Advertisement
E-Paper

বিয়েতে আংটি পেয়ে কী কুণ্ঠা

বরিশালে এক আত্মীয়ার কাছে অনুযোগও করেছিলেন কবি তাঁর জীবন ঘটনাবহুল নয় বলে আত্মজীবনী লেখায় হাত দেওয়ায় কুণ্ঠা ছিল।অথচ অন্যের স্মৃতিচারণায় তাঁর জীবনের এত অপরূপ সব ঝলক আছে যা এই নির্জন, নির্লোভ, গভীর, স্বল্পবাক, স্বাভিমানী মানুষটিকে কী সুন্দর উদ্ভাসিত করে।কয়েকটি নমুনা—

শেষ আপডেট: ০২ জুলাই ২০১৬ ০০:০০
দিল্লির রাজঘাটে (বাঁ দিকে থেকে) লাবণ্যদেবী, মেয়ে মঞ্জুশ্রী এবং ভাইপো অমিতানন্দ ও ছেলে সমরানন্দের সঙ্গে

দিল্লির রাজঘাটে (বাঁ দিকে থেকে) লাবণ্যদেবী, মেয়ে মঞ্জুশ্রী এবং ভাইপো অমিতানন্দ ও ছেলে সমরানন্দের সঙ্গে

তাঁর জীবন ঘটনাবহুল নয় বলে আত্মজীবনী লেখায় হাত দেওয়ায় কুণ্ঠা ছিল।

অথচ অন্যের স্মৃতিচারণায় তাঁর জীবনের এত অপরূপ সব ঝলক আছে যা এই নির্জন, নির্লোভ, গভীর, স্বল্পবাক, স্বাভিমানী মানুষটিকে কী সুন্দর উদ্ভাসিত করে।

কয়েকটি নমুনা—

স্ত্রী লাবণ্য দাশ লিখছেন, ‘‘তিনি মিলের মোটা ধুতি ছাড়া পরতেন না, এবং একটু উঁচু করেই পরতেন। আমি এক দিন এক খানা ভাল ধুতি কিনে কবিকে বললাম, ‘কী যে তুমি মোটা মোটা ধুতি হাঁটুর উপরে পরে রাস্তা দিয়ে হাঁটো! লোকে হাসে না?’ কথাটা বলেই ধুতিখানা তাঁর দিকে এগিয়ে দিতে যাচ্ছিলাম।

তিনি তখন কী একটা লেখার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। ধুতিখানা ধরেও দেখলেন না। তাঁর মুখে সামান্য একটু বিরক্তির ভাবও প্রকাশ পেল না। শুধু লেখাটা থামিয়ে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার পর আস্তে আস্তে বললেন, ‘দেখো, তুমি যে ভাবে খুশি সাজ-পোশাক করো, তোমার সে-ইচ্ছেয় আমি কোনও দিনই বাধা দেব না। কিন্তু আমাকে এ বিষয়ে তোমার ইচ্ছামতো চালাতে বৃথা চেষ্টা কোরো না।’

তিনি রাগলেনও না, বকাবকিও করলেন না। কিন্তু আমার মনে হল, কে যেন আমার শরীরের সমস্ত শক্তি টেনে নিয়েছে। আমি কোনও মতে নিজেকে টানতে টানতে সেখান থেকে সরে গেলাম।

যত দিন তিনি পৃথিবীতে ছিলেন, আমার মুখ থেকে এ রকম কথা আর কোনও দিন বের হয়নি। যে দিন তিনি চিরদিনের মতোই যাত্রা করলেন, সেই ধুতিখানাই পরিয়ে দিলাম। সেখানা বছরের পর বছর আমার বাক্সে রাখা ছিল।’

লাবণ্যকে কী ভাবে স্ত্রী হিসেবে পছন্দ করেছিলেন, সেই বৃত্তান্তটিও অতি স্বাদু। কবির চরিত্রের ওপরও আলোকপাত করে। লাবণ্যের বয়ানেই শুনুন—

‘‘পটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে আমি তখন সবেমাত্র ঢাকা ইডেন কলেজে ভর্তি হয়েছি। হস্টেলে থাকি। হঠাৎ এক দিন সকালে শুনলাম জেঠামশাই বাড়িতে ডেকে পাঠিয়েছেন। ...

মাথায় লম্বা বেণী, কোমরে আঁচল শক্ত করে জড়ানো। পায়ে আর শাড়ির পাড়ে কাদা। আমার দিদি তো (বেথুন কলেজে বিএ পড়ে। কয়েক দিনের জন্য ঢাকায় এসেছে) আমাকে দেখে হেসেই অস্থির। আমি চটে গিয়ে বললাম, ‘হাসি থামিয়ে এখন কিছু খেতে দিয়ে বাধিত করো।’

এমন সময় জেঠামশাই দোতলা থেকে হাঁক দিয়ে বললেন, ‘মা লাবণ, কয়েকখানা লুচি নিয়ে এসো তো!’

দিদি লুচির পাত্রটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়েই হাসি চাপতে দূরে সরে গেল। আমিও সেটা নিয়ে দুমদাম করে শব্দ করতে করতে উপরে চলে গেলাম।

জেঠামশাইকে ঝাঁঝের সঙ্গে কী একটা বলতে যাব, তাকিয়ে দেখি সেখানে একজন ভদ্রলোক বসে আছেন। তিনি একবার আমার দিকে তাকিয়েই তাড়াতাড়ি চোখ ফিরিয়ে নিলেন।

জেঠামশাই আমাকে বললেন, ‘এই যে মা, এসো আলাপ করিয়ে দি। এঁর নাম জীবনানন্দ দাশগুপ্ত। দিল্লি থেকে এসেছে।’

আমার তখন রাগের বদলে হাসির পালা। ছোটবেলা থেকে বেশ ভালভাবেই হাসিটি আরম্ভ করেছিলাম। হাসি সামলাতে না পেরে ভদ্রলোকের দিকে পিছন ফিরেই একটা টুলের উপরে বসে পড়লাম।

জেঠামশাই বারবারই বলতে লাগলেন, ‘ও কি, পিছন ফিরে বসেছ কেন? ঠিক হয়ে বসো। বাড়িতে অতিথি এলে ঠিক ভাবে আপ্যায়ন না করাটা খুবই অন্যায়। ইনি তোমাকে কী ভাবছেন?’’

ইনি নামক ব্যক্তিটি আমাকে যা-ই ভাবুন না কেন, ঠিক হয়ে বসব কী— আমি তখন আমার হাসি সামলাতেই ব্যস্ত। যাই হোত, কিছুক্ষণ চেষ্টার পর আমি তাঁর দিকে ফিরে বসলাম। কিন্তু অসীম ধৈর্য ভদ্রলোকটির। যতক্ষণ পর্যন্ত আমি না ফিরলাম, তিনি চুপ করেই বসে রইলেন।

তাঁর দিকে ফেরার পরে তিনি আমাকে তিনটি প্রশ্ন করলেন, ‘আপনার নাম কী? আইএ-তে কী কী সাবজেক্ট নিয়েছেন? এবং কোনটি আপনার বেশি পছন্দ?’’’

লাবণ্যর রচনা থেকে আরও জানা যায় যে, ওঁকে পছন্দ করার আগে জীবনানন্দ তাঁর মেসোমশায় বরিশালের বাণীপীঠ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রসঞ্জন সেনকে নিয়ে বরিশালেই এক বার একটি পাত্রী দেখতে গিয়েছিলেন।

সেখানে পাত্রীপক্ষ জীবনানন্দকে বিলেত পাঠাতেও চেয়েছিলেন।

মেসোমশায়ের মত থাকলেও জীবনানন্দ সে পাত্রী পছন্দ করেননি।

লাবণ্যকে বিয়ে করার সময় কবি উপহার নিয়ে কী অস্বস্তিতে পড়েছিলেন, তারও উল্লেখ আছে রচনায়।

লিখছেন, ‘‘বিয়েতে একটি মাত্র আংটি ছাড়া— বোতাম, ঘড়ি অথবা আসবাব কিছুই তাঁকে দেওয়া হয়নি। কিন্তু এই আংটিটির জন্যই তিনি কত লজ্জিত, কত কুণ্ঠিত! যেন মহা অপরাধে অপরাধী। বিয়ের পর বরিশালে গিয়ে তাঁর বড় পিসিমাকে বলেছিলেন— তোমরা যদি বলে দিতে তা হলে আমি নিজেই একটা আংটি কিনে নিয়ে যেতাম। আমার জন্য লাবণ্যর জ্যাঠামশায়কে শুধু শুধু কতগুলো টাকা খরচ করতে হল।’’’

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy