রেকর্ডিংয়ে সলিল চৌধুরীর ছেলের সঙ্গে, ১৯৮৭ সালে
বেকার বিল্ডিংয়ের গান
প্রবাস জীবন পোষাল না মণিদার। চাকরিবাকরি ছেড়ে কলকাতায়। সেটা ’৭৪ সাল। নকশাল রাজনীতিতে ক্রমশ ভাঁটা পড়েছে। কমেছে পুলিশের আনাগোনাও। শুরু হল নতুন উদ্যমে গান বাজনা। বস্তুত, এই সময়ে গৌতমরা বাড়িতে যে কয় ভাই ছিলেন, কেউই সে ভাবে কাজ করছেন না। ফলে গৌতমও সেই সুযোগে বাড়ির নাম রাখলেন ‘বেকার হাউস’। প্রেসিডেন্সির ‘বেকার ল্যাবরেটরি’র অনুকরণে। বেকার হাউস তখন নতুন গানের আখড়া।
শুরু হল রাতদিন গান নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট। আর তারই মধ্যে পা ভাঙল মণিদার। প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, ‘‘মণিদার পা ভেঙেছিল বলেই আমাদের ব্যান্ডটা তৈরি হয়েছিল। কারণ ও গৃহবন্দি হয়ে পড়েছিল। সারা দিন বাড়িতে পাওয়া যেত।’’ শোনা যায়, গৌতমের পায়ের প্লাস্টারে সকলে এসে সই করতেন। ওটাই ছিল ব্যান্ড মেম্বারদের হাজিরার খাতা। এই সময় পর্বেই রঞ্জন ঘোষাল লিখছেন ‘রানওয়ে’। সবাই মিলে তৈরি হচ্ছে ‘কলকাতা’ গানটি। দলে তখন সাত জন। মণিদা, বুলা ওরফে প্রদীপ, ভানু, রঞ্জন, বাপি, এব্রাহাম, বিশু। এ রকমই কোনও এক মহড়ার পর কেউ এসে লিখে দিয়ে গিয়েছিলেন ‘আস্তাবল’ কথাটা। কেমন হত সেই মহড়া? রঞ্জন ঘোষাল স্মৃতিচারণে বলছেন, ‘‘রাজাদের খিদিরপুরের বাড়িতে মহড়া বসেছে। শুক্কুরবার। পরের দিন স্টার থিয়েটারে শো। যন্ত্রগুলোর সঙ্গে সড়গড় হয়ে নেওয়া জরুরি। পিয়ানো আছে রাজাদের বাড়ি... আমি আর বুলাদা পৌঁছেছি দেরিতে। দেরির কারণ, দু’জনেরই এক। বুলাদার ছিল শর্মিষ্ঠা (অধুনা বুলাদার পত্নী), অপেক্ষায় থিয়েটার রোডের অরবিন্দ ভবনে। আর রিঙ্কুর। মানে সঙ্গীতার (অধুনা আমার দুই সন্তানের জননী)। রাজাদের বাড়িটা বড়। কিন্তু বাইরে থেকে কান পাততে হচ্ছে না। শোনা যাচ্ছে কণ্ঠে-যন্ত্রে জমকালো মহড়ার বজ্রনির্ঘোষ। আমরাই শুধু নেই। চেলো শুনছি, বিশুর ঢাউস কন্ট্রাবেসের গুরুগম্ভীর আওয়াজ পাচ্ছি। মণিদার ইলেকট্রিক গিটার। বাপি, ভানু আর মণিদার গলা... রাজাদের বাড়ির সদর দরজাটা খোলাই ছিল। বিহারী দরোয়ান বারবার বলছে, চলিয়ে যান না! উপরে উঠিয়ে যান! কিন্তু আমাদের কি প্রাণের ভয় নেই? এমন সময়ে হঠাৎ এক জন ঢাকী একখানা বিশাল ঢাক কাঁধে এসে আমাদেরই জিগ্যেস করে বসল, ব্যানার্জিদের বাড়িটা কোনটা বলতে পারেন? আমি ওকে আর বাক্য সমাপ্ত করতে দিলাম না। ঢাকখানা ওর কাঁধ থেকে খুলে নিজের কাঁধে নিলাম। তার পর ভারিক্কি চালে উপরে উঠে গেলাম। আমাকে ঢাক কাঁধে ঢুকতে দেখে থেমে গেল গান। আমার পিছনে বুলাদা। হাতে বাঁশি। যেন এত ক্ষণ রেওয়াজে মত্ত থাকার জন্যই সময় বেভুল হয়ে গিয়েছে... মণিদার ছুড়ে মারা দেশলাই বাক্সটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। না হলেও ক্ষতি ছিল না। তত ক্ষণে আসল ঢাকীর আপ্যায়নে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।’’
মহীনের ঘোড়াগুলি
শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে তখন চুটিয়ে অনুষ্ঠান করছে সাত তরুণ। কিন্তু অনুষ্ঠান করলে তো নাম দিতে হয় নিজেদের! সাত জনের দলের নাম হয়ে গেল ‘সপ্তর্ষি’। যদিও স্টেজে উঠে অনেক সময়েই মণিদা ভুলভাল নাম বলে দিতেন। তেমনই একটি নাম ‘গৌতম চ্যাটার্জি বিএসসি অ্যান্ড সম্প্রদায়’।
ঠাট্টা-ইয়ার্কি মেরে এ ভাবেই দিব্যি চলছিল গানবাজনা। রঞ্জন ঘোষাল সিরিয়াস করে দিলেন আবহ। জমাটি এক আড্ডার বিকেলে হঠাৎ প্রস্তাব করলেন দলের নতুন নাম— ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’। এর পর আর কখনও নাম বদলায়নি দলের। শো খুব বেশি আসত না। তবে সেই আমলেও ঘোড়ার দল সাড়া ফেলে দিয়েছিল রবীন্দ্রসদনে মস্ত একটা শো করে।
তিন ভাগে অনুষ্ঠান। প্রথম ভাগে ছিল অ্যাকোয়াস্টিক ইনস্ট্রুমেন্ট। তার সঙ্গে বাউল-সুফি-ভাটিয়ালির মেডলি। দ্বিতীয় ভাগে ছিল পুরনো বাংলা গান। অখিলবন্ধু ঘোষের গান থেকে শুরু করে শচীন দেববর্মণ... সকলের গানই গাওয়া হয়েছিল সেই পর্বে। আর তৃতীয় পর্বে ইলেকট্রিক রক। সঙ্গে কিছু বাউল এবং জ্যাজ়। দড়ি আর বাঁশ দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল স্টেজ ক্রাফট। ওই সময়ে ওই ধরনের স্টেজ ক্রাফট কলকাতা দেখেনি। ছোটবেলা থেকে জড়ো করা বেদের গান, বাউলসঙ্গ, মাঠের গান ঢুকে পড়েছিল আর্বান আধুনিক গান এবং তার পরিবেশনায়।
ব্যান্ড ভাঙার অধ্যায়
এত কিছু নিতে পারেননি মধ্যবিত্ত বাঙালি দর্শক। বছর বিশেক বাদে যে মহীন ‘প্রজন্মের গান’ হয়ে উঠবে, সত্তর-আশির দশকে সেই মহীনকে সমালোচনাই শুনতে হয়েছে বেশি। আকাশবাণীতে তাঁদের বলা হয়েছে, ‘এ সব কোনও গানই নয়।’ ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে গান লেখা পাতা, তাঁদেরই চোখের সামনে। আনন্দবাজার পত্রিকায় অবশ্য প্রশংসাসূচক কড়চা লিখেছিলেন শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়। বস্তুত সেই কড়চার পরেই রেডিয়োয় গান গাওয়ার সুযোগ পায় মহীন।
তবে নিজেদের সমালোচনাও রসিকতা হিসেবেই দেখতেন গৌতম এবং তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা। নিজেদের অ্যালবামের কভার তৈরি করতেন তাঁদের নামে বেরোনো নানা সমালোচনার ক্লিপিং দিয়ে। কিন্তু অ্যালবাম সে ভাবে বিক্রি হল না। শিলাজিৎ তাঁর এক স্মৃতিচারণে লিখেছিলেন, ‘‘পূজা স্টুডিয়োতে মণিদাকে জিগ্যেস করেছিলাম, অত দিন আগে এ ধরনের গান রেকর্ড করার জন্য তোমাদের টাকা দিত কে? খুব গম্ভীর মুখে মণিদা বলেছিল, ‘কেন ফরেন মানি!’ ফরেন মানি? মণিদা আরও গম্ভীর মুখ করে বলেছিল, ‘হ্যাঁ, কাবুলিওয়ালা’।’’