Advertisement
E-Paper

মহারণ্যে এক নায়িকা

প্রতিভা বসু। শতবর্ষেও তাঁর আধুনিকতায় নতজানু হতেই পারে সমকাল। লিখছেন গৌতম চক্রবর্তীস্বামীর হাত ছেড়ে একাই মহারণ্যে প্রবিষ্ট হয়েছিলেন তিনি। যে প্রতিভা বসুর উপন্যাস নিয়ে ‘আলো আমার আলো’, ‘পথে হল দেরী’ বা ‘অতল জলের আহ্বান’-এর মতো হিট ছবি তৈরি হয়, তার চেয়ে ১৯৯৭ সালে বেরোনো এই ছোট্ট বইটি একেবারে আলাদা। নাম ‘মহাভারতের মহারণ্যে’। প্রতিভা বসুর বয়স এই সময় ৮২।

শেষ আপডেট: ২১ মার্চ ২০১৫ ০০:০৩
তখন বুদ্ধদেব বসু শুধুই ছবি

তখন বুদ্ধদেব বসু শুধুই ছবি

স্বামীর হাত ছেড়ে একাই মহারণ্যে প্রবিষ্ট হয়েছিলেন তিনি। যে প্রতিভা বসুর উপন্যাস নিয়ে ‘আলো আমার আলো’, ‘পথে হল দেরী’ বা ‘অতল জলের আহ্বান’-এর মতো হিট ছবি তৈরি হয়, তার চেয়ে ১৯৯৭ সালে বেরোনো এই ছোট্ট বইটি একেবারে আলাদা। নাম ‘মহাভারতের মহারণ্যে’। প্রতিভা বসুর বয়স এই সময় ৮২।

তার প্রায় এক দশক আগে তাঁর একমাত্র পুত্র শুদ্ধশীল বসু মারা গিয়েছেন। প্রতিভা একাই নাকতলার বিশাল ‘কবিতাভবন’ বাড়িতে সেবিকা ও জনা দুয়েক পরিচারককে নিয়ে থাকেন। আর এক দিকে সপরিবার থাকেন তাঁর ভাই। ভাল নাম ভুলে গিয়েছি, আমরা তুলনামূলক সাহিত্যে শুদ্ধশীলবাবুর ছাত্রেরা তাঁকে লারুমামা বলেই ডাকতাম।

পুত্রশোকের ছায়া তখনও সে বাড়িতে দমবন্ধ পাথরের মতো চেপে, প্রতিভা কখনও কখনও শান্তিনিকেতনের বাড়িতে চলে যেতেন। পূর্বপল্লীর এক কর্নার প্লটে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেওয়া জমিতে তোলা সে বাড়ির নাম বুদ্ধদেবের শেষ বেলার কাব্যগ্রন্থের নামে...স্বাগত বিদায়!

পাশের বাড়িটাই নীলিমা সেন বা বাচ্চুদির। সন্ধ্যাবেলা বারান্দায় আলো, পিছনের খোয়াই থেকে ট্রেনের শব্দ। তখনও শান্তিনিকেতনে খোয়াই ছিল, বিখ্যাত ব্যক্তিদের বাড়ির চাপে হারিয়ে যায়নি।

তখনও সে বাড়িতে সন্ধ্যায় আড্ডা বসে, মাঝে মাঝেই আসেন অম্লান দত্ত, শিবনারায়ণ রায়। সেই সময়েই প্রতিভা এক দিন বারান্দার সামনের গাছটা দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘এটা চেনো?’ আমি বলেছিলাম, ‘কে না চেনে? বাঁদরলাঠি।’ উনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘সংস্কৃতে কী বলে?’ যথারীতি পারিনি। পরে উত্তরটা তাঁর কাছেই জেনেছিলাম, অমলতাস।

মাসিমা শান্তিনিকেতনে থাকলে শুদ্ধশীলবাবুর পরিচিত ছাত্রছাত্রীরা তাঁর সঙ্গে এক বার দেখা করতে যাবে, সেটাই নিয়ম। মাস্টারমশাই নেই, তাঁর মায়ের সঙ্গে কথা বলছি, শুদ্ধশীলবাবুর মরদেহ যখন কেওড়াতলায় নিয়ে আসা হচ্ছে, ঘুমের ইঞ্জেকশনেও মাসিমাকে ঘুম পাড়ানো যাচ্ছে না... সেই স্মৃতি মাঝে মাঝেই আমাদের মনে পড়ছে, অথচ মাসিমা মহাভারত নিয়ে নানা কথা বলে যাচ্ছেন। শোক পাঁচ জনের সামনে প্রকাশের জন্য নয়, তাকে নিজের অন্তরে সহ্য করে যথাযোগ্য মর্যাদা দিতে হয়, এই ডিগনিটি-বোধটা প্রতিভা বসুর থেকেই বোধ হয় জেনেছিলাম।

প্রতিভার মহাভারত-দর্শন সেই বয়সে হাস্যকর লেগেছিল। বুদ্ধদেব বসুর ‘মহাভারতের কথা’ আমার অন্যতম প্রিয় বই, সেই বইয়ের শুরুতেই বুদ্ধদেব মহাভারতকে তুলনা করেছিলেন এক মহারণ্যের সঙ্গে। প্রতিভা প্রতিভাবান স্বামীর যুক্তি ফের তুলে ধরা ছাড়া নতুন কী আর করবেন! আর বুদ্ধদেবের গদ্যের ধারেকাছেও তিনি আসবেন না!

শতবর্ষে ফের বইটা আর এক বার পড়ে নিজের ভুল বুঝতে পারলাম। প্রতিভা অনেক জায়গাতেই বুদ্ধদেবের বিপক্ষে। বিদুর এবং যুধিষ্ঠিরের মধ্যে বুদ্ধদেব ধর্মের সম্পর্ক খুঁজে পেলেও প্রতিভা ইরাবতী কার্ভের মতোই বিদুরকে মনে করেন যুধিষ্ঠিরের পিতা।

বুদ্ধদেবের মতো মহাভারতীয় আখ্যানে ধর্ম ও স্বধর্মের দ্বন্দ্ব খোঁজেননি। তাঁর সাফ যুক্তি, মহাভারত আসলে অনার্য কালো মেয়েদের জয়ী হওয়ার কাহিনি। ধীবরকন্যা সত্যবতী সেখানে নিজের পুত্র ব্যাসদেবকে দিয়ে পুত্রবধূদের গর্ভে পুত্র উৎপাদন করান, পরিবারে আসে দ্রৌপদী নামে এক শ্যামবর্ণা মেয়ে। আর, গোপগৃহে পালিত কৃষ্ণও সেই ছকেই পাণ্ডবদের জয় চেয়ে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে হরেক ছলনার আশ্রয় নেন।

স্বামীর চোখে নয়, মেয়েদের দৃষ্টিতেই সাদা-কালো, আর্য-অনার্য দ্বন্দ্বে মহাভারতকে দেখতে চেয়েছিলেন তিনি। ‘মহাভারতে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধকে ধর্মযুদ্ধ বলার তুল্য মিথ্যা আর কিছু হতে পারে না...যখন প্রতিটি অধার্মিক আচরণ, অন্যায় আঘাত, মিথ্যাচার এবং শঠতা এসেছে পাণ্ডবপক্ষ থেকে, প্রধানত কৃষ্ণের কপটতাহেতু, বোঝা যায় না কী ধর্ম মহাভারতের উদ্দেশ্য’ লিখেছিলেন তিনি।

এ ভাবে ফেমিনিস্ট দৃষ্টিতে মহাকাব্যের যথাযোগ্য বিচার করা যায় কি না, অন্য প্রশ্ন। তাঁর বই বুদ্ধদেবের চেয়ে ভাল না খারাপ, সে প্রশ্নও অবান্তর। কিন্তু পণ্ডিত স্বামীকে না মেনে অন্য ভাবে মহাকাব্যের বিচার, এখানেই আধুনিক দাম্পত্য।

স্ত্রী এখানে স্বামীর যুক্তির প্রতিধ্বনি ঘটাচ্ছেন না, বরং নিজস্ব তর্কশীলতায় উপস্থাপন করছেন অন্য যুক্তি। স্ত্রী এবং স্বামী সারাক্ষণ পরস্পরের ফেসবুকে ক’টা লাইক দিচ্ছেন আর হোয়াটসঅ্যাপে ক’টা জোক শেয়ার করছেন, সেটা প্রযুক্তির অগ্রগতি প্রমাণ করে। দাম্পত্যপ্রেম নয়।

শতবর্ষে প্রতিভা বসুকে চিনতে গেলে আধুনিক বাঙালির এই প্রেম ও দাম্পত্যকে আগে বুঝতে হবে। ১৯১৫ সালে জন্মানো প্রতিভা তাঁর আত্মজীবনীতে লিখছেন, দোল-দুর্গোৎসবে বাবা এক মাসের জন্য তাঁদের গ্রামের বাড়িতে রেখে আসতেন। দাদু, দিদিমাদের মাঝে আনন্দে কাটত। কিন্তু বাবা চাকরিস্থলে ফেরার পরই মা কেমন যেন আনমনা হয়ে যেতেন। এই যে উন্মনা রোম্যান্টিক প্রেম, এখানেই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালির আধুনিকতা। তার আগে বাঙালির জীবনে কাম ছিল, স্বামী-স্ত্রীর দিনমানে দেখাসাক্ষাৎ হত না। যৌথ পরিবারে হেঁসেল ঠেলে ও বহুবিধ দায়িত্ব পালন করে রাতে ক্লান্ত শরীর নিয়ে স্বামীর শয্যাসঙ্গিনী হওয়ারই আর এক নাম ছিল দাম্পত্য। উনিশ শতকে বাঙালি নবজাগরণের পুরোধা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহ দিয়েছেন, মেয়েদের জন্য প্রচুর স্কুল তৈরি করেছেন, কিন্তু স্ত্রীকে অ-আ-ক-খও শেখাননি।

প্রতিভা বসু মুখ্যত প্রেমের গল্পলেখক। তাঁর বিভিন্ন গল্পে বিভিন্ন সিচুয়েশনে মেয়েরা প্রেমে পড়ে। কখনও বিধর্মী মুসলমান যুবকের সঙ্গে, কখনও মায়ের প্রেমিকের সঙ্গে, কখনও বা রাতে স্বামীকে ছেড়ে নায়িকা পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় সহানুভূতিশীল ডাক্তারের বাড়িতে। প্রেমই কি মেয়েদের নিজের পায়ে দাঁড় করায়নি?

ঢাকা শহরে ছেলেবেলায় প্রতিভা সাহিত্যিক জ্যোতির্মালা দেবী, স্কুলের ইন্সপেকট্রেস মিস বিশ্বাসের বাড়িতে যাচ্ছেন। তাঁরা একা থাকেন। জ্যোতির্মালা ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন, একটি ছেলের প্রেমেও পড়েছিলেন। কিন্তু বিয়েটা ঘটেনি।

জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িই বাঙালি আধুনিকতার একমাত্র উৎস নয়। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মেয়েরা তখন যে ভাবে প্রেমে পড়ছেন, বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েও চাকরি করতে করতে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জের মতো মফস্সল শহরে একাকী বাসা খুঁজে নিচ্ছেন, সেখানেও ছিল আধুনিকতার আলো।

প্রতিভা এবং বুদ্ধদেবের বিয়েও এই শিক্ষিত আধুনিকতার ফসল। বুদ্ধদেব তখন কলকাতার কলেজে সামান্য লেকচারার, আষাঢ়স্য প্রথম দিবসের বিকেলে প্রতিভার মা-বাবাকে বললেন, ‘আপনারা অনুমতি করলে এ বাড়িতে একটা বিয়ে হতে পারে। অবশ্য রাণুর যদি মত থাকে।’

স্বামী-স্ত্রী দু’ জনে প্রথম ফ্ল্যাটভাড়া নিলেন রমেশ মিত্র রোডে। ক্রমে ২০২ রাসবিহারী অ্যাভিনিউ। বুদ্ধদেবের প্রতিজ্ঞা, কোনও লেন, বাই-লেনে থাকবেন না। বাড়ির ঠিকানায় থাকতে হবে রোড। উত্তর কলকাতার বনেদি বাড়িগুলিই এক এবং একমাত্র নয়। তিরিশের দশকে দক্ষিণ কলকাতার রোডস্থ ঠিকানায় মধ্যবিত্ত দম্পতির ভাড়াটে বাড়ি খোঁজার মধ্যেও লুকিয়ে আছে আধুনিকতার ইতিহাস।

এই আধুনিকতা দাম্পত্য পরিসরে নারী-পুরুষের সমান অধিকারের। বুদ্ধদেব বসু বাঙালির খাওয়াদাওয়া নিয়ে তাঁর অনন্য গদ্যে অনেক কিছুই লিখেছেন, কিন্তু এতটুকু রান্না জানতেন না। অথচ ডাইনিং টেবিলে বাটি সাজিয়ে খেতে বসা তাঁর প্যাশন। প্রগতিশীলারা কেউ কেউ তাঁকে হিপোক্রিট গণ্য করতে পারেন। কিন্তু রান্না জানাই সমব্যথী পুরুষের একমাত্র মাপকাঠি হতে যাবে কোন দুঃখে?

প্রতিভা বসু এবং অনেকের মুখেই শুনেছি, পঞ্চাশের দশকে তাঁদের বড় মেয়ে মীনাক্ষীর সঙ্গে জ্যোতির্ময় দত্তের বিয়ের কার্ডে নিমন্ত্রণকর্তা হিসেবে প্রথমে ছিল প্রতিভা বসুর নাম। তার নীচে বুদ্ধদেব বসু। বিয়ের কার্ডে মা-বাবা দু’ জনের নাম লেখা নাকি বাঙালি পরিবারে সেই প্রথম। জাতিরাষ্ট্র, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ইত্যাদি বড় বড় ব্যাপার ছাড়াও পারিবারিক পরিসরে আধুনিকতার আরও অনেক চিহ্ন থাকে, সেগুলি আমাদের নজর এড়িয়ে যায়।

তাঁর শতবর্ষে যেটি বারংবার মনে পড়ে, তাঁর ইনভেস্টমেন্ট পলিসি। বুদ্ধদেব টাকাপয়সা বিষয়ে উদাসীন ছিলেন, সেই হালটি প্রতিভা শক্ত হাতে ধরেছিলেন। তাঁর মুখেই শুনেছি, নাকতলা বা শান্তিনিকেতনে বাড়ি তৈরির বেশির ভাগ টাকাটাই সিনেমায় তাঁর গল্প বিক্রির ফসল।

ষাটের দশকেও আজকের পাটুলি ফায়ার ব্রিগেডের কাছে, বাইপাসের মুখে জমি কিনেছিলেন। তখন সেটি প্রায় গ্রাম। বুদ্ধদেব নাকি খুব গজগজ করেছিলেন, ‘এখানে মানুষ থাকে?’ পরে প্রতিভা জমিটি বিক্রি করে দেন। নিজেই বলতেন, ‘গয়না কিনে আমি কোনও দিন টাকা নষ্ট করিনি। আমার টানটা ছিল জমির ওপরে।’ অনেক পরিবারেই মহিলারা আজকাল অর্থনৈতিক ভাবে স্বাধীন, শপিং মলে ইচ্ছামাফিক পোশাক, অ্যাকসেসরিজ কেনেন। কিন্তু আজও সংসারে ক’জন মহিলা নিতে পারেন নিজস্ব ইনভেস্টমেন্ট পলিসি?

আর একটি তথ্য এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে না। তখন তিনি পুত্রশোকাতুর, লেখায় মন নেই। তাঁর কনিষ্ঠা কন্যা দময়ন্তী বসু সিংহ প্রকাশনা ব্যবসায় নামবেন বলে লেখিকাকে কিছু টাকা অ্যাডভান্স দেন। মাসিমা পর দিন ঘটনাটা বলে খুব হেসেছিলেন, ‘মেয়েও বই নেবে বলে টাকা অ্যাডভান্স দিয়ে গিয়েছে।’ কিন্তু তার পর আস্তে আস্তে মহাভারতের মহারণ্যে ডুবে যান। টাকা তো আত্মজার নয়, প্রকাশকের। ফলে কাজটা শেষ করতে হবে। এই পেশাদারিত্ব আজকাল বিরল।

তাঁর মহাভারতের মহারণ্যের অনেক কথাই আজকাল মানা যায় না। কেনই বা মহাকাব্যকে দেখব আর্য-অনার্য রমণীর খণ্ডদৃষ্টিতে? বুদ্ধদেব বসুর অনবদ্য বইটিও আজকাল প্রশ্ন তোলে। মহাকাব্যে কেন খুঁজব নায়ক? ক্লাসিকচর্চা অনবরত এগিয়ে যায়, তৈরি হয় নতুন দিগন্ত।

সেই নতুন দিগন্তে বই ও আড্ডাস্মৃতির ‘কবিতাভবন’ আজ শুধুই ভাড়াটে বাড়ি। শান্তিনিকেতনের বাড়িটাও জঙ্গলে, আগাছায় আকীর্ণ। দেখলে ধাক্কা লাগে।

ধাক্কাই অবশ্য শেষ কথা নয়। তিনিই তো লিখে গিয়েছেন ‘স্মৃতি সততই সুখের।’

buddhadeb basu patrika anandabazar Shantiniketon Mahabharat whatsapp facebook England Protiva Bose
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy