বিদেশ যাওয়ার আগে, সামনে ‘শ্রীমদ্ভাগবতম’-এর প্রথম খণ্ড
আর এক বার ৮ জুন ১৯৭৬ সালে প্রভুপাদ বলেন:
গোপাল আগরওয়ালার বাবা ছেলেকে বলেন, স্বামীজি আমেরিকায় যেতে চান। তিন চার মাস পরে ইন্ডিয়ান এমব্যাসি নিউইয়র্ক থেকে ‘নো অবজেকশন’ সার্টিফিকেট এল। এর পর আমি পাসপোর্টের ব্যবস্থা করলাম। সুমতি মোররাজি একবার পাঁচশ টাকা দিয়ে আমার কাছ থেকে বই কিনেছিলেন, তাই ওঁকেই ধরলাম, একটা ফ্রি টিকিট দিন।
মার্কিনদেশে প্রভুপাদের আগমন ও প্রাথমিক সংগ্রামের নানা বিবরণ যথাসময়ে গভীর ধৈর্যের সঙ্গে সংগৃহীত হয়েছে। তার বিবরণ অনেক অ্যাডভেঞ্চার কাহিনিকেও হার মানায়।
প্রভুপাদের নিজের কথায়: বোস্টনে জলদূত জাহাজে ঢুকে মার্কিন ইমিগ্রেশন অফিসার জিজ্ঞেস করলেন, আপনি এ দেশে কত দিন থাকতে চান? আমি ভাবলাম, আমার আশ্রয় নেই, অর্থ নেই, কিন্তু একটা রিটার্ন টিকিটের সম্ভাবনা রয়েছে। আমি নিজেই বুঝতে পারছি না কত দিন থাকা যায়? অবশেষে উত্তর দিলাম দু’মাস, কারণ তার থেকে বেশি সময় কোথায় থাকব? কোথায় খাব? অফিসার সঙ্গে সঙ্গে দু’মাস ম়ঞ্জুর করে দিলেন। এর পরে তো মাঝে মাঝে ভিসা বাড়াচ্ছি, প্রতি বারের জন্য? ডলার ফি দিতে হচ্ছে। এই ভাবে যখন এক বছর হয়ে গেল তখন ওঁরা বললেন, আর এক্সটেনশন নয়।
স্থায়ী ভাবে বসবাসের জন্য এক জন উকিলকে ধরতে হল। তিনি প্রতি বার দেড়শো ডলার ফি নিতেন। ইতিমধ্যে মে মাসে প্রভুপাদের গুরুতর হার্ট অ্যাটাক হল।
প্রথম দিকের যৎসামান্য বিবরণ। নিউ ইয়র্কে জাহাজ থেকে নেমে একটা বাস ধরে বহু দূরে পেনসিলভেনিয়া। জাহাজ থেকে নামলেন দুপুর একটায়, পাঁচটায় বাস ধরলেন, ভোর তিনটেয় লক্ষ্যস্থানে, সেখানে বাসস্ট্যান্ডের সামনে দাঁড়িয়ে বন্ধুপুত্র গোপাল আগরওয়ালা, সেখান থেকে তিরিশ মাইল ড্রাইভ করে বাটলার কাউন্টি।
গোপালের বাড়তি ঘর নেই, তাই তাঁকে ওয়াইএমসিএ-তে দিয়ে এলেন। গোপালের মেমসাহেব বউ যথেষ্ট সাহায্য করলেন। এঁদের সঙ্গে তিন সপ্তাহ থেকে আবার পাঁচশ মাইল দূরে নিউইয়র্ক।
সঙ্গে কয়েক কপি ইংরেজি শ্রীমদ্ভগবৎ ছিল, সেই গুলো বিক্রি করে চলছিল। তার পর সেভেনটি ফার্স্ট স্ট্রিটে কয়েক মাস বসবাস। তার পর আর একটা বাড়ি ভাড়া এবং প্রতি দিন বিকেল ৩-৬টা টমকিন্স স্কোয়্যার পার্কে কৃষ্ণনাম কীর্তন এবং সেখান থেকেই বিশ্ববিজয়ের শুরু এবং সে এক অবিশ্বাস্য মহাভারত-কথা।
আর একবার ভক্তিবেদান্ত পোপের কাছে দীর্ঘ চিঠিতে শ্রীমদ্ভাগবতকে ঈশ্বরবিজ্ঞান বলে বর্ণনা করেন এবং ঈশ্বরবিহীন সভ্যতার বিপদের কথা উল্লেখ করেন। কৃষ্ণভাবনামৃতের শুরুতেই রয়েছে চারটি অধঃপতন থেকে দূরে থাকা। এগুলি হল—বিবাহবন্ধনের বাইরে যৌন সম্পর্ক, মাছমাংস ইত্যাদি খাওয়া, সব রকমের নেশাভাঙ এবং জুয়াখেলা। বহু বছর আগে শ্রীচৈতন্য এ রকমই চেয়েছিলেন।
১৩ অগস্টের ঐতিহাসিক জলযাত্রার পরে প্রভুপাদ এগারো বছরে চোদ্দো বার বিশ্ব প্রদক্ষিণ করেন—ছ’টি মহাদেশে হাজার হাজার ভক্তের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয়। এর মধ্যে কয়েক বার তিনি ভারতে, বিশেষ করে কলকাতাতেও আসেন। এ দেশেও বেশ কয়েকটি মন্দির স্থাপিত হয়।
লীলা-অবসানের শেষ পর্বটি প্রভুপাদের শিষ্যরা অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন।
শেষ বছর ১৯৭৭-এর শুরুতে আমরা প্রভুপাদকে ভুবনেশ্বরে দেখি। বিশ্বব্যাপী সঙ্ঘের নানা পরিচালন পত্র ও আইনি সমস্যা তাঁর অসুস্থ শরীরকে আরও জর্জরিত করে রেখেছিল। তিনি বলতেন, আমরা কখনও মগজ ধোলাই করার চেষ্টা চালাইনি। সবই করেছি শাস্ত্রের নির্দেশে।
পরের মাসে (৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৭) তিনি চৈতন্য জন্মভূমি মায়াপুরে। নবনির্মিত মন্দির দেখে বললেন, ‘‘এখন যদি আমার মৃত্যু হয় কিছু এসে যায় না।’’
লেখক প্রভুপাদের ইতিমধ্যেই বিশ্বজোড়া স্বীকৃতি— শুধু মাত্র ইংরেজিতেই চার কোটি চৌত্রিশ লক্ষ পঞ্চাশ হাজার বই প্রকাশিত হয়েছে। শ্রীমদ্ভগবৎ তখনও সম্পূর্ণ হয়নি— বেঁচে থাকার শেষ মুহূর্তে পর্যন্ত অনুবাদের কাজ অব্যাহত। মৃত্যু পথযাত্রী অনুবাদককে এক জন শ্লোকটি পড়ে শোনাত। আর এক জন মুখের সামনে মাইক্রোফোন ধরত। কী বলছেন, তা শুনতে অসুবিধে হত। কিন্তু অনুবাদকর্ম ব্যাহত হত না।
মার্চ মাসে খবর এল, নিউইয়র্ক হাইকোর্ট হরে কৃষ্ণ আন্দোলনকে আইনি স্বীকৃতি দিয়েছে। অসুস্থ শরীর সম্বন্ধে প্রভুপাদ বলতেন, এটা পুরনো মেশিন, যতই সারানো যায়, ততই এটা খারাপ হয়।
এ বার কেন্দ্র হৃষীকেশ। পাঠকদের বললেন, ‘‘একটা উইল করো। আমি সই করব।’’ আরও বললেন, ‘‘আমি বৃন্দাবনে যেতে চাই। যদি আমাকে দেহত্যাগ করতে হয়, তা যেন বৃন্দাবনে হয়। আমার যা কিছু বলার আমি আমার বইয়ের মধ্যে বলেছি।’’