গুজরাতের লিমখেড়ায় নরেন্দ্র মোদী। ছবি: পিটিআই।
উৎকণ্ঠা এমন, যেন পরীক্ষার ফল বেরোবে।
দুপুর তখন তিনটে। উৎকণ্ঠা হঠাৎই দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল দিল্লির শাসক শিবিরে। টুইটের পর্দায় ঠিকরে থাকা গুচ্ছ গুচ্ছ চোখ। এই বুঝি এল, এই বুঝি এল!
আসবেটা কী?
কোন সকালে টুইট করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। এক বার ১২টা নাগাদ প্রধানমন্ত্রী কয়েক জনকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। ফের তিনটের কিছুটা আগে আর এক প্রস্ত জবাব দিতে শুরু করেছেন। এই খবর ছড়িয়ে পড়তেই টুইট খুলে বসে গিয়েছেন বিজেপি নেতা, মন্ত্রীর সহায়কেরা। কে কোন উত্তর পেলেন, তারও চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। রিও-তে বিবাদ পাকিয়ে ফেরা ক্রীড়ামন্ত্রী বিজয় গোয়েলের নাম নিয়ে ধন্যবাদ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। নির্মলা সীতারামণের নাম নেননি। স্মৃতি ইরানিকে ‘অনেক’ ধন্যবাদ জানিয়েছেন। আবার হর্ষবর্ধনকে ‘কৃতজ্ঞতা’।
সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত জন্মদিনের শুভেচ্ছার জন্য মাত্র জনা চল্লিশকেই টুইট করে ধন্যবাদ জানিয়েছেন মোদী। তার মধ্যে রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি যেমন আছেন, তেমনই বিরোধী শিবিরের বড় নেতা রাহুল গাঁধীকেও ‘অসংখ্য ধন্যবাদ’ জানিয়েছেন তাঁর শুভেচ্ছার জন্য। ফোন করে লালকৃষ্ণ আডবাণীর ‘আশীর্বাদ’-এর কথা লিখতেও ভোলেননি প্রধানমন্ত্রী। আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসরফ গনি, অমিতাভ বচ্চন, সচিন তেন্ডুলকর, লতা মুঙ্গেশকর, রামদেব, সাইরাস মিস্ত্রি, সানিয়া মির্জা, শশী তারুর, অ্যাপেলের কর্ণধার টিম কুকের শুভেচ্ছারও জবাব দিয়েছেন। কিন্তু দিনের শেষে যাঁরা জবাব পেলেন না, হতাশই থেকে গেলেন।
অথচ দলের নির্দেশে আজ মোদীর জন্মদিনকে ‘সেবা দিবস’ হিসেবে পালন করতে দেশজুড়েই আসরে নেমে পড়েছিল গোটা গেরুয়া শিবির। দিল্লিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ ‘মোদীর জন্য দৌড়’-এর সূচনা করেন। অসুস্থ শরীর নিয়ে বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজও দিল্লির এক বস্তিতে যান। অমিত শাহ ঝাড়ু হাতে তেলঙ্গানায়, ছত্তীসগঢ়ের মুখ্যমন্ত্রী রমন সিংহ দিল্লিতে এসে রক্তদান শিবিরে, বেঙ্কাইয়া নায়ডু অন্ধ্রে কুষ্ঠ রোগীদের সঙ্গে, অনন্ত কুমার বেঙ্গালুরুতে কোদাল হাতে জঞ্জাল সরাতে— প্রচারের আলোয় আসার কোনও সুযোগই হাতছাড়া করতে চাননি নেতারা। সর্বত্রই মোদী-ভজনা!
আরও পড়ুন: এ বার দুর্গা মা নতুন রূপে আনন্দ উৎসবে
জন্মদিনে মায়ের সঙ্গে দেখা করলেন মোদী, টুইট করলেন ছবি
আর খোদ মোদী?
২০১৪ সালে যে মোদী সাফ বারণ করে দিয়েছিলেন, তাঁর জন্মদিনে কোনও আড়ম্বর নয়, ঢাকঢোল নয়, সরকারের আড়াই বছরের মাথায় সেই মোদীই এ বারে তাঁর ‘গরিব-দরদি’ ভাবমূর্তিতে শান দিতে সকলকে আসরে নামিয়ে নিজেও নেমেছেন। প্রতিবন্ধীদের হুইলচেয়ার, সামগ্রী দিয়ে, একসঙ্গে হাজারো বাতি জ্বালিয়ে তিনি বিশ্ব রেকর্ড গড়ার প্রস্তুতি তো আগেই নিয়েছিলেন। গত বছর বাদ পড়ে যাওয়ার পর এ বারে আজ সকালটি গুজরাতে তিনি শুরু করেছেন মায়ের পা ছুঁয়ে আশীর্বাদ নিয়ে। তাঁর সঙ্গে পনেরো মিনিট ক্যামেরার সামনে ‘একান্তে’ কাটিয়ে। গুজরাত সফরে থাকা সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি টি এস ঠাকুরও পৌঁছে যান প্রধানমন্ত্রীকে শুভেচ্ছা জানাতে।
আর তারপর দিনভর নিজের জন্মদিনটি তিনি কাটালেন গুজরাতের আদিবাসী এলাকায়। একের পর এক সভায় নিজের ‘সাফল্য’-এর গাঁথা শুনিয়ে। আগাগোড়াই তিনি বক্তব্য পেশ করেছেন গুজরাতি ভাষায়। লোকসভা নির্বাচনের প্রচারের সময় গুজরাতেও তাঁর বক্তব্য হত হিন্দিতে। কারণ, তাঁর লক্ষ্য ছিল গোটা দেশ, বিশ্ব। কিন্তু এখন গুজরাতিতে ভাষণ দিয়ে তিনি যে এখন নিজের রাজ্যের নির্বাচনী বৈতরণী পার করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন, তা নিয়ে সংশয় নেই কোনও মহলে। নিজের জন্মদিনের আবেগকে তাই সুকৌশলে মাখিয়ে দিতে চেয়েছেন ভোট-রাজনীতির সঙ্গে।
তবে বিজেপি নেতারাই কবুল করছেন, যে ভাবে গোটা দেশে সব নেতা-কর্মীকে আজ তাঁর জন্মদিন ঘিরে ‘সেবা দিবস’ পালন করতে বলা হয়েছে, তাতে স্পষ্ট, নরেন্দ্র মোদী নতুন করে নিজের ব্র্যান্ডকে ঘষেমেজে নিতে চাইছেন। গত আড়াই বছরে যেটি ফিকে হতে শুরু করেছে। মোদী-জাদু উধাও হতে শুরু করেছে। বিরোধীরা প্রশ্ন তুলছে ‘অচ্ছে দিন’ নিয়ে। খোদ মোদীর সতীর্থও খোলসা করেছেন, মানুষের অতৃপ্ত প্রত্যাশার কারণে ‘অচ্ছে দিন’ কোনও দিনও আসতে পারে না বলে ঘরোয়া মহলে কবুল করেছেন খোদ প্রধানমন্ত্রীই। কিন্তু সামনে উত্তরপ্রদেশের ভোট, আর তার পর দু’বছরের মাথায় ফের লোকসভা নির্বাচনের আগে মোদীর ‘গরিব-দরদি’ ভাবমূর্তি চমকাতেই এ বারে গা ঝাড়া দিয়ে উঠতে চাইছেন। আর আজ ৬৬তম জন্মদিনটি ছিল তাঁর আদর্শ মঞ্চ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy