প্রেম, বিয়ে, চাকরির মতো সন্তানধারণের ক্ষেত্রেও যে মেয়েদের মতামত থাকতে পারে, তা নিয়ে আমাদের আগের প্রজন্মেরও খুব একটা মাথাব্যথা ছিল না। বিয়ের পর সন্তান হবে, কর্মরতা মা চাকরি করেও সন্তান মানুষ করবে... এমনটাই তো আমরা দেখতে অভ্যস্ত। কিন্তু হঠাৎ কোনও চাকুরিরতা মেয়ে যদি বলে সে মা হতে চায় না, তবে?
শহুরে, উচ্চশিক্ষিতা, কেরিয়ারে সফল অনেক মেয়ে ও মহিলাই ইদানীং মা হতে চাইছেন না। এবং এই ট্রেন্ড ক্রমশ বাড়ছে। প্রসঙ্গত, এই মেয়েরা শারীরিক ভাবে সন্তানধারণে সক্ষম। কিন্তু মাতৃত্বের দায়িত্ব নিতে তাঁরা অরাজি। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অভিরুচি চট্টোপাধ্যায়ের মতে, এই সিদ্ধান্তের পিছনে অনেকগুলি বিষয় কাজ করছে। তার মধ্যে আর্থ-সামাজিক কারণই বেশি।
পেরেন্টিং একটি ফুলটাইম জব। এখনকার অনেক মেয়েই ‘বাই ডিফল্ট’ মা হওয়ায় বিশ্বাসী নয়। তাঁদের সংশয়, তাঁরা কি আদৌ মা হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছেন? তাঁরা কি বাচ্চাকে ঠিকমতো মানুষ করতে পারবেন?
অনেক মেয়েরই মনে হয় যে, মা হওয়ার পর নারী হিসেবে তাঁদের যৌন আবেদন কমে যায়। পার্টিতে আর তিনি মধ্যমণি হতে পারবেন না, এমন দুশ্চিন্তা থেকেও অনেকে মা হতে চান না।
কেরিয়ারে অত্যন্ত সফল মহিলাদের কাছে মা হওয়া মানেই কাজের ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া। এখনকার আইটি-নির্ভর চাকরির বাজারে সে কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। উপরন্তু, অনেক ক্ষেত্রেই স্বামী-স্ত্রী রয়েছেন লং-ডিসট্যান্স ম্যারেজে। তা হলে বাচ্চা কার কাছে থাকবে?
এখনকার বেশির ভাগ ওয়র্কিং পেরেন্টের বাচ্চা থাকে মেয়েটির মা-বাবা অথবা ছেলেটির মা-বাবার কাছে। কিন্তু সেই সুযোগ যদি না থাকে, তবে বাচ্চাকে কে দেখবে?
শিশু প্রতিপালনের সঙ্গে আর্থিক সঙ্গতির সম্পর্ক সবচেয়ে গভীর। ‘কস্ট অব লিভিং’-এর কথা ভেবেও অনেকে পিছিয়ে যান। তবে আর্থিক দিক দিয়ে সচ্ছল দম্পতিদের মধ্যেও বাচ্চা নিতে আপত্তি রয়েছে। যার জন্য ‘ডিঙ্ক’ (ডাবল ইনকাম নো কিড) শব্দটিরও ব্যবহার বেড়েছে।
প্রকৃতির নিয়মে মেয়েরা সন্তানধারণ করেন ঠিকই। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তাঁর স্বামী বা পুরুষ-সঙ্গীর মতামতও সমান গুরুত্বপূর্ণ। তাই কোনও মেয়ে যখন মা হতে চাইছেন না, তাঁর স্বামী সেই সিদ্ধান্তে পাশে না দাঁড়ালে সম্পর্কেও দূরত্ব বাড়ছে।
স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ অভিনিবেশ চট্টোপাধ্যায় তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে বলছেন, ‘‘এ ক্ষেত্রে অনেক সময়েই মেয়েরা দলবদ্ধ ভাবে আসেন। অর্থাৎ, এই সিদ্ধান্তে কোনও কোনও ক্ষেত্রে ‘পিয়ার প্রেশার’ও কাজ করে।’’ তবে পরিস্থিতি জটিল হয় অন্য ক্ষেত্রে।
তিরিশের কোঠায় অনেক মেয়ে ও তাঁদের স্বামী যৌথ ভাবেই সিদ্ধান্ত নেন, তাঁরা বাবা-মা হবেন না। কিন্তু দশ-পনেরো বছর পরে তাঁদের অনেকেই আবার সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলেন। মেয়েটি যখন মধ্য চল্লিশের, তখন স্বামী-স্ত্রী বাচ্চার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠেন। বেশি বয়সে মা হওয়ায় মা ও শিশুর অনেক রকম ঝুঁকিও থাকে। তাই চিকিৎসকের মতামত, ‘‘যখনই আমার কাছে এমন মেয়েরা আসেন, আমি তাঁদের কাউন্সেলিং করি। যাঁরা পরবর্তী কালে সিদ্ধান্ত বদলেছেন, এমন মেয়েদের সঙ্গে তাঁদের কথা বলতে বলি। কারণ এই সিদ্ধান্ত নেওয়াটা খুব একটা সহজ নয়।’’
স্বাভাবিক নিয়মে ও নির্দিষ্ট সময়ে মা না হওয়ার জন্যই দত্তক ও সারোগেসির মাধ্যমে সন্তান নেওয়ার ট্রেন্ডও বাড়ছে। তবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে শুধু মাত্র আর্থিক দিক দিয়ে স্বাধীন মেয়েরাই মা না হওয়ার চয়েস দাবি করতে পারেন। যে মেয়ে তাঁর ভরণপোষণের জন্য স্বামীর উপর নির্ভরশীল, তাঁর এই সাহস দেখানোর সুযোগ নেই বললেই চলে। তবে ক্ষেত্রবিশেষে ব্যতিক্রম হতে পারে।
মাতৃপূজারি ভারতে মা হওয়ার মধ্যে একটা কৌলীন্যবোধ রয়েছে। যে নারী শারীরিক কারণে মা হতে পারেন না (সমস্যা তাঁর স্বামীর হলেও), তিনি ব্রাত্য। সেখানে শারীরিক ভাবে সক্ষম হয়েও সন্তান না চাওয়ার ইচ্ছে জানাতে অনেকটা সাহস লাগে বইকী। অন্য দিকে, শারীরিক কারণে বার কয়েকের চেষ্টায় মা হতে অসফল হলে, সেই মেয়েদেরও মাতৃত্বের প্রতি বিতৃষ্ণা আসে। চাওয়া-পাওয়ার দ্বন্দ্বে দোদুল্যমান সেই মহিলাদের মানসিক সমস্যাও বাড়তে থাকে।
তাই যে মেয়েরা মা না হওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তাঁরা আফসোসের ভয়ে আপস করবেন না। তবে সব দিক ভেবেই সিদ্ধান্ত নেওয়া শ্রেয়।
মডেল: এণাক্ষী
মেকআপ: জিতু
ছবি: দেবর্ষি সরকার
লোকেশন: দি আইভি হাউস
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy