Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

মমতাকে এড়িয়ে কোনও ঘোষণা হবে না ঢাকায়

কূটনৈতিক সূত্রে আগেই ইঙ্গিত মিলেছিল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আসন্ন ঢাকা সফরে তিস্তা চুক্তি নিয়ে যে কোনও আনুষ্ঠানিক আলোচনা হবে না, সে কথা এ দিন স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। শুধু তাই নয়, এ ধরনের অমীমাংসিত বিষয়ে আগামী দিনেও রাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনা না করে ভারত সরকার যে একতরফা কোনও সিদ্ধান্ত নেবে না, এ কথাও তিনি জানিয়ে দিলেন। তবে জলচুক্তির বিষয়ে ঘরোয়া আলোচনা হতে পারে বলে কূটনৈতিক সূত্রের খবর। তাতে অবশ্য মমতার আপত্তি নেই। বস্তুত তিনিই বাংলাদেশ সফরের সময়ে এই আলোচনার প্রক্রিয়াটি শুরু করেছিলেন।

সাংবাদিক বৈঠকে সুষমা স্বরাজ। দিল্লিতে রবিবার। ছবি: এএফপি।

সাংবাদিক বৈঠকে সুষমা স্বরাজ। দিল্লিতে রবিবার। ছবি: এএফপি।

জয়ন্ত ঘোষাল
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০১ জুন ২০১৫ ০৪:০৫
Share: Save:

কূটনৈতিক সূত্রে আগেই ইঙ্গিত মিলেছিল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আসন্ন ঢাকা সফরে তিস্তা চুক্তি নিয়ে যে কোনও আনুষ্ঠানিক আলোচনা হবে না, সে কথা এ দিন স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। শুধু তাই নয়, এ ধরনের অমীমাংসিত বিষয়ে আগামী দিনেও রাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনা না করে ভারত সরকার যে একতরফা কোনও সিদ্ধান্ত নেবে না, এ কথাও তিনি জানিয়ে দিলেন।

তবে জলচুক্তির বিষয়ে ঘরোয়া আলোচনা হতে পারে বলে কূটনৈতিক সূত্রের খবর। তাতে অবশ্য মমতার আপত্তি নেই। বস্তুত তিনিই বাংলাদেশ সফরের সময়ে এই আলোচনার প্রক্রিয়াটি শুরু করেছিলেন।

প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা যাওয়ার এক সপ্তাহ আগেই আজ যে ভাবে এ বিষয়ে সমস্ত জল্পনা অবসান ঘটানো হল— সেটি যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। সুষমা আজ এ কথাও জানিয়েছেন, তিনি নিশ্চিত বাংলাদেশ সফরে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর পাশেই থাকবেন। স্থলসীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষরের সময়ও তিনি হাজির থাকবেন।

প্রশ্ন হল, ঢাকায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সঙ্গে পেতে কী ভাবে সফল হলেন মোদী? ইউপিএ জমানায় মনমোহন সিংহ যে কাজে ব্যর্থ হয়েছিলেন?

বিদেশ মন্ত্রকের সূত্র বলছে, মনমোহন সিংহ যখন প্রধানমন্ত্রী এবং প্রণব মুখোপাধ্যায় তাঁর প্রধান সেনাপতি ছিলেন, তখন মমতার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ছাড়াই কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় তিস্তা চুক্তিটি অনুমোদন করিয়ে নেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। তাতে পরিস্থিতি আরও বিগড়ে যায়। মমতার দলের দীনেশ ত্রিবেদী তখন রেলমন্ত্রী। ইউপিএ সরকার ভেবেছিল, মমতা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। ফলে রাজ্য সরকারকে জানানোর প্রয়োজন নেই। দীনেশের উপস্থিতিতেই কেন্দ্র এটা পাশ করিয়ে নেবে।

কিন্তু বৈঠকের আগেই দীনেশ ফ্যাক্স করে মমতাকে মন্ত্রিসভার তিস্তা চুক্তির খসড়াটি পাঠিয়ে দেন। সে প্রস্তাবটি পড়েই মমতা নির্দেশ দেন— তৃণমূল এই চুক্তির বিরোধিতা করবে। ফলে মন্ত্রিসভায় এটি পাশ করানো চলবে না। এমনকী এই চুক্তি জোর করে পাশ করাতে গেলে সরকার থেকে তৃণমূল সমর্থন প্রত্যাহার করবে, এ কথাও জানিয়ে দেন। ফলে মনমোহনকে পিছিয়ে আসতে হয়। দিল্লি এবং ঢাকা— দু’পক্ষই মমতার উপর রুষ্ট হয়। কিন্তু মমতাও জানিয়ে দেন, ‘‘আমি মুখ্যমন্ত্রী। পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ দেখাই আমার কাজ।’’

এর পর মনমোহন তৎকালীন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেননকে পাঠান তিস্তা চুক্তি নিয়ে মমতার সমর্থন আদায়ের জন্য। তাতে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়। এর পর প্রধানমন্ত্রীর প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি টি কে এ নায়ারকে কলকাতায় পাঠানো হয়। নায়ারের সঙ্গে মমতার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ভাল ছিল। কিন্তু তিনিও বরফ গলাতে তিনি পারেননি। বিদেশসচিব রঞ্জন মাথাইও মমতার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। কিন্তু ফল হয়নি।

আবার কূটনৈতিক সূত্রের খবর, বাংলাদেশের তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী দীপু মণি কলকাতায় মমতাকে তিস্তা চুক্তির প্রয়োজন বোঝাতে গিয়ে বাগ্‌বিতণ্ডা করে বসেন। পরিস্থিতি জটিল হয়ে পড়ে। সূত্রের খবর, বৈঠকে মমতার অনড় অবস্থান দেখে দীপু মণি রেগে গিয়ে বলেছিলেন, ‘‘তিস্তার পানি শুধু আপনাদেরই পানি নয়, আমাদেরও পানি। দরকার হলে আন্তর্জাতিক ট্রাইবুন্যালে যাব!’’ বাংলাদেশের কূটনৈতিক সূত্রের খবর, দীপুর এই আচরণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও অসন্তুষ্ট হন। পরের দফায় মন্ত্রিসভায় আর রাখাই হয়নি দীপু মণিকে।

রাজনৈতিক পর্যায়ে ঘরোয়া ভাবে মমতার সঙ্গে বোঝাপড়া করায় যে আখেরে লাভ হতে পারে, সেটি নরেন্দ্র মোদী প্রথম থেকেই বুঝে যান। যেমন ইউপিএ জমানায় তিস্তা না-হলেও জমি বিল নিয়ে তৎকালীন গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী জয়রাম রমেশ যে মমতার সমর্থন আদায় করে নিয়েছিলেন, সেটিও একেবারেই ব্যক্তিগত উদ্যোগে। তিনি মমতার সঙ্গে দেখা করতে কলকাতায় চলে যান। মমতা ব্যস্ত থাকায় একটি টিভি চ্যানেলের দফতরে গিয়ে তিনি তাঁর সঙ্গে দেখা করেন।

নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর পাকিস্তান ছাড়া কার্যত সব ক’টি প্রতিবেশী দেশই সফর করেছেন। কিন্তু এত দিন বাংলাদেশে যাননি। কূটনৈতিক সূত্রে খবর, নরেন্দ্র মোদী বাংলাদেশে যাওয়ার প্রস্তুতির কাজে অনেকটা সময় দিয়েছেন নিঃশব্দে ও গোপনে। জানুয়ারি মাসে সার্ক সম্মেলন হওয়ার কথা পাকিস্তানে। সেখানে নরেন্দ্র মোদীর যাওয়ার
কথা। তার আগে তিনি বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করে সীমান্ত নিয়ে মনোমালিন্য কাটিয়ে ফেলতে চান। কিন্তু এ ব্যাপারেও তিনি এগিয়েছেন ধীরে ধীরে ও ধাপে ধাপে। প্রধানমন্ত্রী সচিবালয়ের এক কর্তা বলেন, নরেন্দ্র মোদীর একটি নিজস্ব ক্যালেন্ডার আছে, যা মেনেই তিনি এগোচ্ছেন।

রাষ্ট্রপতি ভবনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের সম্মানে ডাকা নৈশভোজে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ও মমতাকে বোঝাতে উদ্যোগী হন। এই নৈশভোজেই মমতার সঙ্গে মোদীর প্রথম মুখোমুখি সাক্ষাৎ হয়। মমতাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির একেবারে সামনে বসার ব্যবস্থা করা হয়। মমতার পাশে ছিলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির পুত্র। উল্টো দিকে বসেছিলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি তাঁকে ঢাকায় আসতে অনুরোধ করেন। এর পর মমতা ঢাকা সফরেও যান। শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর কথা হয়। স্থালসীমান্ত চুক্তিতে তিনি কেন্দ্রকে সমর্থন করেন। ওই নৈশভোজে কিন্তু মমতা ছাড়া তরুণ গগৈ বা মানিক সরকারের মতো অন্য কোনও মুখ্যমন্ত্রীকে ডাকা হয়নি।

মনমোহনের সফর থেকে শিক্ষা নিয়ে রাজ্য সরকারের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি এড়াতে মোদীও আগাগোড়া সতর্ক পদক্ষেপ করেন। তাঁর সচিবালয় ও মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয়ের মধ্যে সরাসরি হটলাইন যোগাযোগ তৈরি করেন। প্রধানমন্ত্রী সচিবালয়ের অতিরিক্ত সচিব পশ্চিমবঙ্গ ক্যাডারের অফিসার ভাস্কর খুলবে এই যোগসূত্র রক্ষার জন্যই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ঢাকা যাচ্ছেন। মমতার একান্ত সচিব গৌতম স্যান্যালের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখছেন তিনি। আবার বিদেশসচিব জয়শঙ্কর নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন রাজ্যের মুখ্যসচিবের সঙ্গে। বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ নিজে মমতাকে ফোন করে জানিয়েছেন, কী কী কর্মসূচি ঢাকায় নেওয়া হচ্ছে। এমনকী যে যৌথ বিবৃতি নেওয়া হবে, তা-ও মমতাকে আগাম জানিয়েই করা হচ্ছে।

তবে ভারতের কাছে বাংলাদেশের ভৌগোলিক-রাজনৈতিক গুরুত্ব যে অসীম, এ ব্যাপারে মোদী ও মমতা একমত। স্থলসীমান্ত চুক্তি কার্যকর হলে সেটি যে অনুপ্রবেশ দমনেও সাহায্য করবে, সে ব্যাপারেও কেন্দ্র ও রাজ্য সহমাত। কলকাতায় এসে তৎকালীন মার্কিন বিদেশসচিব হিলারি ক্লিন্টন পর্যন্ত মমতাকে বলেছিলেন— দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে বাংলাদেশকে পাশে রাখা বিশেষ প্রয়োজন। বিশেষত সন্ত্রাস দমন ও ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে বাংলাদেশের শেখ হাসিনা সরকারের সদর্থক ভূমিকার কথা মমতা নিজেও স্বীকার করেন।

স্থলসীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষরের সময় মমতা মোদীর পাশে থাকায় বাংলাদেশ আরও আশাবাদী। বাংলাদেশ মনে করছে, মমতা যখন আসতে পারছেন, তখন তিস্তা চুক্তি নিয়ে জট কাটাতেও প্রধানমন্ত্রী মমতাকে পাশে পাবেন। যে কাজটি মনমোহন সিংহ করে উঠতে পারেননি।

ঢাকা পড়েননি মোদীর ছায়ায়, দাবি সুষমার

সংবাদ সংস্থা • নয়াদিল্লি

এক জন ‘অতি সক্রিয়’ প্রধানমন্ত্রী কখনওই চ্যালেঞ্জ নন, বরং তাতে কাজের সুবিধেই হয় বলে রবিবার সাংবাদিক বৈঠকে দাবি করলেন বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। ইউপিএ সরকারের আমলে বিরোধী নেত্রী হিসেবে তাঁর ভূমিকা ছিল চোখে পড়ার মতো। কিন্তু বিদেশমন্ত্রী হওয়ার পরে সেই মহিমায় দেখা যাচ্ছে না তাঁকে। বরং বারবার বিদেশ সফরে গিয়ে প্রচারের আলো টেনে নিচ্ছেন নরেন্দ্র মোদী। এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে সুষমা বলেন, ‘‘আমরা একটা টিম। প্রতিযোগিতা থাকে বিরোধীদের সঙ্গে, নিজেদের মধ্যে নয়। আর আমার ‘লো প্রোফাইল’ প্রসঙ্গে বলি, প্রধানমন্ত্রী আমার উপরে নিষেধাজ্ঞা চাপাননি। আমার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে এটাই খাপ খায়।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE