Advertisement
১৮ মে ২০২৪
সব স্পর্শই মধুর নয়

যৌন নিগ্রহ সম্পর্কে সন্তানকে সচেতন করবেন কী ভাবে?

সন্তানের মনকে বিষিয়ে না তুলেও তাকে যৌন নিগ্রহ সম্পর্কে সচেতন করা যায়। এর জন্য প্রয়োজন অভিভাবকদের মাত্রাজ্ঞানউন্নত দেশগুলিতেও এই সমস্যা বেড়েই চলেছে। আমেরিকার একটি বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রতি এ নিয়ে সমীক্ষা করেছিল। তাতে দেখা গিয়েছে, শুধু শারীরিক নয়, তার জেরে বড় ধরনের মানসিক নির্যাতনেরও শিকার হচ্ছে শিশুরা।

সোমা মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০১৮ ০০:৪৪
Share: Save:

যৌন নিগ্রহ কাকে বলে তা বোঝার মতো বয়স তো তখন হয়নি ছোট্ট মেয়েটার। কিন্তু চকলেট দেওয়ার নাম করে বাবার বন্ধু তাকে কোলে বসিয়ে এমন কিছু করত যা তার ভাল লাগত না। তার কষ্ট হত। মাকে সে কথা বলেছিল একরত্তি মেয়ে। মা বলেছিলেন, এমন কথা যেন আর কখনও সে মুখে না আনে। মেয়ে চুপ করে গিয়েছিল। আর তাই ‘কাকু’কেও দমানো যায়নি। শৈশবের সেই ক্ষত বহন করে ক্লান্ত মেয়েটা তার যৌবনে পৌঁছে প্রকাশ্যে উগরে দেয় সব। শুধু সেই কাকু নয়, সে জানায় তার শৈশব নষ্টের পিছনে বাবা-মায়ের ওই চুপ করে থাকাও কিছু কম দায়ী নয়।

জনপ্রিয় হিন্দি ছবির সুবাদে এই গল্প আমাদের জানা। ছবিতে মা-বাবার ভূমিকা দেখে ‘ছি ছি’ করেননি এমন লোক পাওয়া মুশকিল। কিন্তু প্রশ্ন হল, বাস্তব জীবনে এমন ঘটলে আমাদের ভূমিকা ঠিক কেমন হয়? বাস্তবের বাবা-মায়েরা ঠিক কতটা সচেতন এ ব্যাপারে? তাঁদের সন্তানও শৈশবে এমন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে না, তা কী ভাবে নিশ্চিত হচ্ছে?

মাস কয়েক আগে স্কুল পড়ুয়া এক শিশুর যৌন নিগ্রহের ঘটনায় তোলপাড় হয়েছিল রাজ্য। এ ক্ষেত্রে অভিযোগের তির ছিল স্কুলেরই এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে। তার পরে একের পর এক বেশ কিছু স্কুলে এমন অভিযোগ উঠতে শুরু করে। রাতারাতি শিশুদের ‘গুড টাচ-ব্যাড টাচ’ নিয়ে সচেতন করতে কর্মশালা শুরু হয় বহু জায়গায়। কিন্তু শুধু কর্মশালা করেই কি এই সমস্যার সমাধান সম্ভব? সমস্যা হল, ঘটনা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। কিন্তু এ নিয়ে আলোচনায় এখনও ঘোরতর অনীহা। এ দেশে প্রতি ১৫ মিনিটে একটি শিশু যৌন নিগ্রহের শিকার হয়। প্রোটেকশন অব চিলড্রেন এগেনস্ট সেক্সুয়াল অফেন্সেস অ্যাক্ট (পকসো) ২০১২-কে আরও জোরালো করা হয়েছে। ২০১৬ সালে কেন্দ্রীয় সরকার প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা গিয়েছে, শিশুদের উপরে অত্যাচারের ১,০৬,৯৫৮টি ঘটনা নথিবদ্ধ হয়েছে। এর মধ্যে ৩৬,০২২টি পকসো আইনের আওতায় পড়ে।

কী ভাবে বলবেন

সব ধরনের স্পর্শই যে খারাপ নয়, সেটা সন্তানকে বোঝানোও জরুরি। তাই তাকে সতর্ক করার সময়ে খেয়াল রাখতে হবে, যাতে সব রকম স্পর্শের ক্ষেত্রেই তার আতঙ্ক তৈরি না হয়। খুব গুরুগম্ভীর পরিবেশ তৈরি করে নয়, বোঝাতে হবে খেলার ছলে। গল্প করার সময়ে কিংবা খাওয়ার টেবিলে। মনোবিদেরা বলছেন, সন্তানের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতে মা তাকে জড়িয়ে ধরতে পারেন। কিংবা গল্প করার সময়ে তার কপালে আলতো চুমু খেতে পারেন বাবা। এই ধরনের স্পর্শে যে আশ্বাস আছে, সেটা সে নিজেই উপলব্ধি করবে। সন্তানের সামনে নিজেদের পরিবারের ঘনিষ্ঠজনের কাঁধে হাত রাখতে পারেন। হাত ধরতে পারেন। বন্ধুদের জড়িয়ে ধরতে পারেন। তাতে সে বুঝবে অধিকাংশ স্পর্শই ভাল। কিন্তু কিছু কিছু স্পর্শ এড়িয়ে চলতে হবে। যেমন, তাকে তার অন্তর্বাস সম্পর্কে বোঝাতে হবে। বোঝাতে হবে, অন্তর্বাসের নীচে শরীরের যে যে অংশ থাকে, সেখানে কেউ হাত দিতে চাইলে সেটা ‘খারাপ’। সে ক্ষেত্রে তাকে প্রতিবাদ করতে হবে, বাড়িতে জানাতে হবে। যদি দেখেন আপনার সন্তান কারও সঙ্গে হঠাৎই খারাপ ব্যবহার করছে, তাকে এড়িয়ে চলতে চাইছে, তা হলে বুঝতে হবে তার পিছনে নিশ্চয় কারণ রয়েছে। শান্ত-সহজ ভাবে তার কাছ থেকে জেনে নিন। শিশুরাও নিজেদের শরীর সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন থাকে। কোনও স্পর্শ খারাপ লাগলে সে নিজে বুঝতে পারে। এ নিয়ে প্রশ্ন করলে দিশা দেখানো মা-বাবারই দায়িত্ব।

উন্নত দেশগুলিতেও এই সমস্যা বেড়েই চলেছে। আমেরিকার একটি বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রতি এ নিয়ে সমীক্ষা করেছিল। তাতে দেখা গিয়েছে, শুধু শারীরিক নয়, তার জেরে বড় ধরনের মানসিক নির্যাতনেরও শিকার হচ্ছে শিশুরা। গোটা বিশ্ব জুড়েই এই প্রবণতা বাড়ছে। পুরুষদের মধ্যে আট শতাংশ এবং মেয়েদের মধ্যে ১২ শতাংশ শৈশবেই যৌন নিগ্রহের শিকার হয়। সেন্টার ফর ডিজ়িজ় কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতি চার জন মেয়ের মধ্যে এক জন এবং ছ’জন ছেলের মধ্যে এক জন ১৮ বছর বয়সের আগেই যৌন নিগ্রহের শিকার হয়। বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, শৈশব বা কৈশোরের এই ধরনের ঘটনা পরবর্তী সময়ে ওই শিশুদের মধ্যে বড় ধরনের স্থায়ী মানসিক সমস্যা তৈরি করে। শুধু মেয়ে নয়, ছেলেদের ক্ষেত্রেও যে কোনও

সময়ে ঘটতে পারে এই ধরনের নিগ্রহ। বহু ক্ষেত্রে ছেলেদেরই বেছে নেয় বিকৃতমনস্কেরা। তা সে বাড়ি, স্কুলবাস, স্কুলের শৌচাগার, আত্মীয়ের বাড়ি, খেলার মাঠ, যা-ই হোক না কেন।

কলকাতার এক নামী রেস্তরাঁ। বাবা-মায়ের সঙ্গে সেখানে গিয়েছে বছর সাতেকের ছেলে। রেস্তরাঁয় ভিড়। বাবা-মা অপেক্ষা করছেন। প্রৌঢ় নিরাপত্তাকর্মী ছেলেটিকে কোলে তুলে নিয়ে অদূরে এক চিলতে বাগানে খেলতে গেলেন। মিনিট কয়েকের মধ্যে জায়গা মিলল রেস্তরাঁয়। কিন্তু খাওয়ায় যেন মন নেই ছেলের। বাবা-মা বারবার জিজ্ঞাসা করলেন। ছেলে চুপ করে রইল। মায়ের মনে কেমন যেন একটা সন্দেহ হল। রাতে শোওয়ার আগে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে মা জানতে চাইলেন, কী হয়েছে তার। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে ডুকরে উঠল সে। জানাল, ওই দাদুটা তাকে ব্যথা দিয়েছে। এর পরের ঘটনা পুলিশ, অভিযোগ, গ্রেফতার পর্যন্ত গড়ায়। পুলিশের শীর্ষকর্তাদের মতে, এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি দোষ স্বীকার করেছিল বলে বিষয়টি গ্রেফতারি পর্যন্ত এগিয়েছে। কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই এই ধরনের ঘটনা প্রমাণ করা যায় না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একটি শিশুর জবানির উপরেই তা নির্ভর করে। সেই বক্তব্যকে কেউ বিশ্বাস করতে পারেন, আবার শিশুটি বানিয়ে বলছে ধরে নিয়ে তা উড়িয়েও দিতে পারেন। বাড়িতে তার মা বা অন্য কাছের মানুষেরা তা বিশ্বাস করছেন না বুঝতে পারলে শিশু অনেক বেশি গুটিয়ে যায়। ধাক্কা খায় তার আত্মবিশ্বাস। বাড়িতে যদি বাবা-মা বিষয়টিকে গুরুত্ব না দেন, তা হলে সন্তান বড় বেশি করে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকে। সে ধরে নেয় দোষটা বোধহয় তারই। সে-ই বোধহয় কোনও ভুল করেছে। তাই সে আরও বেশি করে গুটিয়ে যায়। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, এর জেরে পরে মানসিক সমস্যা কিংবা যৌন শৈত্যের ঘটনাও ঘটে।

আপনার দায়িত্ব

• অবাঞ্ছিত স্পর্শ বলতে ঠিক কী বোঝায়, সন্তানের মনে তার প্রাথমিক একটা ধারণা তৈরি করে দিন
• শরীরে অবাঞ্ছিত স্পর্শ হলে বাড়িতে জানাতে বলুন
• ‘কাউকে বোলো না’ কিংবা ‘দোষটা তোমারই’ জাতীয় কথা বলবেন না
• ‘কাউকেই বিশ্বাস করা যায় না’-এমন কোনও ধারণা তৈরি করবেন না
• ঘন ঘন অন্যের সামনে
তার অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে বলবেন না
• যদি মনে হয় তার মানসিক ক্ষত গভীর, তা হলে মনোবিদের সাহায্য নিন

তা হলে কী করণীয়? ছোট থেকেই সন্তানকে ‘গু়ড টাচ-ব্যাড টাচ’ সম্পর্কে শিখিয়ে পড়িয়ে রাখবেন? কিন্তু তাতে তার শৈশব ধাক্কা খাবে না তো? নিষ্পাপ মনটা আমরা বিষিয়ে তুলব না তো? ইদানীং বহু ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, অতিরিক্ত সচেতন করতে গিয়ে শিশুটির শৈশব মারাত্মক ধাক্কা খাচ্ছে। এক সহকর্মী শোনাচ্ছিলেন তাঁর অভিজ্ঞতার কথা। পাঁচ বছরের মেয়েকে সেই সহকর্মীর স্ত্রী ‘গু়ড টাচ-ব্যাড টাচ’ বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন। দিন কয়েক পরে এক পারিবারিক অনুষ্ঠানে শিশুটির জেঠু তাকে আদর করতে গেলেই সে বলে ওঠে, ‘‘যা করার দূর থেকে। একদম গায়ে হাত দেবে না।’’

মনোবিদেরা বলছেন, এ ক্ষেত্রে অভিভাবকদের মাত্রাজ্ঞানটাই সবচেয়ে জরুরি। কতটা তাকে বলবেন, কতটা বলবেন না, কতটা অবিশ্বাস তার মনের মধ্যে বুনে দেবেন আর কতটাই বা তাকে নিজের মতো করে বড় হতে দেবেন, এর কোনও ‘মে়ড ইজ়ি’ হয় না। যে যার নিজের মতো করে বুঝে নিয়ে এটা করবেন। সন্তানের জীবনে কোনও খারাপ অভিজ্ঞতা হলে সেটার প্রতিকার জরুরি। সন্তানের মন থেকে সেই স্মৃতি মুছে দেওয়ার চেষ্টা করাটা আরও জরুরি। কিন্তু তা করতে গিয়ে যেন জীবনের কদর্য দিকটা তার সামনে অতিরিক্ত তুলে ধরা না হয়। কোনও একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনায় স্কুলের কোনও শিক্ষক কোনও পড়ুয়াকে নিগ্রহ করলে সকলের সামনে সোফায় গুছিয়ে বসে ‘আঙ্কল/আন্টিকে বলো, তোমার সঙ্গে ঠিক কী হয়েছিল’ জাতীয় কথা বলে অভিভাবকেরা মোটেও দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দেবেন না।

প্রশ্ন হল, বাইরের জগতের কত জন সম্পর্কে তাকে সাবধান করবেন? কলকাতার এক স্কুল শিক্ষিকা দুঃখ করে বলছিলেন, ‘‘আমাদের ছোটবেলায় মা বলতেন, ‘বাবা ছাড়া আর কেউ জড়িয়ে ধরে বেশি আদর করলে আমাকে জানিও, কেমন?’ কিন্তু এখন তো এমন ঘটনাও ঘটছে, যেখানে বাবাকেও বিশ্বাস করা যাচ্ছে না। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাচ্ছে আমাদের। আমাদের সন্তানদেরও।’’

এটা ঠিক, আমাদের চারপাশের পরিবেশটা ক্রমশ জটিল হচ্ছে। অচেনা হয়ে উঠছে চেনা সম্পর্ক, চেনা বিশ্বাসের জায়গাগুলো। কিন্তু তা থেকে নিজের সন্তানকে আগলে রাখা, তার জগৎটাকে জটিলতামুক্ত রাখতে তাকে সতর্ক করার দায়িত্বটা অভিভাবকদেরই। এই সতর্ক করাটা আসলে একটা দড়ির উপর দিয়ে হাঁটা। পরিবারে, বাইরের কাজের জগতে নিজেদের দক্ষতার প্রমাণ দেওয়ার জন্য যাঁরা মুখিয়ে থাকেন, জীবনের এই ক্ষেত্রে দড়ির উপর দিয়ে সফল ভাবে চ্যালেঞ্জটা থেকে তাঁরা যেন মুখ না ফেরান!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Sexual Harassment
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE