ছবি: সংগৃহীত।
সাধারণ নির্বাচন রসনায় শান দেওয়ারই সময়। কিন্তু কখনও কখনও সেই শান এত বেশি হয়ে যাচ্ছে যে, অন্যদের কাছে তা মনে হচ্ছে মাত্রাছাড়া। বলিউডের পোস্টার শুধু নয়, এ ক্ষেত্রে কম যাচ্ছেন না ভোট ময়দানের রাজনীতিকেরাও। নির্বাচন কমিশনের কাছে পাঠানো ইন্ডিয়ান সাইকায়াট্রি সোসাইটি (আইপিএস)-এর চিঠি অন্তত সেটাই বলছে।
ভোটের ময়দানে এ রাজ্যে কেউ প্রতিপক্ষকে বলছেন, ‘‘ওটা পাগল।’’ কেউ আবার ভিন্ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর মুখে দলবদলের পূর্বাভাস শুনে মন্তব্য করেছেন, ‘‘ওর মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে! ডাক্তার দেখানো উচিত।’’ রাজ্যের বাইরেও ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’ লব্জের তালিকা দীর্ঘ। ভোট-প্রচারে প্রতিপক্ষকে ‘মানসিক রোগী’ বা ‘স্কিৎজ়োফ্রেনিয়ার রোগী’ বলছেন অনেক প্রার্থী। কেউ আবার বিরোধী পক্ষের নেতাকে ডিসলেক্সিয়ায় আক্রান্ত বলে কটাক্ষ করছেন। এই প্রেক্ষিতেই আইপিএসের লিগ্যাল সাব কমিটির চেয়ারপার্সন চিকিৎসক-অধ্যাপক রবীশ বি এন এবং কো-চেয়ারপার্সন সুরেশ বড়া মঠ কমিশনকে চিঠি দিয়ে তাঁদের আপত্তির কথা জানিয়েছেন। সেই চিঠিতে বলা হয়েছে, ভোটের প্রচারে রাজনীতিকেরা এমন ভাষা ব্যবহার করছেন, যা মানসিক রোগীদের পক্ষে ‘অবমাননাকর’ এবং ‘অমানবিক’। যার প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট রাজনীতিকদের যাতে ভাষার ব্যবহারে সতর্ক করা হয়, সেই আবেদন জানানো হয়েছে।
গত এপ্রিলে রাজকুমার রাও এবং কঙ্গনা রানাওয়াত অভিনীত ‘মেন্টাল হে ক্যায়া’র পোস্টার ও ছবির নামকরণ ঘিরে একই ভাবে আপত্তি জানিয়ে সেন্সর বোর্ডকে চিঠি দিয়েছিল আইপিএস। বিষয়টি আপাতত গুজরাত হাইকোর্টের বিচারাধীন। আইপিএস সূত্রের খবর, প্রাথমিক ভাবে সোসাইটির আপত্তির সারবত্তা রয়েছে বলে জানিয়েছে হাইকোর্ট। মামলার পরবর্তী শুনানি ১১ জুন।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
আইপিএসের পশ্চিমবঙ্গ শাখার সম্পাদক রঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘চলচ্চিত্রে বহুলাংশে মনোরোগীদের ভাবাবেগকে উপেক্ষা করা হয়। এমন ছবিও আছে, যেখানে দেখানো হয়েছে, মানসিক রোগীদের হিংস্র, তাঁরা খুন করতে পারেন। এই ধারার বদল চাই। একই ভাবে রাজনীতিকেরা যে-ধরনের আলটপকা মন্তব্য করেন, তা-ও নিন্দাজনক।’’ তিনি জানান, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য সমীক্ষা অনুযায়ী এ দেশে প্রতি পাঁচ জনের মধ্যে এক জন হতাশার শিকার। মানসিক রোগ যে-কারও হতে পারে। তাঁর কথায়, ‘‘মানসিক রোগী এবং তাঁদের পরিজন কী ধরনের যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যান, তা বুঝলে হয়তো ওঁরা এই ধরনের মন্তব্য করতেন না।’’
রবীশ ফোনে বলেন, ‘‘রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষের অধিকার সংক্রান্ত কনভেনশনে ভারত অন্যতম স্বাক্ষরকারী দেশ। আমাদের দেশেও যুগান্তকারী ‘মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন আইন ২০১৭’ পাশ হয়েছে। সেখানে রাজনৈতিক নেতারা এমন আচরণ করলে মানসিক রোগের সমস্যাকে কেউ গুরুত্ব দেবে না।’’ সংস্থার পূর্বাঞ্চলের প্রেসিডেন্ট চিকিৎসক গৌতম সাহার মতে, ‘‘নেতাদের
এই আচরণ বৈষম্যমূলক এবং অমানবিক। এতে সরাসরি মনোরোগীদের অধিকার হনন হয় এবং আইন অনুযায়ী তা শাস্তিযোগ্য।’’ রবীশের দাবি, আগামী দিনে সব স্তরের নির্বাচনে এই ধরনের বাক্য প্রয়োগের উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হোক। দিল্লিতে নির্বাচন কমিশনের এক প্রতিনিধি বলেন, ‘‘প্রচারে কোনও ব্যক্তির উদ্দেশে অশালীন মন্তব্যের ব্যবহারের ক্ষেত্রে আগেই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এই বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’’
জিভে রাশ টানতে হলে সব স্তরে বদলের প্রয়োজন অনুভব করছেন মানসিক স্বাস্থ্য আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত কর্মীরা। সেই সূত্রে ট্যাংরা থানার অন্তর্গত পাগলাডাঙার নাম পরিবর্তন হবে না কেন, সেই প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা। গবেষক মৌমিতা সাহা বলেন, ‘‘অজিতকুমার বসুর ‘কলিকাতার রাজপথ সমাজে ও সংস্কৃতিতে’, অতুলকৃষ্ণ রায়ের ‘কলকাতার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’ এবং পিটি নায়ারের ‘আ হিস্ট্রি অব কলকাতাজ স্ট্রিট’-এ পাগলাডাঙার নামকরণ কী ভাবে হল, তার উল্লেখ নেই। পলাশির যুদ্ধের পরে মির জাফর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ১৫টি ডিহি বিক্রি করেন। তার মধ্যে ৫৫টি গ্রাম ছিল। ডিহি এন্টালির মধ্যে যে-ছ’টি গ্রাম ছিল, তারই একটি পাগলাডাঙা!’’
মানবাধিকার কর্মী রত্নাবলী রায় বলেন, ‘‘অনেকে যুক্তি দেন, রবীন্দ্রনাথের গানে পাগল শব্দের অনেক ব্যবহার রয়েছে। তাই পাগল খারাপ কথা নয়। কিন্তু ভুললে চলবে না, যে-সংস্কৃতিতে পাগল শব্দটা ভোলা মন বা খেপা মন অর্থে ব্যবহার হত, সমাজের বিবর্তনের সঙ্গে তা পাল্টে গিয়েছে। এখন পাগল একটা গালাগালে পর্যবসিত। ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, তাঁদের কাছে এটা গালাগালের সমান। মানবাধিকারের ভাষায় কাউকে পাগল বলা যায় না। তাই সত্যজিৎ রায় ধরণী যদি হতে পারে, তাহলে পাগলাডাঙার নামও পরিবর্তন করতে হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy