Advertisement
১০ মে ২০২৪
Science News

২৯ দিনের পথ পেরিয়ে চাঁদের কক্ষপথে ঢুকে পড়ল চন্দ্রযান-২

তবে যে ভয়ঙ্কর গতিবেগে ছুটে চলেছে চন্দ্রযান-২ (ঘণ্টায় ৩ হাজার ৬০০ কিলোমিটার গতিবেগে) তাতে তার গতি কমিয়ে নিরাপদে তাকে চাঁদের কক্ষপথে ঢোকানোটাই ছিল ইসরোর বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদদের কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ অগস্ট ২০১৯ ১৭:৩৩
Share: Save:

মঙ্গলে ঊষাই বলা যায়! চাঁদের কক্ষপথে পা ছোঁয়াল ‘চন্দ্রযান-২’। মঙ্গলবার সকাল ৯টা ২৮ মিনিটে। চাঁদের কক্ষপথে চন্দ্রযান-২-কে ঢোকাতে সময় লেগেছে ১৭৩৮ সেকেন্ড বা ২৮ মিনিট ৯৬ সেকেন্ড।

গত ১৪ অগস্ট পৃথিবীর কক্ষপথকে শেষ বারের মতো ‘গুড বাই’ জানিয়েছিল চন্দ্রযান-২। তার পর সাত দিন ধরে সোজা পথ পেরিয়ে চন্দ্রযান-২ চাঁদের কক্ষপথে ঢুকে পড়ল আজ। ইসরো সূত্রে এই খবর জানানো হয়েছে।

এখনও উদ্বেগে, উৎকণ্ঠায় ইসরো!

তবে যে ভয়ঙ্কর গতিবেগে ছুটে চলেছে চন্দ্রযান-২ (ঘণ্টায় ৩ হাজার ৬০০ কিলোমিটার গতিবেগে) তাতে তার গতি কমিয়ে নিরাপদে তাকে চাঁদের কক্ষপথে ঢোকানোটাই ছিল ইসরোর বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদদের কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। উৎক্ষেপণের পর থেকেই যে গতিবেগ ধীরে ধীরে কমিয়েছে ইসরো। কারণ, উৎক্ষেপণের সময় ‘জিএসএলভি-মার্ক-৩’ রকেটের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৩৯ হাজার ২৪০ কিলোমিটার।

কক্ষপথে ঢোকার আগে চন্দ্রযান-২-এর গতিবেগ না কমালে যেমন তা চাঁদের পাশ কাটিয়ে সৌরমণ্ডলের সুদূরতম প্রান্তে চলে যেতে পারত, তেমনই চাঁদের পাঁচটি কক্ষপথে প্রদক্ষিণের সময় চন্দ্রযান-২-এর গতিবেগ ধীরে ধীরে কমিয়ে না আনলে তা এখনও আছঢ়ে পড়তে পারে চাঁদের বুকে। ফলে, আগামী ৭ সেপ্টেম্বর চাঁদের বুকে ল্যান্ডার ‘বিক্রম’-এর পা ছোঁয়ানো পর্যন্ত যথেষ্টই উদ্বেগে থাকতে হবে ইসরোর বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদদের।

ভারতের দ্বিতীয় চন্দ্রাভিযান সম্পর্কে এই তথ্যগুলি জানেন কি?

বেঙ্গালুরুতে ইসরোর চন্দ্রযান-২-এর মিশন কন্ট্রোল রুমে তাই এখন রীতিমতো দাঁতে দাঁত চেপে উৎকণ্ঠায় দিন-রাতের ২৪ ঘণ্টার প্রত্যেকটি সেকেন্ড কাটাচ্ছেন প্রযুক্তিবিদ ও বিজ্ঞানীরা। বলা ভাল, উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছেন মিশন কন্ট্রোল রুমের সদস্যরা।

আরও পড়ুন- ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিরহস্যের জট খুলতে আরও রোমাঞ্চকর অভিযানের পথে ইসরো

আরও পড়ুন- চাঁদে এখন না নামলে পরে খুবই পস্তাতে হত ভারতকে!​

কেন ২০ অগস্ট পর্যন্ত ইসরোর আশঙ্কা ছিল এতটা জোরালো?

বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদদের একটি বড় অংশেরই বক্তব্য, চাঁদের কক্ষপথে যত ক্ষণ না ঢুকে পড়তে পারছে চন্দ্রযান-২, তত ক্ষণ বা তত দিন ‘কী হয় কী হয়’ আশঙ্কাটা থেকেই যাবে ইসরোর। তার থেকে রেহাই পাওয়ার কোনও উপায় নেই। সেটা চলবে ২০ অগস্ট পর্যন্ত। লুনার ট্রান্সফার অরবিটে চন্দ্রযান-২ ঢুকে পড়ার (যা হওয়ার কথা ১৪ অগস্ট) ৫/৬ দিন পরেও।

তাঁদের এও বক্তব্য, এই উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ইসরো কমাতে পারত যদি ক্ষমতা আরও বাড়াতে পারত ‘জিএসএলভি-মার্ক-৩’ রকেটের। নাসার জেট প্রোপালসান ল্যাবরেটরির এক বিজ্ঞানীর কথায়, ‘‘আমরা ১৯৬৯ সালেই যে ‘স্যাটার্ন-ফাইভ’ রকেটে চাপিয়ে পাঠিয়েছিলাম অ্যাপোলো-১১ মিশন, তা উৎক্ষেপণের পর চাঁদের বুকে নামতে সময় নিয়েছিল মাত্র চার দিন বা তার সামান্য বেশি। চিনও গত বছর চাঁদের না-দেখা পিঠে ল্যান্ডার ও রোভার পাঠিয়েছে উৎক্ষেপণের পর মাত্র পাঁচ দিনে। ইসরোর লাগছে ৪২ দিন। ইসরোর ল্যান্ডারের চাঁদে নামার কথা আগামী ৬ অক্টোবর। তাই এই উদ্বেগটা আমাদের অনেকটাই কম ছিল। কম ছিল চিনেরও।’’

যে পথে চাঁদে, দেখুন ইসরোর ভিডিয়ো

সবকিছু ঠিকঠাক চললে আগামী ২০ অগস্ট, ভারতের দ্বিতীয় চন্দ্রযান ঢুকে পড়বে ল্যাগরাঞ্জ-১ পয়েন্টে। যেখানে সেখান থেকেই ঢুকে পড়বে চাঁদের অনেক দূরের কক্ষপথে। আর সেই সময়েই চন্দ্রযান-২ পড়ে যাবে পুরোপুরি চাঁদের অভিকর্ষ বলের খপ্পরে। যখন চাঁদকে এড়িয়ে সৌরমণ্ডলের আর কোথাও যাওয়া সম্ভব নয় চন্দ্রযান-২-এর। সেইখানেই বিগড়ে বা পুরোপুরি বিকল হয়ে গেলে চাঁদের কক্ষপথেই অনন্ত কাল ধরে ঘুরতে হবে ভারতের দ্বিতীয় চন্দ্রযানকে।

কোন রুটে চাঁদে যাচ্ছে চন্দ্রযান-২?

এ ব্যাপারে ইসরোর মিশন কন্ট্রোল রুম থেকে এই প্রতিবেদক একটি নির্ধারিত সূচি পেয়েছেন। সেই সূচির গভীরে ঢোকার আগে একটু আলোচনা করে নেওয়ার প্রয়োজন, পৃথিবী থেকে রওনা হওয়ার পর ঠিক কোন ‘রুট’ ধরে, পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে কী ধরনের কক্ষপথে ঘুরছে চন্দ্রযান-২।

ইসরোর মিশন কন্ট্রোল রুম সূত্রের খবর, গত ২২ জুলাই, দুপুর ২টো ৪৩ মিনিটে অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীহরিকোটা থেকে উৎক্ষেপণের ১৬ মিনিটের মধ্যেই (দুপুর ২টো ৫৭ মিনিট নাগাদ বা তার কিছু পরে) চন্দ্রযান-২কে পিঠে চাপিয়ে ভারতের সবচেয়ে শক্তিশালী রকেট ‘জিএসএলভি-মার্ক-৩’ পৌঁছে যায় ভূপৃষ্ঠ থেকে ১৭০ কিলেমিটার উপরে। পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করতে শুরু করে একটি উপবৃত্তাকার কক্ষপথে।

আর সেই দিন থেকেই ইসরো বিজ্ঞানীদের চেষ্টা শুরু হয়ে যায় রিমোট কন্ট্রোলে ঠেলেঠুলে চন্দ্রযান-২কে আরও দূরের কোনও উপবৃত্তাকার কক্ষপথে (ইলিপটিকাল অরবিট) ঢোকানোর।

কোনও বৃত্তের থাকে একটি কেন্দ্রীয় বিন্দু। কিন্তু কোনও উপবৃত্তের থাকে দু’টি কেন্দ্রীয় বিন্দু। ফলে, পৃথিবীকে প্রদক্ষিণের সময় কোনও বৃত্তাকার কক্ষপথে থাকলে মহাকাশযান সব সময়ই আমাদের গ্রহটি থেকে থাকে একই দূরত্বে। সেই বৃত্তাকার কক্ষপথের প্রতিটি বিন্দুতেই মহাকাশযানটির উপর পৃথিবীর অভিকর্ষ বলের পরিমাণও থাকে একই রকম। অভিন্ন।

যে ভাবে চন্দ্রযান-২-কে ঢুকিয়ে দেওয়া হল চাঁদের প্রথম কক্ষপথে

২২ জুলাই থেকে চন্দ্রযান-২-এর মহাকাশ পরিক্রমা

তাই গত ২২ জুলাই উৎক্ষেপণের পর চন্দ্রযান-২ যখন পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে ছিল, তখন ভূপৃষ্ঠ থেকে তা ছিল ১৭০ কিলোমিটার দূরে। আর ওই দিন যখন পৃথিবী থেকে সবচেয়ে দূরে ছিল ভারতের দ্বিতীয় চন্দ্রযান, তখন সেটি ছিল ৪৫ হাজার ৪৭৫ কিলোমিটার দূরে। ইসরো সূত্রেই এ কথা জানা গিয়েছে।

পৃথিবীর মায়ার টান যে বার বার টেনেছে চন্দ্রযান-২কে!

কিন্তু পৃথিবীর অভিকর্ষ বলের টান যে বার বারই কাছে টেনে আনার চেষ্টা করছে চন্দ্রযান-২কে। তাকে চাঁদের কাছে যেতে দিতে চাইছে না! ফলে, বার বার ইসরোর মিশন কন্ট্রোল রুম থেকে কম্যান্ড পাঠিয়ে চন্দ্রযান-২কে ঠেলেঠুলে পাঠিয়ে দিতে হয়েছে পৃথিবী থেকে আরও দূরের উপবৃত্তাকার কক্ষপথে।

তাই ইসরো জানাচ্ছে, গত ২৪ জুলাই দুপুর ২টো থেকে বিকেল সাড়ে তিনটের মধ্যে চন্দ্রযান-২কে কম্যান্ড পাঠিয়ে ঠেলেঠুলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে যে উপবৃত্তাকার কক্ষপথে, সেখানে চন্দ্রযান-২ ছিল পৃথিবী থেকে সর্বাধিক ৪৫ হাজার ১৬২ কিলোমিটার দূরত্বে। ওই দিন আমাদের সবচেয়ে কাছে যখন এসেছিল চন্দ্রযান-২, তখন তার দূরত্ব ছিল ২৪১.৫ কিলোমিটার।

তার পর ২৬ জুলাই চন্দ্রযান-২কে ঠেলেঠুলে পাঠানো হয় (রাত ১টা থেকে ২টো) নতুন একটি উপবৃত্তাকার কক্ষপথে। যেখানে মহাকাশযানটি ছিল পৃথিবী থেকে সর্বাধিক ৫৪ হাজার ৮৪৮ কিলোমিটার দূরত্বে। সবচেয়ে কাছে থাকর সময় ছিল ২৬২.৯ কিলোমিটার দূরে।

গত ২৯ জুলাই, সোমবার চন্দ্রযান-২কে পাঠানো হয় (দুপুর ৩টে থেকে বিকেল ৪টে) আর একটি উপবৃত্তাকার কক্ষপথে। সেখানে চন্দ্রযান-২ পৃথিবী থেকে ছিল সর্বাধিক ৭১ হাজার ৩৪১ কিলোমিটার দূরে। সবচেয়ে কাছে সেই দূরত্বটা ছিল ২৮১.৬ কিলোমিটার।

গত ২ অগস্ট চন্দ্রযান-২ যায় নতুন আর একটি উপবৃত্তাকার কক্ষপথে (দুপুর ২টে থেকে দুপুর ৩টে)। সেখানে চন্দ্রযান-২ পৃথিবী থেকে ছিল সর্বাধিক ৮৯ হাজার ৭৪৩ কিলোমিটার দূরে। সবচেয়ে কাছে সেই দূরত্বটা ছিল ২৬২.১ কিলোমিটার।

আর গত ৬ অগস্ট চন্দ্রযান-২ যায় নতুন আর একটি উপবৃত্তাকার কক্ষপথে। সেখানে পৌঁছলে চন্দ্রযান-২ পৃথিবী থেকে ছিল সর্বাধিক ১ লক্ষ ৪৩ হাজার ৯৫৩ কিলোমিটার দূরে। সবচেয়ে কাছে ছিল ২৩৩.২ কিলোমিটার দূরত্বে।

আরও পড়ুন- ৩০ বছরের মধ্যেই চাঁদে বড় শিল্পাঞ্চল গড়ে ফেলবে মানুষ!​

আরও পড়ুন- চার বছরের মধ্যেই চাঁদের পাড়ায় ‘বাড়ি’ বানাচ্ছে নাসা!​

এর থেক়েই স্পষ্ট পরের উপবৃত্তাকার কক্ষপথে পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গেই পৃথিবী থেকে দূরত্ব বেড়েছে চন্দ্রযান-২-এর। আর তা তত বেশি করে এগিয়ে গিয়েছে চাঁদের দিকে।

সোজা চাঁদে যাওয়ার রাস্তায় পা পড়ে ১৪ অগস্টে

আজ রাত ৩টে থেকে ভোর ৪টের মধ্যে চন্দ্রযান-২ ঢুকে পড়ল সোজা চাঁদের যাওয়ার রাস্তায়। বিজ্ঞানের পরিভাষায় যাকে বলা হয়, ‘লুনার ট্রান্সফার অরবিট’। যখন পৃথিবীর অভিকর্ষ বল আর চন্দ্রযান-২-এর উপর কম কার্যকরী হবে। ওই সময় চন্দ্রযান-২ পৃথিবী থেকে থাকবে সর্বাধিক ৪ লক্ষ ১২ হাজার ৫০৫ কিলোমিটার দূরে। ভূপৃষ্ঠ থেকে ২৭৮.৪ কিলোমিটার উপরে।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

গ্রাফিক তথ্য সৌজন্যে; ইসরো

ছবি ও ভিডিয়ো সৌজন্যে: ইসরো

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE