অম্বেডকরের উত্তরাধিকারের লড়াই মহারাষ্ট্রের আকোলায়। নিজস্ব চিত্র।
তর্কটা বেশ জমে উঠেছিল। ভর বিকেলে আকোলার মুর্তিজাপুর রোডের পাশের একটি চায়ের দোকানে স্থানীয় কয়েক জন যুবক ও প্রৌঢ়। তর্কের বিষয়বস্তু, দলিত ও মুসলিম সম্প্রদায়ের ভবিষ্যৎ আসলে কী? তারা কি তা হলে চিরকাল রাজনৈতিক দলগুলোর হাতের পুতুল হয়ে থাকবে? আর নির্বাচন এলে তাদের ‘উন্নয়ন’ নিয়ে গলা ফাটিয়ে বাজার গরম করবে দলগুলো?
মহারাষ্ট্রের এই শহরে লোকসভা ভোটের আঁচ নিতে আসার অন্যতম প্রধান কারণ অবশ্যই প্রকাশ অম্বেডকর! আরও নির্দিষ্ট করে বললে, বি আর অম্বেডকরের নাতি প্রকাশ যে কেন্দ্রে দাঁড়িয়েছেন, সে কেন্দ্রের আকর্ষণ আর পাঁচটা কেন্দ্রের নির্বাচনী লড়াইয়ের থেকে আলাদা হতে বাধ্য।
কিন্তু, সেই আঁচ নিতে এসে এ হেন তর্কের সাক্ষ্য থাকতে হবে, তা অবশ্য আগে ভাবিনি। তাঁদের ক্ষোভের কারণটা কী? স্থানীয় যুবক রবীন্দ্র যা বললেন তা অবশ্যই প্রণিধান যোগ্য। তাঁর কথায়: ‘‘এই কেন্দ্রে ভোটের প্যাটার্নটা লক্ষ্য করলেই বুঝবেন। এখানে ভোট হয় জাতপাত আর ধর্মের ভিত্তিতে। ২০১৪-য় যা ছিল, এই ২০১৯-এও তা-ই আছে। ওবিসি ভোট আর মুসলিম ভোট কাদের দিকে যাচ্ছে, সে দিকেই যেন সব নজর! আরে বাবা, সবাইয়ের কথা ভেবে ভোটটা কর!’’
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
রবীন্দ্রের পাশ থেকে যোগীন বলে ওঠেন, ‘‘ভোট ভাগাভাগির কথাটাও বল। যারা শাসনক্ষমতায় থাকে, তারা চায় বিরোধী ভোটটা ভাগ হয়ে যাক। দেশের অন্যান্য জায়গায় জাতপাতের সঙ্গে অন্যান্য কারণেও ভোট ভাগ হয়, আর আমাদের আকোলায় ভোট ভাগ হয় শুধুমাত্র জাতপাত আর ধর্মের ভিত্তিতে।’’
রবীন্দ্র আর যোগীনের বৃহত্তর দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবিকই চমকে দেয়। আরও চমক জাগে, এই বিষয়টি নিয়ে চায়ের কাপে তুফান তোলাটা! যেন কলকাতায় আছি বলে মনে হয়।
বস্তুত, আকোলা কেন্দ্রে বিভিন্ন দলের ২০১৪-র প্রার্থী তালিকার সঙ্গে এ বারের তফাৎ প্রায় নেই। গত বারের বিজয়ী প্রার্থী সঞ্জয় ধোতরে-কে এ বারেও প্রার্থী করেছে বিজেপি। পাশাপাশি, কংগ্রেস এ বারেও মনোনয়ন দিয়েছে গতবারের প্রার্থী হিদায়েতুল্লা বরকতুল্লা পটেলকে। সঞ্জয় শুধু ২০১৪-ই নয়, ২০০৪ এবং ২০০৯-এও এই কেন্দ্র থেকে বিজয়ী হয়েছেন।
প্রকাশ অম্বেডকর।—নিজস্ব চিত্র।
আরও পড়ুন: মাটিতে পা পড়ছে না মোদী-শাহের, ভোটের লড়াই এখন মাঝ আকাশেও
বছরখানেক হল আসাদুদ্দিন ওয়েইসি-র নেতৃত্বাধীন এআইএমআইএম-এর সঙ্গে প্রকাশ অম্বেডকর তাঁর দল ভারিপ বহুজন মহাসঙ্ঘ-এর নতুন জোট তৈরি করেছেন। নাম দিয়েছেন ‘বঞ্চিত বহুজন আগাড়ি’ (ভিবিএ)। নামের মধ্যেই স্পষ্ট, তাঁদের জোটের সমর্থনের মূল ভিত্তি দলিত, অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি এবং মুসলিম সম্প্রদায়।
কংগ্রেসের সঙ্গে জোট সমঝোতা ভেস্তে যাওয়ার পরে ভিবিএ এ বার মহারাষ্ট্রের ৪৮টি লোকসভা আসনের সব কটিতেই প্রার্থী দিয়েছে। কোনও সন্দেহ নেই, কংগ্রেস এর ফলে তীব্র অস্বস্তিতে পড়েছে। কারণ, ভোটের সহজ পাটিগণিত বলছে, দলিত ও মুসলিম ভোট ভাগ হলে তা সব থেকে বেশি ক্ষতিকর হয়ে উঠবে কংগ্রেসের কাছে। স্বভাবতই বিজেপি-শিবসেনা জোটের স্বস্তির যথেষ্ট কারণ আছে।
আরও পড়ুন: আন্না-আম্মা নেই, জৌলুস অতীত, তামিলভূমের খরায় রাস্তা খুঁজছে বিজেপি-কংগ্রেস
মুখে যদিও বিজেপি নেতৃত্ব বিষয়টাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না, কিন্তু দলের নিচুতলার কর্মী-সমর্থকদের কথায় স্বস্তির ছাপ স্পষ্ট। আকোলার বিজেপি শিবিরের অভিমত, লড়াইয়ে ইতিমধ্যেই এক ধাপ এগিয়ে তারা। প্রকাশ্যে বিজেপি নেতৃত্ব বলছেন, ভোট ভাগাভাগি নিয়ে তাঁদের এমনিতেই কোনও মাথাব্যথা নেই। যেমন, আকোলা বাসস্ট্যান্ডের কাছে নিউ ক্লথ মার্কেটে নিজের কাপড়ের দোকানে বসে বিজেপির শহর সভাপতি কিশোর মাংতে পটেল বললেন, ‘‘এই আসনে আমাদের প্রার্থী তিন তিন বার জয়ী হয়েছেন। এ বারেও হবেন। এর আগেও প্রকাশ অম্বেডকর এই কেন্দ্রে দাঁড়িয়েছেন। আমরা ভোটে লড়ছি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উন্নয়নকে সামনে রেখে। আমরা মনে করি, দেশের নিরাপত্তা সুস্থিত করতে পারেন মোদীই।’’ যথারীতি পুলওয়ামা এবং বালাকোট প্রসঙ্গ টেনে আনেন কিশোর।
প্রকাশ অম্বেডকর মহারাষ্ট্রের সব কটি আসনে প্রার্থী দেওয়ার কথা ঘোষণা করার পরেই রাজনৈতিক মহলে প্রশ্ন ওঠে, আদপে কার সুবিধা করে দিলেন তিনি ও ওয়েইসি? এতে কি বিজেপিরই সুবিধা হয়ে গেল না? তা হলে কি এর পিছনে বিজেপিরও প্রচ্ছন্ন ভূমিকা আছে?
প্রকাশ অম্বেডকর আকোলায় ছিলেন না। তিনি গিয়েছিলেন তাঁর আর এক নির্বাচনী কেন্দ্র সোলাপুরে। আকোলায় ভোট ১৮ এপ্রিল, বৃহস্পতিবার। মুর্তিজাপুর রোডে দেখা হয় তাঁর দলের জনসংযোগের ভারপ্রাপ্ত প্রসন্নজিৎ গাওয়াইয়ের সঙ্গে। ওই অভিযোগ সরাসরি উড়িয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘এ সব কথা একেবারেই ঠিক নয়। এই লড়াইয়ের সঙ্গে সংবিধান বাঁচাও আন্দোলনেরও যোগ আছে। সংবিধান শুধু নির্দিষ্ট একটি সম্প্রদায়ের নয়, সব সম্প্রদায়েরই।’’ তা হলেও এতে তো বিজেপির সুবিধাই হল। নিশ্চিত ভাবেই কংগ্রেসের ভোটব্যাঙ্কেও আঘাত আসবে। প্রসন্নজিতের জবাব: ‘‘বালাসাহেব (প্রকাশ) এ বার যে ছোট ছোট সম্প্রদায়ের মানুষকে টিকিট দিয়েছেন তাঁরা আসলে বিজেপি-শিবসেনার ভোটার ছিলেন। আমরা সেই ভোটারদের আমাদের দিকে নিয়ে আসছি। কংগ্রেসের যে ভোটব্যাঙ্ক, অর্থাৎ পটেল সমাজ, সেই সমাজের দিকে বালাসাহেব হাত বাড়াননি।’’
আকোলায় কংগ্রেসের দফতর ‘স্বরাজ ভবন’-এ বসে শহর সভাপতি ববনরাও চৌধুরী সরাসরি প্রকাশের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল তোলেন। বলেন, ‘‘তিনি মহারাষ্ট্রের ৪৮ আসনে প্রার্থী দিয়ে নিঃসন্দেহে বিজেপির সুবিধা করে দিয়েছেন। এতে কংগ্রেসের সেকুলার ভোট কাটবেই। কংগ্রেস বহু বার তাঁর সঙ্গে জোট গড়ার প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছে। কিন্তু তিনি প্রতি বারই তা ভেস্তে দিয়েছেন। তিনি অবশ্যই বিজেপির ফয়দা তোলায় সাহায্য করার চেষ্টা করছেন।’’
১৯৫৬ সালের যে দিন মারা গিয়েছিলেন ‘বাবাসাহেব’ বি আর অম্বেডকর, তাঁর প্রয়াণের ৩৬ বছর পরে, সেই ৬ ডিসেম্বরই বাবরি মসজিদ ধ্বংস হয়। তিনি বেঁচে থাকলে এই ঘটনায় তাঁর প্রতিক্রিয়া কী হত জানা নেই। হয়তো বা বলতেন, এ কাদের হাতে আমরা সঁপেছি শাসনভার, যাঁরা দেশের ধর্মনিরপেক্ষতাকে রক্ষা করতে ব্যর্থ?
আজকের নির্বাচন-পূর্ব পরিস্থিতি দেখে রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের উত্তরাধিকার নিয়েও কি প্রশ্ন জাগত না ভীমরাও রামজি অম্বেডকরের?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy