গভীরতা: ‘ব্ল্যাক হোল প্রজেক্ট’ প্রদর্শনীর কাজ। সম্প্রতি আর্ট মাল্টি ডিসিপ্লিনস স্টুডিয়োয়
ব্ল্যাক হোল প্রজেক্ট একটি অভিনব প্রদর্শনী। তিন তরুণ শিল্পীর সিলিং থেকে মেঝে পর্যন্ত চার দেওয়াল জোড়া বিশাল সাদা-কালোর ড্রয়িং। চারকোল অথবা কন্টির মহাজাগতিক অতল রহস্যের প্রেক্ষিতে আমেরিকায় নব্বইয়ের দশকের বিখ্যাত ব্যান্ড সাউন্ড গার্ডেনের ‘ব্ল্যাকহোল সান’ নামে জনপ্রিয় সঙ্গীতের মাধ্যমে গোটা পর্বটি দর্শককে অবহিত করান। এই সঙ্গীতের শিল্পী প্রয়াত ক্রিস কর্নেলের উচ্চঃস্বরে গাওয়া জনপ্রিয় সাঙ্গীতিক মূর্ছনায় রক সঙ্গীতের মধ্যে ঘটতে থাকে বিস্ময়কর সব ঘটনা, যা কিনা মহাকাশের কৃষ্ণ গহ্বরকে কেন্দ্র করে। এই ভিডিয়োটি আসলে প্রদর্শনীর প্রাথমিক পর্ব। আজকের পৃথিবীর লোভ, ঈর্ষা, ক্রোধ, হানাহানি থেকে শুরু করে ধর্ষণ এবং সন্ত্রাসের মতো যাবতীয় অমানবিক ক্রিয়া— এ সবই একটি ‘সোশ্যাল ব্ল্যাকহোল’। ক্রিস কর্নেল দেখিয়েছিলেন সম্পূর্ণ বিপরীত দৃশ্যকল্প। কালো অন্ধকার গর্ভ সব আলো টেনে নিচ্ছে। কর্নেল দেখালেন, উল্টোটা হলে কেমন হয়? আলোর পরিবর্তে যদি সমাজের সব খারাপ দিককেই ব্ল্যাকহোল টেনে নেয়? যদি সব উন্মত্ততার বিরুদ্ধে তৈরি হয় এক অনন্য পৃথিবী?
অন্য রকম কনসেপচুয়াল আর্টের ধারণায় মিউজ়িক ও ভিসুয়াল আর্টের এমন রেফারেন্স নিয়ে প্রদর্শনীর মূল পরিকল্পনাকারী অয়ন মুখোপাধ্যায় তাঁর গ্যালারি এ এম স্টুডিয়োয় প্রদর্শনীটি কিউরেট করেন। সম্প্রতি শেষ হওয়া এই প্রদর্শনীতে অরিন্দম চট্টোপাধ্যায়, চন্দ্র ভট্টাচার্য ও শ্রীকান্ত পাল— এই তিন শিল্পীকে অয়ন সমগ্র বিষয়টি ব্যাখ্যা করে ক্রিস কর্নেলের ভিডিয়োটি দেখান। শিল্পীরা
তাঁদের ব্যক্তিগত ভাবনাচিন্তাকে কৃষ্ণগহ্বরের ভূমিকার সমন্বয়ে, মেটাফর হিসেবেই দ্বিমাত্রিক বিশাল ড্রয়িংয়ের মাধ্যমে এক বিস্ময়কর উপস্থাপনায় প্রকাশ করেন।
অরিন্দমের ড্রয়িং রূপক। গানের কথার সঙ্গে মিল নেই। কিন্তু যেন এক ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধাচরণের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে তাঁর ছবি। পৃথিবীর সব বাস্তব যুক্তি ও সত্যকে গুলিয়ে দেওয়া এক উন্মত্ত শক্তিকে আঘাত করছে তাঁর ড্রয়িংয়ের প্রেক্ষাপট। নঞর্থক দিক দিয়ে আঘাত করতে চাওয়া এই প্রক্রিয়ার অন্তরালে আত্মগোপন করে থাকা একটি সদর্থক দিক এর পরেই হয়তো তীব্র প্রতিরোধে উঠে আসবে। ভীত এবং চলচ্ছক্তিহীন স্তূপাকৃতির মতো একদল নগ্ন মানুষ এ ওর ঘাড়ে উঠে যন্ত্রণাক্লিষ্ট অবস্থায় দু’দিকে এক ভয়ানক পরিবেশ তৈরি করেছে। এক জন বন্য পশুর বেশে কামড়ে ধরেছে অন্যের পা, মাঝখানে বিশাল রোমশ হনুমান দীর্ঘ লেজ নিয়ে লাফিয়ে পার হতে চাইছে এই ভয়াবহ পরিস্থিতি। তাঁর অসাধারণ ড্রয়িং ও স্টাইলাইজ়েশন কৃষ্ণগহ্বরের এক ধ্বংসাত্মক রূপক। ভাবনায় এবং রচনায় যা অনন্য। অন্ধকারের অন্তরে তীব্র আলোর আশা!
চন্দ্র সম্পূর্ণ সদর্থক আঙ্গিকে একটি পরিবেশ তৈরি করেছেন। যেন সমস্ত অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির বিরুদ্ধে শান্ত, প্রার্থনারত, সাদা শার্ট কালো প্যান্ট পরে নতজানু হয়ে বসা এক মানুষ আলোর উৎসকে আহ্বান করছে সমস্ত প্রেক্ষাপট জোড়া অন্ধকারের বিরুদ্ধে। শেষ গাছ জ্বলছে, পোড়া হাড়গোড় পড়ে আছে। গাছের আগুন থেকে ওঠা ধোঁয়া ও ফুলকি তীব্র ছুটে যাচ্ছে এক দিকে। আর এ সবের মধ্যেও মানুষটি ওই সাদা আলোর বিচ্ছুরণকেই যেন আহ্বান করে চলেছে! দু’টি দিককেই শিল্পী দেখাচ্ছেন— ধ্বংসটি কৃষ্ণগহ্বর আর হঠাৎ তৈরি হওয়া আলোটি এই পৃথিবীতে নেমে আসা এক শেষ আশা। এই বোধই এ ছবি আঁকতে অনুপ্রাণিত করেছে তাঁকে। স্পেসকে তিনি উল্লেখযোগ্য এক ডায়মেনশনে দেখাতে পেরেছেন এ কারণেই!
শ্রীকান্ত সামাজিক এক রূপকার হিসেবে এই গোটা পর্বকেই এক জার্নি হিসেবে দেখিয়েছেন। তাঁর ছবি প্রকৃত রূপক এবং তা রূপকথার অন্তর্নিহিত এক অধ্যায়কে মনে পড়ায়। মুখ ঢাকা নগ্ন একদল মানুষের দীর্ঘ পদযাত্রার দেওয়াল ও দরজার ফ্রেম ভেদ করা আশ্চর্য কম্পোজ়িশন। এখানে তৈরি হওয়া আলো ও ধোঁয়ার কুণ্ডলী, ওখানে ঝুলন্ত গাছের ডাল। এক পাশে কালো বেড়াল— মোটা প্রশাখা থেকে বেরোনো দু’জোড়া ঊরুসদৃশ পা, কাঠের চুল্লিতে বসা নগ্ন নারীর হাতে কাঠের হাতুড়ি বাটালি। পাশে পক্ষিমুখের নগ্ন মানবী। গোটা কাজটিতেই সুররিয়্যালিজ়মকে প্রাধান্য দিয়েছেন। নশ্বর দেহ থাকবে না, কিন্তু শিল্পী বা রূপকারের কাজ ও ভাবনা থেকে যাবে। শিল্পী নিজেই মৃত সূর্য, কিন্তু নিষ্ক্রিয় নন। নানা ব্ল্যাকহোলের মাধ্যমেই তাঁর যাত্রা। অসামান্য রূপক ও অনবদ্য ড্রয়িং!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy