উৎসব: সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদের মধ্যেই বড়দিন পালন। বুধবার নয়াদিল্লিতে। ছবি: রয়টার্স
দিনটা ‘বড়’। প্রতিবাদের পৃথিবীর সীমানাটাও আজ কি তাই একটু বড় হয়ে গেল জামিয়া মিলিয়ায়?
দশ নম্বর গেটের সামনে এল কেক, ক্রিসমাস ট্রি। সোনালি-রুপোলি ঘণ্টা ঝুলল, বেলুন উড়ল, ‘শুভ বড়দিন’ ব্যানার সাজল রং-বেরঙের সাজে। ব্যানার ঘিরে যে ছাত্রীরা বসলেন, তাঁদের অধিকাংশেরই মাথায় হিজাব।
অস্থির সময়ে ‘রাজার দোহাই দিয়ে’ ঘাতক বাহিনীর মারকে চ্যালেঞ্জ ছুড়েই যেন এর ঠিক পাশে তরতরিয়ে উড়ল ভারতের জাতীয় পতাকা। লাল জোব্বা, সাদা দাড়িগোঁফের সান্তা ক্লজেরা চকলেট বিলোতে বিলোতে হাতে-হাতে তুলে দিল একটা কাগজ। যাতে লেখা লাইনগুলো শুরু হচ্ছে এই ভাবে— ‘‘আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সংকল্প করছি...।’’ সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন নিয়ে বিক্ষোভ, জামিয়া ও আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস-সহ গোটা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পুলিশি তাণ্ডবের অভিযোগের আবহে ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনাই আজ সান্তার উপহার।
নয়াদিল্লিতে জামিয়ার গেটে বড়দিন উদ্যাপনে তাই মিলে গেলেন ভারতীয় সংবিধানের প্রাণপুরুষ বাবাসাহেব অম্বেডকর। মিলে গেলেন মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীও। স্নাতকোত্তরের ছাত্র সাহিল আহমেদ বললেন, ‘‘দশ নম্বর গেটের কাছেই গাঁধীজির ‘হিন্দ স্বরাজ’ বই থেকে পাঠ করলাম আমরা। এ দিকেই তো লাইব্রেরি। ১৫ ডিসেম্বর সেখানেই ঢুকে পড়ুয়াদের উপরে চড়াও হয়েছিল পুলিশ। কাজেই জায়গাটা প্রতীকী।’’ শান্তি ও বিরোধ-মীমাংসা— এই বিষয় নিয়ে স্নাতকোত্তর পড়া সাহিল জানিয়ে গেলেন, ওই প্রতীকী জায়গাটিতেই বড়দিনের কেক কেটেছেন তাঁরা। এসেছিলেন হাজারখানেক মানুষ।
‘জামিয়া কোঅর্ডিনেশন কমিটি’-র উদ্যোগে বিক্ষোভের শুরু থেকেই পোস্টারে-স্লোগানে অভিনবত্ব দেখিয়েছে জামিয়া। আজও ছিল সেই ছোঁয়া। তবে বড়দিন বলেই প্রতিবাদের ত্রয়োদশ দিনটার মেজাজ একটু আলাদা। সান্তা সেজে অনেকে ঘুরলেও ‘নো সিএএ, নো এনআরসি’ স্লোগানের পাশেই পোস্টার দেখা গেল— ‘এই বছর সান্তা আসছে না। কারণ তার কাছে কাগজপত্র নেই।’ চারুকলা বিভাগের ছাত্রছাত্রীরাই আজ বড়দিনের সাজের দায়িত্বে ছিলেন। তাঁদেরই এক জন, কুলসুম ফতিমা তাঁর প্রতিবাদী সহপাঠীদের অস্ত্র জুগিয়ে চলেছেন তুলি-রঙে। বললেন, ‘‘আজকের দৃশ্যগুলো যে কোনও প্রতিবাদের ছবি হতে পারে। আর জামিয়ায় তো আমরা দিওয়ালি থেকে হোলি, সব উৎসবই সমান উৎসাহে পালন করি। রঙ্গোলিও সাজাই।’’
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী মহম্মদ খালিদ হাসান বলছিলেন, ‘‘প্রতিবাদের কেন্দ্র হিসেবে জামিয়া তার নিজস্বতা ধরে রাখছে। আমরা শান্তির বার্তা দিচ্ছি। সরকার চায় হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিভেদ তৈরি করতে। আমাদের লড়াই দেশের ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তি ধরে রাখার। তাই সব ধর্মের মানুষ আমাদের পাশে আসছেন। সংবিধান রক্ষায় আমরা একজোট।’’ একই কথা বলছে জামিয়ার পড়ুয়াদের বিবৃতি— ‘‘ঈশ্বরকে পাওয়ার পথগুলো আপাত ভাবে আলাদা হলেও আসলে এক। বড়দিন হল সত্যিকারের ভালবাসার দিন। সেই মানুষটির জন্মদিন, যিনি শিখিয়েছিলেন, ঈশ্বরই হলেন ভালবাসা। এই একটি বার্তা দেবেন বলেই তিনি বাঁচলেন। বরণ করলেন মৃত্যুকেও।’’
‘‘কহো কানে কানে, শুনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গলবারতা।’’ মিলে গেলেন রবীন্দ্রনাথও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy