয়েবসাইটে দেদার ছড়াচ্ছে ভুয়ো খবর, হোয়াটসঅ্যাপ শেয়ারে যা-খুশি-তাই। ফেসবুকেও লাগামছাড়া অপপ্রচার। ভুয়ো খবরের জেরে কোথাও দাঙ্গা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তো কোথাও গণপিটুনিতে গণমৃত্যু। ‘শেয়ার’ বাজারে তবু ঘাটতি নেই।

কিন্তু এ সব আটকানোর কি কোনও উপায় নেই! ফ্যাক্ট-চেকার পঙ্কজ জৈন বললেন, কড়া আইন ছাড়া রাস্তা নেই। ২০১৫ থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘স্বচ্ছ অভিযান’ চালাচ্ছে তাঁর সংস্থা। পঙ্কজের কথায়, ‘‘এই চার বছরে অনেকটাই বদলে গিয়েছে ভুয়ো খবরের চরিত্র। সেই সময়ে কোল্ড ড্রিঙ্কে এইচআইভি সংক্রমণ, নাসা-র উপগ্রহচিত্রে দীপাবলির ভারত-দর্শন ইত্যাদি বাজার গরম করলেও, এখনকার ভুয়ো খবরের ভিত পুরোপুরি রাজনৈতিক অথবা সাম্প্রদায়িক বলে মত পঙ্কজের।

ভুয়ো খবরের চরিত্রবদলের কথা মানলেন ফ্যাক্ট-চেকিং ওয়েবসাইট অল্ট নিউজের প্রধান প্রতীক সিনহাও। ফোনে বললেন, ‘‘মোবাইলের পাশাপাশি ইন্টারনেটও সস্তা হওয়ায় বিপদ বেড়েছে। তাই মূলস্রোতের সংবাদমাধ্যমের বাইরে কোনও খবর নজরে এলেই আমাদের প্রশ্ন করা উচিত। বুঝতে হবে, এই খবরে আবেগের এত বাড়াবাড়ি কেন!’’

লোকসভা ভোটে শুরুর দেড় বছর আগে থেকে ভুয়ো ধরার ফাঁদ পেতেছিলেন প্রতীক। যেখানে বারবার উঠে এসেছে ভিত্তিহীন অপপ্রচার। মেরুকরণের একটা স্পষ্ট চেষ্টা। সম্প্রতি প্রকাশিত একটি খবর বলছে, বঙ্গে আসন বাড়াতে ২০১৮ থেকে এখানে মোতায়েন করা হয়েছিল গেরুয়া হোয়াটসঅ্যাপ বাহিনী। বিজেপি আইটি সেলের প্রায় হাজার দশেক কর্মী কাজ করেছেন ভোট টানতে।

ফিনল্যান্ড সরকারি উদ্যোগে কামাল করলেও, গদির জন্য ভারতে শাসক দলেরই এই ওয়েব-যুদ্ধ সিঁদুরে মেঘ দেখাচ্ছে বিশেষজ্ঞদের। সম্প্রতি ফেসবুক, গুগ‌্ল ভুয়ো খবর ঠেকাতে উদ্যোগ নিলেও হোয়াটসঅ্যাপে ফরোয়ার্ড মেসেজ-ছবি বা ভিডিয়ো ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করেছে
বলে মত প্রতীক, পঙ্কজদের। কারণ ‘এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশন’ প্রযুক্তির কারণে এই মাধ্যমে কে, কোন খবর কবে ছড়িয়েছেন, তা ধরা সম্ভব নয়।

এমন ‘ডিজিটাল দাবানল’ যে ছড়াতে পারে, ২০১৩-য় তার আভাস দিয়েছিল ওয়র্ল্ড ইকনমিক ফোরামের গ্লোবাল রিস্ক রিপোর্ট। ভুয়ো খবর ঠেকাতে কড়া আইন আনার কথা বলছে সিঙ্গাপুর, জার্মানি, ফ্রান্সের মতো বহু দেশ। মালয়েশিয়া যেমন আইন করেছে। প্রায় ৫৫ লক্ষের দেশ ফিনল্যান্ড কিন্তু ভুয়ো
খবর ঠেকাতে সাধারণ ‘গুগ্‌ল
সার্চ’ আর ‘রিভার্স ইমেজ’ সার্চ অস্ত্রেই শান দিচ্ছে। আস্থা রাখছে ভবিষ্যৎ-ভোটারের’‘যুক্তিগ্রাহ্য চিন্তা’-র উপরে।

কিন্তু ১৩০ কোটির বিশাল ভারতবর্ষে কি এমন আম-সচেতনতা গড়ে তোলা সম্ভব? সন্দেহ প্রকাশ করলেন মুম্বইয়ের পঙ্কজ। কলকাতার মনঃসমাজকর্মী মোহিত রণদীপ বললেন, ‘‘ডব্লিউএইচও যে এগারোটি জেনেরিক লাইফ স্কিলের কথা বলে, তার মধ্যে ক্রিটিক্যাল থিঙ্কিং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এখানে তো প্রশ্নহীন আনুগত্যটাই ট্র্যাডিশন। রাষ্ট্রও চায় না, তার নাগরিকের মধ্যে যুক্তিগ্রাহ্য চিন্তা তৈরি হোক। তবে চেষ্টা করলে আমরাও পারি।’’

আশাবাদী প্রতীকও। বললেন, ‘‘স্কুল-কলেজের পাঠ্যসূচির মধ্যে একটা বিশেষ মডিউল রেখে সচেতনতা বাড়ানোর কথা আগেই ভেবেছি। এ বার এগোব।’’ জানালেন, এ নিয়ে কথা বলবেন দিল্লি, কেরল এমনকি পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গেও। কিন্তু এ রাজ্যের শাসকদল কি চাইবে মানুষ যুক্তি দিয়ে ঠিক-ভুল বিচার করুক। প্রতীকের দাবি, ‘‘আমার বিশ্বাস, চাইবে। অর্থ ও লোকবলে অসীম ক্ষমতাধর বিজেপির সঙ্গে প্রোপাগান্ডার লড়াইয়ে পারছি না দেখলে, অনেক রাজ্যই চাইবে নিজের রাজ্যবাসীকে শিক্ষিত করে তুলতে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা না হোক, নিজেদের অস্তিত্বরক্ষার তাগিদেই তারা চাইবে— মানুষ প্রশ্ন করুক।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Finland Fake News
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE