মডেল: তন্ময় পাল ও আর্য লাহিড়ী, মেকআপ: রূপাঞ্জনা ভট্টাচার্য, ছবি: নীলোৎপল দাস
আপনার সন্তান জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়ের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে। তার শরীর-মনে পরিবর্তন ডালপালা মেলছে। তাই এক দিক থেকে দেখলে সময়টা বড় কঠিন। যখন সে ভেসে যেতে পারে, আবার দৃঢ় ভিত্তিতে দাঁড়াতেও শিখতে পারে। বাবা-মায়ের কথা শুনতে এখন ওর ভাল লাগে না। কেউ ওকে বোঝে না। ফলে একটা কমিউনিকেশন গ্যাপ তৈরি হওয়ার জায়গায় দাঁড়িয়ে দু’ পক্ষই।
আসলে দশ-এগারো বছর বয়স অবধি আপনার জুডো বা ঝিলিক বাবা-মায়ের জীবনটাই নিজের বলে মনে করত। আপনাদের বন্ধুর ছেলেমেয়েরা সন্তানেরও বন্ধু। তখন তারা কী খাবে, কী পরবে অনেকাংশে কন্ট্রোল করতেন আপনিই। কিন্তু এখন যেন হঠাৎ করেই ওদের নিজস্ব মতামতগুলো বড্ড মাথাচাড়া দিচ্ছে। ব্যাপারটা কী হয় জানেন? বারো-তেরো বছর বয়সে গিয়ে মন বিদ্রোহ করে। এবং নিজস্ব আইডেনটিটি তৈরি হওয়া শুরু হয়। বাবা-মায়ের বাইরে যে একটা জগৎ আছে এবং সেখানে অন্য ছেলেমেয়েরা ও তাদের বাবা-মায়েরা যে তাদের মতো নয়, এই ভাবনাটা দারুণ রকম পেয়ে বসে। নানা বৈপরীত্য ওই বয়স থেকে ভীষণভাবে চোখে পড়তে থাকে। বাচ্চারা তখন একটা ঝকঝকে জগতের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে। এই প্রসেসটা বোঝা কিন্তু আপনাদের জন্যও জরুরি। কারণ এ সময় বাচ্চারা বন্ধুদের বেশি গুরুত্ব দেয় বাবা-মায়ের চেয়ে।
এই ভাবনা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। সন্তান যদি এই সময় বাইরের জগতের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে না পারে, তা হলে সে কোনও দিনই পারবে না। বরং এমন যদি হয় যে, আপনার আদরের গুবলুর কোনও বন্ধু নেই, সে সারা দিন আপনাদের সঙ্গে থাকে বলে আপনি প্রশংসায় চর্তুমুখ, তা হলে সেটা চিন্তার ব্যাপার বই কী! কারণ তার নিজস্ব ব্যক্তিত্ব তৈরি হচ্ছে না। ভবিষ্যতে চাকরি বা পড়াশোনার জন্য একা থাকতে হলে, সে কিন্তু পারবে না। সব সময় সে কারও উপর নির্ভরশীল হবে।
সন্তান যখন ক্রমশ টিনএজের দিকে এগোচ্ছে, তখন পেরেন্টিং স্টাইলে বদল আনুন। এত দিন না করলেও এখন থেকে ফ্যামিলি মিটিং শুরু করুন। আপনার টিনএজ সন্তান কিন্তু অনেক কিছু মনে চেপে রাখে, যার আঁচও আপনি পাননি। কোনও ব্যাপারে ক্ষোভ থাকলে, ফ্যামিলি মিটিংয়ের মধ্য দিয়ে তার সমাধান সম্ভব। ধরুন, আপনার মেয়ে বলল, সে দিন মায়ের সঙ্গে বাবার ওভাবে চিৎকার করে কথা বলাটা আমি পছন্দ করিনি। তখন কিন্তু বাবাকে বুঝতে হবে, তাঁর সন্তান কী অপছন্দ করছে। এই ক্ষোভ প্রকাশের জায়গাটা রাখতে পারা গেলে, সেটা ওর সুস্থ মানসিক গঠনে সাহায্য করবে। আর একটা সমাধান হল কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ডিং। সপ্তাহে অন্তত এক দিন ছেলে বা মেয়ের সঙ্গে আলাদা করে হাঁটুন। সে কী করছে, কোনও পরিবর্তন হচ্ছে কি না, সমস্যা হচ্ছে না তো কোনও... সেগুলো গল্পচ্ছলে জানা। এটাও ঠিক, আমরা অথরিটেরিয়ান কাঠামোয় বড় হই বলে, এই উন্মুক্ততা আশা করা কঠিন। তা সত্ত্বেও আপনাকেই শাসনের মধ্যে খোলা বাতাস বইবার জায়গাটুকু রাখতে হবে।
এই বয়সে বড় চিন্তার জায়গা হল, বুলিং। অর্থাৎ ভয় দেখিয়ে দুর্বলের উপর জবরদস্তি করা। আপনার সন্তানের উপর তেমনটা কেউ করছে না তো? অনেক সময় কাউকে একঘরে করে দেওয়ার চেষ্টা চলে। আছে সাইবার বুলিংও। অনেক বাবা-মা’ই আজকাল সন্তানকে দামি স্কুলে ভর্তি করান এবং তার পর তাল সামলাতে পারেন না। এমন স্কুল আপনি বেছে নিলেন, যেখানে ৯০ শতাংশ বাচ্চার হাতে ভীষণ দামি মোবাইল, কিন্তু আপনার সেটা দেওয়ার ক্ষমতা নেই। সেখানে সমস্যা অবশ্যম্ভাবী। তাই স্কুলে ভর্তি করার আগে দেখুন, সোশ্যাল-ইকনমিক স্ট্রাকচারে ব্যালান্স আছে কি না।
সন্তানের মনের গতিবিধি বোঝার সহজ উপায় হল, তার বন্ধুদের চেনা এবং জানা। এ সময় সন্তান বাবা-মায়ের কাছে অনেক কিছু লুকিয়ে যায়। কিন্তু চোদ্দো-পনেরো বছরের ছেলেটি বা মেয়েটি কার বাড়িতে যাচ্ছে, কী সিনেমা দেখতে যাচ্ছে, সবই বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করে। তাই ছেলে-মেয়ের বন্ধুদের সঙ্গে আপনার ভাল সম্পর্ক থাকলে, ওদের কাছ থেকেই অনেক খবর পেয়ে যাবেন। এ ক্ষেত্রে দরকার হলে হস্তক্ষেপ করুন, তবে সব সময় নয়। এ সময় বন্ধুর মতো করে মেশা প্রয়োজন, কিন্তু তা করতে গিয়ে যখন আপনার না বলা প্রয়োজন, সেটা বলবেন না। এটা ভুল। বাবা-মায়ের সচেতনতা ও দূরদর্শিতাই কিন্তু পারে আদরের আত্মজকে সুস্থ-সুন্দর জীবনের দিশা দেখাতে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy