ব্রহ্মপুত্রের বিস্তীর্ণ দু’পারে অসংখ্য মানুষের দিন-গুজরান বুকে নিয়ে যে রাজধানী শহর, প্রথম ঝলক তাকে দেখলে মনে হয়, বড় শান্ত স্থির সুন্দর। গুয়াহাটির সেই রূপ যে কত বড় প্রহেলিকা, তা বোঝা যায় ক্রমে, ধীরে, বাসিন্দাদের খবর নিতে শুরু করলে।
বহু বাঙালি এই শহরে। কিন্তু শিলচরের বাঙালি চরিত্রটি মোটেই এখানে নেই। অসম যে বিবিধ বৈচিত্র্যের সম্ভার, রাজধানীতেই তার হদিশ। কটন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে এক দল প্রতিবাদী ছাত্রছাত্রী রাস্তায় বসে ছিলেন, দাবি না মানলে নাকি ভোট বয়কট! পুরনো বিলিতি প্যাটার্নের বিশ্ববিদ্যালয় কফিহাউসেও ছড়িয়ে বসে ছাত্ররা। এদের কথাবার্তা শুনতে শুনতে মনে হল, এই তো বাঙালি-অসমিয়া-নেপালি-বিহারি-হিন্দু-মুসলিম, সকলে কেমন একত্র।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা অবশ্য সতর্ক করে দিলেন, কথা শুনে কে অসমিয়া কে বাঙালি, তা যেন বোঝার চেষ্টা না করি। তাঁদের মতো অনেকেই চোস্ত্ অসমিয়ায় কথা বলেন। যে দুই বাঙালি অধ্যাপক ও প্রকাশকের সঙ্গে সফরের গোড়াতেই আলাপ, দুই জনেই বই লিখেছেন অসমিয়া ভাষায়!
বাঙালি মুসলিমরা নাকি আরও দ্রুত মিশে যান অসমিয়া সমাজে, জানালেন প্রকাশক-বন্ধু। আবার উঠে এল ‘ন-অসমিয়া’দের কথা, অর্থাৎ যে বাঙালি মুসলিমরা নিজেদের ‘নতুন অসমিয়া’ বলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অসমিয়া ভাষা-সাহিত্য বিভাগে প্রতি বছরই অনেক মুসলিম ছাত্র। প্রকাশক বললেন, এনআরসি-র পরও লেখা হয়েছে চমৎকার সব ‘মিঞা কবিতা’, যেগুলির মূল ভাবটি হল: এত দিন ধরে আমি তোমায় গ্রহণ করেছি, তবুও তুমি আমায় গ্রহণ করলে না!
কী সুন্দর মেলামেশার ছবি। ভাল লাগছিল শুনতে। ভাল লাগল যখন শুনলাম, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্ববিদ্যালয়’ তৈরির কাজ শুরু হচ্ছে হোজাই অঞ্চলে।
কিন্তু ভাল লাগা নামক অনুভূতিটা আজকালকার দিনে দীর্ঘস্থায়ী হয় না। তাই কথাবার্তা এগোয় আর ভাবি, বাঙালি হিন্দুদের প্রতি অসমিয়াদের যে এত ক্ষোভ, সেটা নিরাপত্তার অভাবজনিত নয় কি? বাঙালি হিন্দু এলিট সাধারণত নিজের গৌরবে মাতোয়ারা। এক বাঙালি লেখক একটা জরুরি কথা বললেন। বাঙালি হিন্দু মানেই দুর্গাপুজো, রবীন্দ্র জন্মোৎসব, নেতাজি উৎসব, অর্থাৎ হিন্দু বাঙালির সাংস্কৃতিক ‘উপস্থিতি’ বড্ড বেশি। এই কারণে ক্ষোভ জমতেই পারে অন্যদের মনে, দুর্ভাগ্যজনক হলেও সেটা অস্বাভাবিক নয়।
বামপন্থী বুদ্ধিজীবী ও সাহিত্যিক হীরেন গোঁহাই-এর সঙ্গে দেখা করব, স্থির করেই রেখেছিলাম। গিয়ে জানতে পারলাম, এক কাল ‘বাঙালি খেদাও’-এর সময়ে বাঙালিদের পাশে দাঁড়িয়ে ‘দুর্নাম’ কুড়োলেও এখন তিনি এক বিতর্কিত চরিত্র। নাকি একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে গিয়েছেন তিনি। সম্প্রতি ‘আসু’-র সভায় তাঁকে বলতে শোনা গিয়েছে বাঙালিদের কিছুতেই নাগরিকতা না দেওয়ার দাবি, প্রয়োজনে অসমকে আলাদা করার দাবি। ‘আলাদা’ মানে ‘দেশদ্রোহিতা’— এই সমীকরণের অঙ্ক কষে ফেলে বিজেপি সরকার তাঁর বিরুদ্ধে ‘সিডিশন’-এর অভিযোগ এনেছে। জানি না, ঠিক কী তিনি বলেছিলেন। কিন্তু অসমের বাঙালি নিয়ে তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনায় কোনও অকারণ বাঙালি-বিরোধিতা খুঁজে পেলাম না। আসলে এনআরসি এবং নাগরিকত্ব বিল একটা পুরনো সঙ্কটকে হঠাৎ লাট্টুপাক দিয়ে অনেকের অবস্থানেই পরিবর্তন এনে ফেলেছে। গুলিয়ে বিষাক্ত হয়ে উঠেছে অসমের জটিল পরিস্থিতি।
শুনলাম, বাঙালি-অধ্যুষিত বরাক উপত্যকাকে অনেকে বলেন ‘অসমের শরীরের ক্যানসার।’ আর, ভাষাসংস্কৃতি-ভিত্তিক সেই অসমিয়া ক্ষোভের সামনে চলতে থাকে নানা ধরনের রাজনীতি। অসম গণ পরিষদের রাজনীতি দাঁড়িয়ে থাকে বাঙালিবিরোধিতার উপর। বাঙালি বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনীতি বলে অসম থেকে বরাক উপত্যকাকে আলাদা করার কথা। আর হিন্দুত্বের রাজনীতি বলে, বাঙালি-অসমিয়া হিন্দুদের একত্র করে মুসলিম বাঙালি (তাঁদের মতে, মুসলিম মানেই অনুপ্রবেশকারী, আর হিন্দুরা, শরণার্থী) ঠেকানোর কথা। আরও একটা রাজনীতি টিমটিম করেও টিঁকে থাকে, বলতে থাকে মিশ্র সমাজের কথা।
এই নানাকৌণিক জটিলতার মধ্যে একটা টানাপড়েন চলে বরাকের বাঙালির সঙ্গে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালির সম্পর্কে। প্রচলিত প্রবাদ— বরাক উপত্যকায় আওয়াজ উঠলে ব্রহ্মপুত্রের বাঙালি স্বস্তি পায়। কিন্তু সেটাই কি সব? ‘আওয়াজ’-এর সমস্যাও কি নেই? কিছু দিন আগেই ঘটেছে এক দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। অসম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য, অধ্যাপক তপোধীর ভট্টাচার্যের একটি লেখা নিয়ে সম্প্রতি এফআইআর হয়েছে: তাতে নাকি তিনি অসমিয়া-বাঙালি বিরোধ উসকে দিয়েছেন। তপোধীরবাবুর সঙ্গে কথা বলে, তাঁর লেখা পড়ে বলতে পারি, উসকানির অভিযোগটা বাড়াবাড়ি। তবু, কেন যে বরাক থেকে এই ধরনের ‘আওয়াজ’ ভেসে এলে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় বাঙালিরা বিপন্ন বোধ করেন, অনুমান করতে অসুবিধে হয় না। ঠিক একই কারণে, এনআরসি প্রশ্নে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সদলবলে শিলচরে হাজির হলেও অসমের বাঙালি একদম প্রসন্ন হন না। বাইরে থেকে হঠাৎ কুলোর হাওয়া দিলে আগুন যেমন বাড়ে, ঠিক তেমনি ভাবে দুই সমাজের বিরোধ ও পারস্পরিক ক্ষোভ এতে নতুন করে জ্বলে ওঠে। রাজনীতির ভিন্নতা সত্ত্বেও এই বিষয়ে একমত দেখলাম শিলচর আর গুয়াহাটির প্রায় সব বাঙালিকেই।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
স্বাভাবিক। বিরোধ যতই থাকুক, রাজনীতি যতই বাধা দিক, পাশাপাশি থাকা মানুষ তো নিজেদের মধ্যে বিরোধ মিটিয়ে নিতেই চায়। গুয়াহাটির প্রকাশক-বন্ধুকে ধন্যবাদ, অসমের বাঙালি শক্তিপদ ব্রহ্মচারীর লেখা বড় সুন্দর একটি কবিতা শোনালেন তিনি: ‘যে কেড়েছে বাস্তুভিটে/ সে-ই কেড়েছে ভয়—/ আকাশ জুড়ে লেখা আমার আত্মপরিচয়।/ হিংসাজয়ী যুদ্ধে যাব/ আর হবে না ভুল,/ মেখলা-পরা বোন দিয়েছে/ একখানা তাম্বুল।’
তাই তো। বাস্তুভিটে কাড়ার গল্পটাই আমাদের কানে পৌঁছে দেয় রাজনীতি। আর, পান দেওয়া-নেওয়ার মধ্য দিয়ে তৈরি হয় আত্মীয়তার যে ছোট ছোট ভুবন, রাজনীতির দাপটের তলায় তারা ঢাকা পড়ে যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy